থাইল্যান্ড থেকে ফিরে: ‘এই বোমা বিস্ফোরণ আমার ক্ষতি করে দিল,’ ভাঙা ইংরেজিতে স্বগতোক্তি করল মেয়েটি। বয়স ২৪-২৫ কিংবা তারও কম হতে পারে।
ব্যাংকক পৌঁছে বিমানবন্দর থেকে সোজা পাতায়া, হোটেলে এসে জিনিষপত্র রেখে সবে হোটেলের বাইরে এসেছি, ওয়াকিং স্ট্রিটটা ঘুরে দেখব বলে।
পাতায়া ঝকঝকে শহর। পর্যটক মনোরঞ্জনের সব ব্যবস্থাই জানে পাতায়া। একটু দূরে পরপর বেশ কয়েকটি নাইট ক্লাব, বার, রেস্টুরেন্ট। এরই মধ্যে রাস্তার ধারের একটা বারের সামনে টুলের উপর বসে ছিল কয়েকটি মেয়ে। তাদের মধ্যে এই মেয়েটি একজন। পেনচান।
কিছুসময় আগেই হয়েছে ব্যাংককে বিস্ফোরণ। টেলিভিশনে সেই খবর দেখালেও পাতায়ার পরিবেশ তাতে মোটেই বিঘ্নিত নয়। আহত আর মৃতের সংখ্যাটা সময়ের সাথে সাথে বাড়ছে ব্যাংককে। তবে কি এই মেয়েটির কেউ আহত হয়েছে এই বিস্ফোরণে? তখনও আলাপ হয়নি পেনচান’র সঙ্গে।
ঝলমলে পোশাক, চোখে মাস্করা, গালে হালকা গোলাপি রুজ, ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক। প্রথম ঝলকে নিজেকে সুন্দরী দেখাতে যা যা প্রয়োজন।
একটি পানীয় হাতে আমি। প্রশ্ন করলাম, তোমার পরিচিত কেউ আহত হয়েছে ওই বিস্ফোরণে? নাকি তোমার কেউ বিস্ফোরণ এলাকার কাছাকাছি বাস করেন? মেয়েটি জানালো, না তার পরিচিত কেউ আহত হননি বা বিস্ফোরণ স্থানের কাছাকাছিও কেউ নেই। সে চিন্তিত, এরকম হতে চললে দেশে টুরিস্ট আসা কমে যাবে। এতে কম হবে তার রোজগারও।
মেয়েটি বলল, আপনার ম্যাসাজের প্রয়োজন? আমি খুব ভালো ম্যাসাজ করি। যাকে বলে ফুল স্যাটিসফেকশন। তার টুকরো ইংরেজি শুনে আমার বাকিটুকু বুঝে নিতে অসুবিধা হোলো না। অবশ্য পরে জেনেছি, সারা পাতায়ায় এমন তরুণীদের সবারই দাবিটা একইরকম।
মনে মনে দু-পা পিছিয়ে এলাম। মাছ ভাতের বাঙালি, মুখে মুখে বিশ্বজয় করে ফেলতে পারে সহজেই। কিন্তু বিদেশ বিভূঁইয়ে জনৈকা এসকর্ট’র সঙ্গে গল্প জোড়ার সাহস জোগাড় করাটা বেশ কঠিনই মনে হোল।
মনে পরে গেল সোনাগাছির কথা। যেটা শুধু কলকাতার বিখ্যাত পতিতা পল্লীই নয়, এশিয়া মহাদেশেরও সর্ববৃহৎ। সাধারণত কলকাতার মধ্যবিত্ত ভদ্রজন যেসব নামের রাস্তার কথা উচ্চারণ পর্যন্ত কিঞ্চিৎ নিচু স্বরে করেন। এই জায়গা গুলির সাথে জুড়ে থাকে কিছুটা ঘৃণা, কিছুটা অচেনা অজানা ভয় আর মধ্যবিত্ত উন্নাসিকতা।
আর সমাজ তাদের দূরে সরিয়ে রাখার ফলেই ভারতের লোকসভা নির্বাচনের আগে কলকাতার এই পতিতা পল্লির নারীরা ঘোষণা করেন তারা তাদের সমস্ত ভোট নোটা বা না ভোট এ দেবেন। এই খবর সংগ্রহ করতে গিয়েই এই প্রান্তিক নারীদের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। এরপর এদের পরিচালিত দুর্গা পূজার নিমন্ত্রণ পেয়েছি। গেছিও সেখানে। পাত পেড়ে খিচুড়ি খেয়ে এসেছি। আর সেই প্রথম পরিচয়ের পর থেকেই ভাঙতে থাকে এই নারীদের সম্পর্কে আজন্ম লালিত বেশিরভাগ ধারণা। ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয় এদের যন্ত্রণার চিত্র। চূড়ান্ত অসাম্যের সমাজের অন্যান্য প্রান্তিক মানুষের মতোই এরা বৈষম্য, অবিচার আর লাঞ্ছনার শিকার।
কলকাতার পতিতা পল্লীর একটি মেয়ের সঙ্গে পাতায়ার এই মেয়েটির কতটা মিল!
সাহস করে মেয়েটিকে প্রশ্ন করলাম, তুমি কতদূর পড়াশুনা করেছ? উত্তর দিলো না মেয়েটি। উল্টে আমাকে প্রশ্ন করল, তুমি কি কোনদেশ থেকে এসেছ?
ভারতীয়। জানালাম আমি। আমাকে পুরোপুরি অবাক করে দিয়ে সে পরের প্রশ্ন করল, তুমি কি লেখক না শুধু ঘোরার জন্য? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে দেরীই হলো আমার। ততক্ষণে মেয়েটি আরও অবাক করে জোরেজোরে হেসে উঠল। সে বুঝতে পেরেছে আমি কিছুটা অস্বস্তিতে পড়েছি। ভেবে কুলকিনারা পাচ্ছিনা কি বলতে চায় ও। এরই মধ্য হঠাৎ করে মেয়েটি আমার পকেটে রাখা কলমটি তুলে নিয়ে বলল, পাতায়ায় ঘুরতে এসে কেউ পকেটে কলম নিয়ে ঘুরে বেড়ালে অন্য কিছু মনে হবার কারণ আছে কি?
কিছুটা থতমত খেয়ে বেড়িয়ে যাব বলে কলমটি ফেরত চাইতে হাত বাড়ালাম। মেয়েটি হাত মিলিয়ে বলল, ‘আমার নাম পেন চান। তোমার কলমটা আমি রেখে দিলাম। কোন আপত্তি নেই তো?’
আপত্তি থাকার কোন কারণ ছিল না। ভারতে আমার পাড়ার দোকান থেকে কেনা সামান্য একটা কলম যদি কেউ তার কাছে রাখতে চায় তাতে আপত্তি কিসের!
দোকান থেকে বেড়িয়ে আসছি, মেয়েটি বেশ জোরে বলল, আমার সঙ্গে সময় কাটাতে চাও, তবে আড়াই হাজার বাথ নিয়ে রাতে চলে এসো আমি এখানেই থাকবো। হোটেলে ফেরার পথে বারবার মনে হচ্ছিল- কেমন হয় এই মেয়ে গুলির জীবন?
আইলার ঝড়ে নদীর গর্ভে বাড়ি ডুবে যাওয়া সুন্দরবনের মালতী, বিহার থেকে স্বামী পরিত্যক্তা আদিবাসী জুমলা, কিংবা নিজের পঙ্গু স্বামী আর সন্তানকে বাঁচাতে পতিতাবৃত্তিতে নামা আফসানার জীবন আমি কলকাতার সোনাগাছিতে দেখেছি। কিন্তু কতটা পার্থক্য কলকাতার মালতীদের সঙ্গে পেন চানের?
পাতায়া-এর রাত একদম উদ্দাম, একেবারে ঝলমলে। ওয়াকিং স্ট্রিটের দুই ধারে রেস্টুরেন্ট, বার, ডিস্কো সবই খোলা থাকে প্রায় ভোর পাঁচটা অব্দি।
ভ্রমণ সঙ্গীদের না জানিয়েই রাত বাড়তে হাজির হলাম সেই ওয়াইন শপে। সেটি তখনও খোলা। দোকানী ছেলেটি আমাকে দেখে হাত তুলে অপেক্ষা করতে বলল। সে জানতে চাইল আমি পেন চেন কে খুঁজছি কিনা। বুজতে অসুবিধা হলো না যে দোকানি ছেলেটি আসলে পেন চেনের দালাল। ফোন করতেই হাজির পেন চেন। রাতে সে আরও মোহময়ী সাজে সাজিয়েছে নিজেকে।
আমাকে দেখেই সে বলে উঠল, বল লেখক, কোন হোটেলে যেতে হবে। তবে দু হাজার বাথের কম কিন্তু নেব না। আমি জানালাম আমি তার সম্পর্কে জানতে চাই, আর কিছু চাই না। এবার বেশ কড়া গলায় কাটাকাটা ইংরেজিতে পেন চেন জানাল, দুহাজারের কম অর্থে তার কিছুই করা সম্ভব নয়। আরও বলল, রাতই তার ব্যবসার সময়, হাতে নষ্ট করার মত সময় নেই।
এক হাজার বাথের বেশি আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। পরিষ্কার জানিয়ে দিলাম তাকে। অবশেষে রাজি হল পেন চেন। ‘পয়েন্ট ৭২’ নামের একটি রেস্তঁরায় প্রবেশ করলাম আমরা। মোট ১৫০ পুরুষের শয্যাসঙ্গিনী হয়েছে এই ২৩ বছরের মেয়েটি। তার মধ্যে এক জন ভারতীয়। বেশিরভাগই তার কপালে জুটেছে আফ্রিকান ও ইউরোপীয়।
কিন্তু কেন এই পেশায়? স্বেচ্ছায় নাকি কেউ জোর করে নামিয়েছে তাকে। পানিয়র গ্লাসে লম্বা চুমুক মেরে পেন চেন জানাল, ১০ ক্লাস পর্যন্ত পড়াশুনা করেছে। তার পর কাজ নেই, বাড়িতে বুড়ো বাবা, অসুস্থ মা, আরও তিন ভাই বোন আছে। এই যোগ্যতায় পেট চালাতে তার আর কোন কাজ করা সম্ভব নয়। ইচ্ছে ছিল অভিনেত্রী হবার।
কেন অন্য কাজও তো করা যেত? পেন চেন জানাল, থাইল্যান্ডে জীবন যাত্রার যা মান, তাতে যে টাকার প্রয়োজন সেটা সে অন্য কাজ করে পেত না। প্রথমে সাহস না পেলেও তার এক বান্ধবী এই কাজে সাহস যুগিয়েছে।
কথাটা অতি বাস্তব। এখানে জিনিষপত্রের যা দাম সেখানে জীবন চালান বেশ কষ্টকর। মুদ্রাস্ফীতি একটা বড় সমস্যা থাইল্যান্ডে। পেন চেনের রুটি-রুজি নির্ভর করে পর্যটকদের উপরেই। তবে তার একটা চাপা রাগ আছে এই পর্যটকদের উপরে। তাদের জন্যই নাকি পাতায়া শহরে জিনিষের এত দাম। এ এক অদ্ভুত বৈপরীত্য।
‘তোমার দেশে বুদ্ধ জন্মেছিলেন, আমি জানি। ’ আমার খুব দেশবিদেশ বেড়াবার শখ। ইচ্ছা আছে একবার ইন্ডিয়াতে যাবার। জানিনা কোন দিন পারবো কিনা। শুনেছি তোমার দেশে তাজমহলে সুন্দর চাঁদের আলো পরে স্বর্গীয় চেহারা নেয়। থামল পেন চেন। তার পরেই আবার বলে উঠলো, জানো আমার নামের মানে কি? উত্তরের অপেক্ষা না করেই সে জানাল থাই ভাষায় পেন চেন শব্দের মানে পূর্ণ চন্দ্র।
হায়রে অসাম্যের সমাজ! যে বয়সে সত্যি পূর্ণিমার চাদের মত উজ্জ্বল হওয়া উচিৎ ছিল এই কন্যার জীবন তখন পেটে জ্বালা নেবাতে এই কন্যাকে শয্যাসঙ্গিনী হতে হয়েছে ১৫০ পুরুষের। এ লজ্জা রাখব কোথায়? রাত গভীর। আর কিছুক্ষণ বাদেই সূর্য্য উঠবে। আমার সঙ্গীদের ঘুম থেকে জাগার সময় হয়ে এসেছে। পেন চেনের হাতে হাজার বাথ দিয়ে আমি বিদায় নিলাম।
রেস্তরাঁ থেকে রাস্তায় নেমে এসেছি। রাস্তায় তখন লোক অনেক কম। আমি এগিয়ে যেতেই পিছন থেকে ডাক দিল পেন চেন। দাঁড়াও আমি তোমাকে হোটেল পর্যন্ত এগিয়ে দিচ্ছি। এই সময় বিদেশিদের একা চলাফেরা নিরাপদ নয়। কিন্তু এত রাতে তুমি কি নিরাপদ? পেন চেন জানাল, সে বিপদের মধ্যেই থাকে তাই সে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ। হাত নেড়ে বিদায় নিয়ে হোটেলে ঢুকছি। পিছু ডাকল পেন চেন, লেখক, তোমার নামটাই জানা হল না! নাম জানিয়ে, আমি বললাম আমি লেখক নই। তোমাদেরই একজন।
পেন চেন বলল তুমি আমার প্রথম খরিদ্দার, যে আমাকে এমিনি এমনি অর্থ দিলো।
কবে পাতায়ার পেন চেন আর কলকাতার পূর্ণিমারা সত্যি খোলা আকাশ পাবে, জানিনা আর কতদিন এই তীব্র অসাম্যের সামাজিক কাঠামোর বলি হবে লক্ষ লক্ষ নারী। তবে বিশ্বাস একদিন আঁধারের বুক চিরে আসবে সূর্যের আলো। সেদিন মুক্তি পাবে কলকাতার সোনাগাছির হাড়কাটা গলির পূর্ণিমা থেকে পাতায়ার পেন চেন।
তখন সূর্য উঠেছে পাতায়ার আকাশে। বাংলাদেশের আকাশেও আর একটু বাদে সূর্য উঠবে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে হিসেব করলাম, সূর্য উঠে গেছে ভারতেও আকাশেও। একদিন এই সূর্যের আলোতেই ধুয়ে মুছে যাবে গোটা পৃথিবীর অন্ধকার। এই বিশ্বাস নিয়েই পরের দিন পাতায়া থেকে রওনা দিলাম ব্যাংককের পথে।
বাংলাদেশ সময়: ১০২০ ঘণ্টা, ৩০ আগস্ট , ২০১৫
ভিএস/এমএমকে