ব্যাংকক (থাইল্যান্ড) থেকে: আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি এবং সেটা অত্যন্ত কঠোর। তবে তোমাদের আরো সচেতন হতে হবে।
তারা কঠোর ও দায়িত্বশীল হলে আমাদের সেনাবাহিনীর জেনারেল, গভর্নর, পুলিশ কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদসহ বহু মানুষ হয়ত বেঁচে যেতেন। তারা এই অপকর্মে জড়িত থাকার সুযোগই পেতেন না।
জড়িতদের আমরা বিচারের আওতায় এনেছি। এখন তোমাদের জোরালো পদক্ষেপ আর কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমেই কেবল এ অঞ্চলে মানবপাচার রোধ করা সম্ভব।
এ কথাগুলো বলছিলেন থাই অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ের মুখপাত্র ওয়ানচাই রোজানাভং।
মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে থাইল্যান্ডে ৭২ জনের বিচার শুরু হয়েছে। এদের মধ্যে ৩০ জনের বিরুদ্ধে আদালত থেকে জারি করা হয়েছে গ্রেফতারি পরোয়ানা। অভিযুক্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে এবং তা শতাধিক ছাড়িয়ে গেছে বলে কূটনৈতিক একটি সূত্র জানিয়েছে।
অভিযুক্তদের মধ্যে থাইল্যান্ডে আটক মায়ানমার ও বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন নাগরিকও রয়েছেন। তবে থাই নাগরিকদের সংখ্যাটাই বেশি।
গত মে মাসে মালয়েশিয়া সীমান্তবর্তী থাইল্যান্ডের একটি জঙ্গলে পাচারকারীদের পরিত্যক্ত আস্তানায় গণকবরের সন্ধান পাওয়ার পর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমুদ্রপথে মানবপাচার নিয়ে শুরু হয় তোলপাড়।
থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া উপকূলে ভেসে থাকা নৌকাগুলোকে প্রথমে সাগরে ঠেলে দেওয়া হলে সমালোচনা আরো বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে আন্তর্জাতিক চাপে সাগরে ভাসমান অবস্থায় পাচারকারীদের নৌকাগুলো থেকে কয়েক হাজার মানুষকে উদ্ধার করা হয়।
ভাগ্যান্বেষণে দালালদের মাধ্যমে বাংলাদেশি ও মায়ানমারের রোহিঙ্গারাই ঝুঁকিপূর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে যাচ্ছিলেন থাইল্যান্ডে। এর মধ্যে অবৈধ অভিবাসন প্রত্যাশী বিবেচনায় আটকদের অনেককে প্রটেকশন সেন্টারে নেওয়া হলেও অবশিষ্টদের ঠাঁই হয়, বিভিন্ন কারাগারে।
এদিকে, বাংলাদেশ হাইকমিশনেরর একটি সূত্র বলেছে, মায়ানমার সরকারের নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গারা কয়েক বছর ধরে সমুদ্রপথে ঝুঁকি নিয়ে প্রতিবেশী দেশ মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। বাংলাদেশ থেকেও কাঠের নৌকা বা মাছ ধরার ট্রলারে করে নিয়মিত মালয়েশিয়ায় যাওয়ার চেষ্টার ঘটনা ঘটনা ক্ষুণ্ন করেছে, বাংলাদেশের ভাবমূর্তি।
সূত্র মতে, অভিবাসন প্রত্যাশীদের পাচারকারীরা বিপজ্জনক সমুদ্রপথে ট্রলারে করে থাইল্যান্ডে নিয়ে যায়। দেশটির সামরিক কর্মকর্তা থেকে শুরু করে প্রদেশের গভর্নর এমনকি রাজনীতিবিদদের প্রভাবে পাচারকারী চক্র গভীর জঙ্গলে স্থাপিত বিভিন্ন শিবিরে আটকে রেখে তাদের পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায় করতো। মুক্তিপণ না পেলে পাচারকারীদের নির্যাতনে প্রাণ হারাতে হয় অনেককেই।
থাইল্যান্ডে আইনের শাসন রক্ষার ব্যাপারে দেশটির পদক্ষেপ বেশ দৃশ্যমান। মানবপাচারে রোধে জড়িতদের ব্যাপারে দেশটির সরকারের অবস্থান জিরো টলারেন্স।
অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ের মুখপাত্র ওয়ানচাই রোজানাভং বাংলানিউজকে বলেন, ইতোমধ্যে অভিযুক্ত ৭২ জনের বিরুদ্ধে আনা হয়েছে মানবপাচার, বিদেশি নাগরিকদের অবৈধভাবে থাইল্যান্ডে প্রবেশ করানো, বহুজাতিক অপরাধ নেটওয়ার্কের হয়ে কাজ করার মতো অভিযোগ।
তিনি জানান, থাইল্যান্ড যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তা নজিরবিহীন। আমরা আশা করছি, সংশ্লিষ্ট দেশগুলো আরো কঠোর হলে এমনিতেই মানবপাচার কমে আসবে।
বাংলাদেশে মানবপাচারের অভিযোগে বেশ কয়েকজন ব্যক্তি কথিত ক্রসফায়ারে মারা গেছেন। মামলা হয়েছে, দুই হাজারের মতো।
বিষয়টি জানানো হলে ওয়ানচাই রোজানাভং জানতে চান বিচারের ফলাফল। যদিও বাংলাদেশে তদন্ত প্রক্রিয়া এখনো শেষ হয়নি।
মানাস কংপান নামে থাই সেনাবাহিনীর যে জেনারেলকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তিনি দেশটির বর্তমান প্রধানমন্ত্রী প্রায়ুত চ্যান ওচারের ঘনিষ্ঠজন হিসেবেই মনে করা হয়। কারণ, প্রায়ুত চ্যান ওচা যখন সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন তখন তিনি এই অফিসারকে লেফটেন্যান্ট জেনারেলের পদে উন্নীত করেন।
রোজানাভং বলেন, নিকট ইতিহাসে এ ধরনের তদন্ত হয়েছে বলে তার জানা নেই। এ ঘটনা আমাদের দেশের ইমেজকে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে এ ব্যাপারে নিবিড় তদন্ত চলছে। আরো বহু লোক এ ঘটনায় ফেঁসে যাবেন। আমাদের বার্তা একটাই, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না- যোগ করেন এই মুখপাত্র।
স্থানীয় একজন সংবাদমাধ্যম কর্মীর সহায়তায় কথা হয়, থাই পুলিশের উপপ্রধান আয়েক আংসানানন্তের সঙ্গে। তিনি জানান, অভিযুক্তের সংখ্যা ইতোমধ্যে একশ ছাড়িয়ে গেছে। ৭২ জনকে চিহ্নিত ও গ্রেফতারের পর চিহ্নিত করা হয়েছে আরো ৪৫ জনকে। আর অভিযানের মুখে যারা দেশের বাইরে আত্মগোপন করেছেন, তাদের আন্তর্জাতিক সহায়তা নিয়ে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করা হবে বলেও জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।
এ ব্যাপারে কথা হয়, এশিয়ার অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন ক্যারাম এশিয়ার সঙ্গে। সংগঠনটির আঞ্চলিক সমন্বয়কারী হারুন অর রশিদ বাংলানিউজকে জানান, আসলে বাংলাদেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকেই মানবপাচারকারীদের চক্করে পড়ে বহু অভিবাসন প্রত্যাশীর মৃত্যু হয়েছে সাগরে কিংবা গভীর জঙ্গলে। অনেকের পরিবার হয়েছে সর্বশান্ত।
এই মানুষগুলো তো আর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে উড়ে বঙ্গোপসাগর থেকে মায়ানমারের জলসীমায় যায়নি। তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন উপকূল হয়েই সেখানে গিয়ে পাচারকারীদের ট্রলারে উঠেছে। তাহলে বাংলাদেশের উপকূলরক্ষী কিংবা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী অন্য বাহিনীগুলোরই-বা কী দায়িত্ব! বাংলাদেশে বেশ কয়েকজনকে মানবপাচারকারী সন্দেহে আটকের পর কথিত ক্রসফায়ারে মারা যান। তবে জবাবদিহিতার আওতায় আনা হয়নি সীমান্ত ও উপকূলরক্ষীসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের।
থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া ব্যবস্থা নিচ্ছে। এবার বাংলাদেশকেও এদের পথ ধরে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে। তাহলে এমনিতেই বাংলাদেশ থেকে মানবপাচারের ঘটনা কমে আসবে বলেন হারুন অর রশিদ।
বাংলাদেশ সময়: ১২৩৬ ঘণ্টা, আগস্ট ১৪, ২০১৫
এবি
** পাতায়ার ওয়াকিং স্ট্রিটে হাঁটে না দৌড়ায়!
** জাল ভিসা নিয়ে ধরা পড়লেই থাইল্যান্ডে দুই বছরের জেল
** থাইল্যান্ডে স্বদেশিদের স্বজন আদম আলী মীর
** সবার মুখে মুখে ‘লাক মে মাক মাক’
** পাতায়ার ‘ডন’
** বাংলার আলোয় আলোকিত পাতায়া