ব্যাংকক (থাইল্যান্ড) থেকে: অচেনা শহর, অচেনা মানুষ। তার ওপর থাই ভাষাভাষি লোকদের ইংরেজি জ্ঞান এতোই সামান্য যে, যৎসামান্য ইংরেজি জানা নিজেকে ‘পণ্ডিত’ ভাবছি।
প্রায় ৫-৬শ’ শব্দের সংবাদও মুহূর্তে লিখে ফেলতে মোবাইলই সঙ্গ দিচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সেই গুরুত্বপূর্ণ এই সঙ্গী যদি হারিয়ে যায়, তখন হা-হুতাশ করা ছাড়া আর কি উপায় থাকে!
কিন্তু পর্যটনবান্ধব থাইল্যান্ডের রাজধানীতে এসে সে হা-হুতাশের হাত থেকে তো বাঁচিয়েছেই। নতুন মোবাইল কেনার অর্থদণ্ডও যেন মওকুফ করে দিয়েছে।
স্বামী এএসএম আতিকের সঙ্গে থাইল্যান্ড সফরে এসেছি। বুধবার (০৯ ডিসেম্বর) স্থানীয় সময় রাত নটা। স্কাইট্রেনে হাজির হলাম হোমপ্রো ব্র্যান্ডের একটি শো’রুমে। ভাগ্য মন্দ, যাওয়ার আগেই শাটার নেমে গেছে মার্কেটটির। শপিংয়ের সুযোগ না পেয়ে দিনের ক্লান্তি আরো ভর করে বসল। রাত বাড়ছে, ফিরতে হবে সুকুম্ভিত ৬৩ এলাকায়।
অনেক অপেক্ষার পর লাল বাতি (খালি থাকার চিহ্ন) দেখে ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে উঠে পড়তেই ভাড়া চাইলেন দুইশ’ বাথ। এর আগে মিটারে চলে ভাড়া সম্পর্কে যে আন্দাজ হয়েছে, তাতে কাঙ্খিত দূরত্বের ভাড়া সর্বোচ্চ ৬০-৬৫ বাথ হওয়ার কথা। সঙ্গে সঙ্গে নেমে পড়লাম। কিন্তু কোন ফাঁকে হাত থেকে মোবাইলটা সিটের ওপর রেখেছিলাম মনে নেই। ট্যাক্সিটা আমাদেরকে ফেলে চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই মোবাইলের খোঁজ পড়ে। বুঝলাম যা ঘটার ঘটে গেছে। দু’চোখে অন্ধকার দেখার মতো অবস্থা হলেও মুহূর্তের মধ্যে শান্ত করলাম নিজেকে আর সঙ্গীকেও।
পরিস্থিতি এমন যে, মোবাইল ছাড়া গন্তব্যের নামও বলতে পারবো না আমরা। কারণ, সবকিছু মোবাইলেই সংগ্রহ করা ছিল।
একটু এগিয়ে দেখা মিলল একজন ফুটপাত ব্যবসায়ীর সঙ্গে। মেয়েদের হ্যান্ডব্যাগ আর কিছু কসমেটিকসের পসরা নিয়ে বসে রাতের খাবার খাচ্ছিলেন তিনি। তাদের ইংরেজি বোঝার ক্ষমতার কথা মনে রেখে শেষ আশা হিসেবে তাকে মোবাইল হারানোর কথা বোঝানোর চেষ্টা করলাম। আমাদের অবাক করে দিয়ে সুন্দর উচ্চারণে ইংরেজিতে মোবাইল ফেরত পাওয়ার বিষয়ে আমাদের আশ্বস্ত করলেন তিনি।
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কর্মচারীকে বললেন, আমাদের নম্বরে ফোন করতে। এয়ারপোর্ট থেকে সিম কেনার রশিদটি তখন পকেটেই ছিল। সেখান থেকে নম্বর নিয়ে খানিকটা আশা-নিরাশার দোলাচলে থেকে কল দিতেই একজন নারী ফোনটি রিসিভ করলেন। ওই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে সুকণ্ঠী নারী মনে হলে তাকে। ভাঙা ইংরেজিতে তিনি আতিককে বোঝালেন, যাত্রী হিসেবে ওই ট্যাক্সিতে উঠেই তিনি আমাদের ফোনটি পেয়েছেন। সেটা ফেরতও দিতে চান। কিন্তু এই মুহূর্তে সেটা সম্ভব নয়। কারণ, গন্তব্যে ফিরছেন তিনি। সেখান থেকে ফেরত আসতে পারবেন না। বরং অন্য কোনো সময়ে যেন আমরা ফোনটা সংগ্রহ করি।
রাতের সঙ্গে এবার হতাশাও বাড়ছে। এগিয়ে এলেন ফুটপাত দোকানদার দোদো। নিজেই ওই নম্বরে আবার কল করে ভদ্রমহিলার কাছ থেকে ট্যাক্সির নম্বর সংগ্রহ করে এবার ড্রাইভারকে চাইলেন।
ড্রাইভারকে স্থানটির বর্ণনা দিয়ে বললেন, মহিলাকে নামিয়ে দিয়ে যেন ওখানেই সে চলে আসে। আসার খরচ তাকে দেওয়া হবে। এবার ফোন রেখে দোদো এগিয়ে এলেন আমাদের কাছে। ‘টেনশন করো না, ফোন ফেরত পাবে’ জাতীয় কথা বলার পাশাপাশি আমাদেরকে নানা কথায় ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করলেন।
পরামর্শ দিলেন, ‘যে ট্যাক্সিতেই ওঠো না কেন, ভেতরে লেখা ট্যাক্সি নম্বরটি টুকে রাখবে। তাহলেই অার সমস্যা নেই’।
সাধারণ এই কথাটা যে জানি না, তা নয়। তবু মনোমুগ্ধ শ্রোতার মতো শুনছিলাম তার কথা।
রাত আরো বাড়ছে। অপেক্ষাও দীর্ঘায়িত হচ্ছে। ব্যাংককের রাস্তায় গাড়ি চলাচল কমে আসছে। কিছুটা ভয় যে লাগছিল না, তাও নয়। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সুঠামদেহী দোদো এবং তার কর্মচারীটি আরো লোকজন ডেকে আমাদের বিপদে ফেলার চেষ্টা করছেন নাতো! এমন ভয় ধীরে ধীরে গ্রাস করছিল আমাদের। কিন্তু দু’জনে দু’জনকে সাহস দিয়ে চলছিলাম। পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে কি-না জানি না- এবার নিজের সম্পর্কে বলতে শুরু করলেন দীর্ঘদিন সিঙ্গাপুরে চাকরি করে আসা দোদো। সেখানে অনেক বাংলাদেশি তার বন্ধু ছিলেন বলেও জানান।
হাতের আইফোনে দেখালেন নিজের দুই সন্তান ও স্ত্রীর ছবি। সঙ্গে নিজের বিএমডব্লিউ কার, একটি টয়োটা মিনি ট্রাক, ফ্ল্যাট আর অপরুপ সুন্দর তার নিজের গ্রামের বাড়ি। সঙ্গে আরো নানা পরামর্শ। নিজের খাওয়া বন্ধ রেখে আমাদেরকে তার আতিথেয়তা গ্রহণের প্রস্তাবও দিলেন।
এবার তার আন্তরিকতা দেখে সন্দেহ দূর না করে পারলাম না। অপেক্ষার সময় ঘণ্টারও বেশি পেরিয়ে গেছে। এর মধ্যে ড্রাইভারকে দুইবার ফোনও দিয়েছেন দোদো। আমাদেরকে তার অবস্থানের আপডেট জানিয়ে বললেন, ‘ড্রাইভারের ট্যাক্সি নম্বর নিয়েছি, সুতরাং কোনো চিন্তা নেই। সে মোবাইল নিয়ে ফেরত না এলেও এ নম্বর দেখে পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে আসবে। ব্যাংককে চলার সময় যে ট্যাক্সিতেই ওঠো না কেন, নম্বরটি টুকে নেবে। তাহলেই অনেক সমস্যা মিটে যাবে’।
কেটে গেলো আরো আধা ঘণ্টা। ড্রাইভারকে কল করে উঠে দাঁড়ালেন দোদো। সামনে তাকাতেই দেখলাম, গাঢ় আকাশি রঙের সেই কাঙ্খিত ট্যাক্সি। ভেতর থেকে হাসিমুখে মোবাইলটি এগিয়ে দিলেন ড্রাইভার। সেটি নিয়ে দৌঁড়ে এসে আমাদের হাতে তুলে দিয়ে ড্রাইভারকে দুইশ’ বাথ দিতে বললেন দোদো। সঙ্গে তার কর্মচারীটিকে (যার ফোন থেকে শুরুতে ড্রাইভারকে ফোন দিয়েছিলাম) সামান্য বখশিশ। নিজেরা খুশি হয়ে তাই করলাম।
খুশি করতে চাইলাম দোদোকেও। কিন্তু তার একই কথা। ‘আমার কিছু চাই না, আমি তোমাদেরকে সাহায্য করতে পেরেই খুশি’।
তখন রাত এগারটা। ফিরতে হবে। বিদায় দিলেন সাহায্যকারী দোদো। ফিরলাম সেই ট্যাক্সিতেই, আরো দুইশ’ বাথ ভাড়া দিয়ে। দুইশ’ বাথ ভাড়ার ঘটনা নিয়ে, শেষ হল তার তিনগুণ খরচ করে। তবু শেষমেষ কোনো অতৃপ্তি ছিল না।
ফেরার পথে ঢাকায় নিজের কয়েকটি মোবাইল হারানোর স্মৃতি নাড়াচাড়া করে দেখছিলাম। না, নিজের দেশে কোনো দোদোর দেখা অামি পাইনি। মেলেনি কোন সুকন্ঠী নারী, কিংবা ড্রাইভার থাওয়াচাইয়ের সাক্ষাতও।
থাইল্যান্ডের প্রতিটি ট্যাক্সির ভেতরে সিটের ডানে-বায়ে হলুদ রঙে ট্যাক্সি নম্বর লেখা অাছে। ট্যাক্সিতে উঠেই এ নম্বরটা মনে রাখলে বা টুকে রাখলে এ ধরনের নানা সমস্যার সমাধান হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১২৪৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৩, ২০১৫
জেপি/এএসআর
** সততা আর পরিশ্রম সফল করেছে যাদের
** থাইল্যান্ড থেকে জেসমিন পাপড়ি
** থাই রাজার জন্য বাংলাদেশের প্রার্থনা
** রাজার জন্য যতো ভালোবাসা!
** থাইল্যান্ডে বাংলাদেশিদের ‘শক্তি’
** রেন্টে বাইক!
** গাড়ির হর্নবিহীন শহর
** সময়ানুবর্তী রিজেন্ট এয়ার
** কলম দেখলেই এগিয়ে আসেন তারা!