বিকেএসপি থেকে ফিরে: দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত, দিগন্ত বিস্তৃত নীল সমুদ্র, আকাশছোঁয়া পাহাড়, বৌদ্ধ মন্দির আরো নানা আকর্ষণ নিয়ে বাংলাদেশের মানচিত্রের শেষ প্রান্তে বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে এদেশের পর্যটন নগরী কক্সবাজার। আর এখান থেকেই সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে, আকাশছোঁয়ার স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি) এসেছেন সাইফ সামশুদ।
হিমছড়ির জলপ্রপাত আর ইনানী সমুদ্র সৈকতে বন্ধুদের সাথে দাপিয়ে বেড়ানো সাইফ বিকেএসপিতে ভর্তি হয়েছেন ফুটবলের টানে, ফুটবলকে ভালোবেসে। তবে, এজন্য মায়ের অবদানকে খাটো করেননি তিনি। তরুণ এ ফুটবলার জানালেন, ‘আমার আব্বু নেই। আম্মুর অনুপ্রেরণাতেই আমি বিকেএসপিতে ভর্তি হই। কক্সবাজারে নিয়মিত ফুটবল খেলতাম। চট্টগ্রামেও কিশোর লিগ খেলেছি। ফুটবলের প্রতি আমার ভালোবাসা দেখে আম্মু আমাকে এখানে ভর্তি হতে উৎসাহ দেন। তার ইচ্ছাতেই আমি বিকেএসপিতে পরীক্ষা দেই। আম্মুর স্বপ্নপূরণ করতে বড় ফুটবলার হতে চাই। ’
বিকেএসপি থেকে ছুটি মিললেই মায়ের কোলে ফিরে যান সাইফ। মায়ের পাশাপাশি বড় ভাইদের আদরও মেলে তার। ছোট বোনকে স্নেহের পরশ বুলিয়ে দিয়ে ছুটি শেষে আবারো সবুজে ঘেরা প্রতিষ্ঠানটির বুকে ফিরে আসেন তিনি। যেখানে সার্বক্ষণিক তার পাশে থাকেন বিকেএসপির কোচরা। তারাই তখন হয়ে ওঠেন সাইফের বাবা-মা।
এখানে কোচদের সহায়তা কেমন, জিজ্ঞেস করতেই সাইফের উত্তর, ‘এখানের স্যাররা (কোচরা) আমাদের যেভাবে সহায়তা করেন, তা বাইরে কোথাও পাবেন না। তারা সব সময় আমাদের পাশে থাকেন। আমি অনূর্ধ্ব-১৪, ১৬, ১৯ দলে খেলেছি। এমনকি কিছুদিন আগে জাতীয় দলের বিপক্ষে একটি প্রস্তুতি ম্যাচও খেলেছি। এগুলো স্যারদের কল্যাণে পেরেছি। তাদের অনেক অবদান রয়েছে। স্যাররা যেভাবে আমাকে উৎসাহ দেন, তাতে আমার আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। তারা বলেন, আমার ফিজিক্যাল দিকটি ফুটবলের জন্য ভালো। তাদের কথাতেই আমার আত্মবিশ্বাসকে বাড়িয়ে নিতে পারি। তাদের দেওয়া শিক্ষাগুলো নিজের মাঝে লালন করি। আমাদের ভুলগুলো খুব সহজেই তারা শুধরে দেন। কী করলে নিজের খেলায় আরও উন্নতি আসবে, সেগুলো আমি স্যারদের কাছ থেকে বুঝে নেই। এজন্য কখনই তারা বিরক্ত হন না। ’
ফুটবল ম্যাচে সবাই চায় গোল করতে। যিনি গোল করেন তিনিই থাকেন সবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। একজন মিডফিল্ডার কিংবা একজন ডিফেন্ডার দলের জন্য সব সময় গোল করতে পারেন না। তাই স্বাভাবিকভাবেই একজন স্ট্রাইকারের দিকে ফোকাসটা বেশি থাকে। তাহলে কি ফুটবলের মাঠে নিজের দিকে ফোকাসটা ধরে রাখতে আপনি স্ট্রাইকিং পজিশন বেছে নিয়েছেন? এমন প্রশ্নে সাইফ বলেন, ‘মোটেই এমন কিছু ভেবে আমি পজিশন ঠিক করিনি। আর একটা ম্যাচে শুধু স্ট্রাইকাররা খেললেই সে ম্যাচ জেতা সম্ভব নয়। আপনি যত বড় স্ট্রাইকারই হন না কেন, মিডফিল্ডার আপনাকে বলের যোগান না দিলে আপনি ব্যর্থ। ডিফেন্ডাররা তাদের কাজটা সঠিকভাবে না করলেও আপনি ব্যর্থ। তবে, প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডার, গোলরক্ষক যখন আমাকে নিয়ে চিন্তা করে, আলোচনা করে, তখন আমার ভালো লাগে। এটা থেকে আমি আরও ভালো করার উৎসাহ পাই। ’
‘একজন স্ট্রাইকার হতে হলে আপনাকে অবশ্যই গতিশীল হতে হবে। শুটিং পাওয়ার থাকতে হবে, বল রিসিভিংয়ে ভালো দক্ষতা রাখতে হবে। সঙ্গে নিজের স্কিলটাকেও বাড়িয়ে নিতে হবে। তাহলেই না লোকে আপনাকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রাখবে’, যোগ করেন সাইফ।
তরুণ এ ফুটবলার জানান, ফুটবল স্ট্রাইকিংয়ে দক্ষতা বাড়াতে হলে সব সময় মাঠে অন্য সতীর্থদের সঙ্গে ভালো বোঝাপড়া দরকার। তাদের সহায়তায় স্ট্রাইকাররা স্কোর করেন। নিজের গতি ঠিক রাখা দরকার। স্কিলড ফুটবলের অংশ হিসেবে আরও দরকার নিজের মনোযোগ ধরে রাখা।
ক্রিকেটে খ্যাতি ছাপিয়ে যাওয়া দেশে কেন ফুটবলকে বেছে নিলেন- এমন প্রশ্নের উত্তরে সাইফ বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে আমি ফুটবল পছন্দ করতাম। ক্রিকেটকেও বেছে নিতে পারতাম। কিন্তু, আম্মুর জন্যই আমি ফুটবলে। তার অনুপ্রেরণাতেই ফুটবলের প্রতি আমার ঝোঁকটা বেড়ে যায়। ক্রিকেটকে কখনো সেভাবে ভাবিনি। আমার প্রথম এবং শেষ ইচ্ছা বড় ফুটবলার হওয়া। ক্রিকেটকে আমি বেছে নেইনি কারণ, আগে থেকেই আমার ধ্যান-জ্ঞানে ফুটবল মিশে আছে। ’
সাইফের রক্তে ফুটবলের নেশা কী করে এলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বাড়ির পাশে খালি পায়ে খেলতাম। কক্সবাজারে যখন লেখাপড়া করতাম সেখান থেকে আম্মু আমাকে চিটাগাং নিয়ে যান। সেখানেও আমি খেলেছি। চট্টগ্রামে কিশোর লিগ ফুটবলে অংশ নিয়েছি। সেখানে মুসা স্যার আমার খেলা দেখে উৎসাহ দেন। স্যার আমাকে বিকেএসপিতে ভর্তি হওয়ার উপদেশ দেন। আমাদের এলাকার একজন বড় ভাই (সাইফুদ্দিন ভাই) বিকেএসপির ছাত্র ছিলেন। তার মাধ্যমে বিকেএসপিতে ভর্তির তথ্যগুলো জানতে পারি। তাছাড়া এলাকার অনেক বড় ভাইরা, বন্ধুরা আমাকে উৎসাহ দিয়ে গেছে। ’
দেশি ফুটবল তারকাদের মাঝে জাহিদ হাসানের খেলা সাইফের পছন্দের তালিকায় এক নম্বরে। আর দেশের বাইরে পর্তুগিজ তারকা স্ট্রাইকার রিয়াল মাদ্রিদের ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে এগিয়ে রাখলেন তার তালিকায়।
‘আমি রিয়েলৈ মাদ্রিদ আর ব্রাজিলের সাপোর্টার। তবে, মেসি-নেইমার-রোনালদো তিনজনের খেলাই ভালো লাগে। রোনালদোর মতো আমিও গতিসম্পন্ন ফুটবলে বিশ্বাসী। তার মতো আমিও গতি দিয়ে খেলতে চাই’, বলেন প্রতিশ্রুতিশীল এই ফুটবলার।
দেশের ফুটবলের নক্ষত্র ধরা হয় এমিলি, হাসান আল মামুন, মাসুদ রানাদের। দেশসেরা এ ফুটবলাররা ছিলেন এই বিকেএসপির ছাত্র। এখানকার কোচদের হাতেই তারা তৈরি। কোচদের হাত ধরেই তারা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তারকাখ্যাতি পেয়েছেন। অভিজ্ঞ কোচদের প্রত্যাশা মেটাতে উঠতি তারকা সাইফ কী করবেন জিজ্ঞেস করলে তার উত্তর, ‘আমি সব সময় চেষ্টা করে যাব কোচদের প্রত্যাশা মেটাতে। বিকেএসপিতে তারা যে ডিসিপ্লিন আমাদের মধ্যে দেন সেগুলো আজীবন নিজের ভেতরে রাখব। এখানে শিবু স্যার আছেন, মাসুদ স্যার আছেন, আরও অনেকেই আছেন। তাদের কাছে আমার সমস্যাগুলো সম্পর্কে জানতে পারি, দুর্বলতাগুলো বুঝে নিতে পারি। নিজের উন্নতির জন্য স্যারদের পরামর্শ মেনে কাজ করব। ’
বিকেএসপির নিয়ম-কানুন কষ্টকর কি না, এমন প্রশ্নে অবাক হননি সাইফ। উল্টো প্রশ্ন ছুড়ে দেন, ‘আমাকে পরবর্তীতেও যে জিনিসটা সহায়তা করবে, সেটা কেনো কষ্টকর হবে? এখান থেকে বের হয়ে আমি যেখানেই যাই না কেন, তখন নিজেকে অনেকটা মুক্ত মনে হতে পারে। কিন্তু, মাঠে বা মাঠের বাইরে একটা অন্যায় করতে গেলেই বিকেএসপির কথা মনে পড়বে। তখন ভাববো এখানে যেটা করিনি, সেটা তো নিজের মঙ্গলের জন্য করিনি। তাহলে বাইরে কেনো আমি সে অন্যায়টা করব? বিকেএসপি তো আমাকে সেই শিক্ষা দেয়নি। ’
বাংলাদেশের বিশ্বকাপ ফুটবলের স্বপ্নটা এখনও বাছাইপর্বের সাফল্য কেন্দ্রিক। ফুটবল নিয়ে লাল-সবুজদের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আশা আর প্রাপ্তি যেন একে অন্যের প্রতিপক্ষ। তবে, চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞা নিয়ে, নিজের স্বপ্নকে পূরণ করতে আর মায়ের অনুপ্রেরণাকে কাজে লাগিয়ে সাইফ চান দেশসেরা ফুটবলারদের একজন হতে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও চান লাল-সবুজকে এগিয়ে নিতে। আর সাইফের মতো তরুণ ফুটবলারদের জ্বালানির জোগান দিয়ে চলেছে বিকেএসপি। খেলোয়াড় তৈরির সূতিকাগার যেমন প্রস্তুত, তেমনি প্রস্তুত সাইফরাও।
বাংলাদেশ সময়: ১২৫০ ঘণ্টা, ১৭ অক্টোবর ২০১৫
এমআর/এমজেএফ
** বিকেএসপি’তে আরও জনবল প্রয়োজন
** দেশসেরা খেলোয়াড়রা বিকেএসপি’র আবিষ্কার
** গতিশীল হচ্ছে বিকেএসপি’র আঞ্চলিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র
** এগিয়ে যাচ্ছে বিকেএসপি