বিকেএসপি থেকে ফিরে: ক্রীড়াবিদ, জাতীয় কোচ, সংগঠক, ম্যাচ রেফারি, প্রশাসনিক কর্মকর্তা এমন বহুমুখী গুনে গুনান্বিত শামীমা সাত্তার মিমু। খেলোয়াড়ী জীবন শেষ হলেও থেমে যায়নি ক্রীড়াঙ্গনে তার পথচলা।
প্রতিদিন দাপ্তরিক কাজ শেষে ট্র্যাকসুট পড়ে হাজির হয়ে যান খেলার মাঠে। নবীন ক্রীড়াবিদদের শেখান নানা কৌশল। খেলাধুলার সঙ্গে শামীমার সখ্যতা ছোটবেলা থেকেই। তার অ্যাথলেট জীবনে রয়েছে নানা সাফল্যের গল্প। হাই জাম্প, লং জাম্পসহ ৮০০, ৪০০ ও ১০০ মিটার রিলে দৌড়ে ১৬ বছরের ক্যারিয়ারে পেয়েছেন ২২টি স্বর্ণপদক। ক্রীড়াক্ষেত্রে তার অবদানের স্বীকৃতিস্বরুপ জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারসহ পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার।
১৭ বছর বয়সে দশম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় আব্দুস সাত্তারকে বিয়ে করেন শামীমা। বিয়ের পরও খেলাধুলা থামিয়ে দেননি তিনি। স্বামীর উৎসাহে পাড়ি দিয়েছেন আরও পথ। খেলাধুলার পাশাপাশি চালিয়ে গেছেন পড়াশুনাও। ১৯৯২ সালে ৩৩ বছর বয়সে স্বর্ণ জিতেই ট্র্যাক ছাড়েন এই সফল অ্যাথলেট। খেলাধুলায় অন্ত:প্রাণ এই মানুষটির খেলোয়াড়ী জীবন, পারিবারিক জীবন, সাংগঠনিক জীবনের সফলতা-প্রতিকূলতার কথা তুলে এনেছে বাংলানিউজ স্পোর্টস টিম।
ছোটবেলা: দিনাজপুরে যে পাড়ায় থাকতাম, ঈদগাঁহ বসতি বলে ওটাকে। পাড়ার মাঠে আমরা মেয়েরা-ছেলেরা একসঙ্গেই খেলতাম। ছেলেরাও আমার সঙ্গে পারত না (হাসি...)। ওখানে একটা খাল ছিল, ওই খালটা আমি ছাড়া কেউ পার হতে পারত না। লাফ দিয়ে খাল পার হতে হতো। খাল পার হওয়ার মধ্য দিয়েই কিন্ত আমার লং-জাম্পের শুরু। দিনাজপুর ঈদগাঁহ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে স্থানীয় বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিই। হাই জাম্প, লং জাম্প আর দৌড়ে স্কুল জীবনেই ভালো করতে শুরু করি।
একাডেমিক জীবন: উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করি দিনাজপুরের কাদের বক্স মেমোরিয়াল কলেজ থেকে। তারপর স্নাতকোত্তর করি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এছাড়া খেলোয়াড়ী জীবন শেষ করে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে ক্রীড়া বিষয়ক ডিগ্রি অর্জন করি।
খেলোয়াড়ী জীবন: ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস কর্পোরেশনের (বিটিএমসি) হয়ে যাত্রা শুরু করি। সেই থেকে প্রায় দীর্ঘ দুই দশক ‘ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে’ আমার একচ্ছত্র দাপট ছিল। নতুন নতুন জাতীয় রেকর্ড, সোনা, রুপা আর ব্রোঞ্জ পদকে বেশ সমৃদ্ধ আমার খেলোয়াড়ী জীবন। ১৯৭৩-৭৪ বাংলাদেশ স্কুল চ্যাম্পিয়ন হবার পর বিটিএমসিতে চাকরী হয়। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯২ এর ২২শে ডিসেম্বর পর্যন্ত বিটিএমসির হয়ে খেলেছি। দক্ষতা ও শিক্ষাগত যোগ্যতার কারণে ওখানকার জেনারেল ম্যানেজার পর্যন্ত হয়েছিলাম।
সাংসারিক জীবন: ১৭ বছর বয়সে আমার বিয়ে হয়। ভেবেছিলাম, হয়তো আর খেলাই হবে না। কিন্তু আমার স্বামীর সহযোগিতায় বিয়ের পর খেলাধুলার পাশাপাশি পড়াশুনাও চালিয়ে গিয়েছি সমানতালে। স্বামী মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সাত্তার ও একমাত্র সন্তান শাহরিয়ার শরিফ ও পুত্রবধূ বনিকে নিয়ে আমার সুখের সংসার।
সাংগঠনিক দক্ষতা: অনেক ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে কাজ করেছি। বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে যুক্ত আছি। এছাড়াও সুলতানা কামাল মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সদস্য, বাংলাদেশ অ্যাথলেটিক্স ফেডারেশনের সদস্য, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের মহিলা কমিটির সদস্য ও বাংলাদেশ সাইক্লিং ফেডারেশনের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি।
কোচিং জীবন: সম্মানের সঙ্গে খেলা শেষ করে ১৯৯২ সালে ভারত থেকে ডিগ্রি নিয়ে আসি অ্যাথলেটিক্সের উপরে। জার্মানিতেও ট্রেনিং করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। ইন্দোনেশিয়া থেকে তিনটা স্পেশাল বিভাগের উপর কোচিং করেছি। এছাড়াও ব্যাংকক থেকে আরচ্যারির উপরে কোচেস ট্রেনিং ও ক্রিকেট কোচিংয়ে ‘ও’ লেভেল সম্পন্ন করেছি। জাতীয় পর্যায়ের খেলায় হ্যান্ডবল ভলিবলের রেফারি ছিলাম। এতকিছু করেছি আসলে জানার জন্য। তবে অ্যাথলেটিক্সে ছিলাম অন্ত:প্রাণ।
এ বিষয়ে তিনি আরও উল্লেখ করেন, ‘১৯৯৪ সালে খেলোয়াড় তৈরীর নেশায় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে অ্যাথলেটিক্স কোচ হিসেবে যোগদান করি। ২০০৪ সাল পর্যন্ত জাতীয় অ্যাথলেটিক্স কোচ হিসেবে অনেক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খেলোয়াড় তৈরী করেছি। বিভিন্ন সময়ে জাতীয় দলের ম্যানেজার ও কোচ হয়ে পাকিস্তান, ব্যাংকক, কোরিয়া, জার্মানি, ইরান, জাপান, উজবেকিস্তান, ভারত, নেপাল, সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়ায় দায়িত্ব পালন করেছি। অ্যাথলেটিক্সের জাম্প ইভেন্টে মহিলা রেফারির দায়িত্বেও ছিলাম। ১৯৯৬ সালে পাকিস্তানে বিশ্ব মহিলা ইসলামী গেমস ও ২০০৪ সালে পাকিস্তানে নবম সাফ গেমসে জাম্প ইভেন্টের বিচারক ছিলাম। ’
জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার: অ্যাথলেটিকসে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০০ সালে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পেয়েছিলাম। সম্মাননা হিসেবে পেয়েছি বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি, বাংলাদেশ ক্রীড়া সাংবাদিক সংস্থার সেরা অ্যাথলেট ও প্রশিক্ষকের পুরস্কার। ক্রীড়াবিদ ও সংগঠক হিসেবে পাই কবি নূরুল আমিন স্বর্ণপদক। অনন্যা শীর্ষ দশ বাংলাদেশ নারী উদ্যোগ কেন্দ্রের স্বর্ণপদকও পেয়েছি আমি।
প্রতিবন্ধকতা: সবচেয়ে অসুবিধা হতো যখন ট্র্যাকসুট পড়ে মাঠে যেতাম, তখন মানুষ বলতো ছেলে না মেয়ে, ভালো বিয়ে হবে না। এসব কথাই শুনতে হতো আমাকে। আল্লাহপাকের ইচ্ছায় ভালো বিয়ে হয়েছে আমার। ভালো চাকরী হয়েছে। কঠোর পরিশ্রম, শৃঙ্খলা, ইচ্ছাশক্তি ও সততার সঙ্গে খেলাধুলা ও পড়াশুনা করলে সাফল্য আসবেই।
আজও মনে পড়ে: প্রথম জাতীয় অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে দিনাজপুর থেকে ঢাকা স্টেডিয়ামে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম) আসি। প্রথমবারেই ১০০ মিটারে রৌপ্য, ২০০ মিটারে ব্রোঞ্জ ও লং জাম্পে রৌপ্য জিতি। এছাড়াও ১০০ মি. রিলেতে রৌপ্য পাই। মোট ৪টি পদক জিতি। পরের দিন প্রতিটি পত্রিকায় ছবি আসে। একটা পত্রিকায় ছবির ক্যাপশন ছিল ‘মিমুর চাই ট্র্যাকসুট, রানিং সু।
এর কারণও ব্যাখা করেন মিমু, ‘তখন যারা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিল তাদের সবার ট্র্যাকসুট ও রানিং সু ছিল। আমার পড়নে ছিল কামিজ, পাজামা। সবচেয়ে বড় কথা, সুলতানা কামালের (শেখ কামালের স্ত্রী) মতো খেলোয়াড় ছিলেন প্রতিযোগী। তখন সুলতানা কামালকে খুকু আপা নামে ডাকতেন পরিচিতজনরা। তিনি নিজে আমাকে অভিনন্দন জানান। জিজ্ঞাসা করেন, আমার বাড়ি কোথায়? তোমার সঙ্গে কে এসেছে? আমি বলি, আমার বোন ও দুলাভাই। তাদের তিনি বলেন, ‘ওর মধ্যে অনেক প্রতিভা আছে। ওকে একটি ট্র্যাকসুট ও রানিং সু কিনে দেন। ও অনেক বড় খেলোয়াড় হবে। ’
সেই খুকু আপাই ছিল মিমুর জীবনের আদর্শ, ‘তিনি সবসময় আমাকে চিঠি লিখতেন এবং নিজের তৈরী করা কার্ড পাঠাতেন। একদিন চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, যেটা আমার জন্য ছিল সবচেয়ে বেশী অনুপ্রেরণার। লং জাম্পে খুকু আপা স্বর্ণ পদক ও আমি রৌপ্য পদক পেয়েছিলাম ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত। লং জাম্পের একটি টেকনিক তিনি পত্রে লিখে দিয়েছিলেন। এজন্য আমি আরও ভালো করতে পারি। দুটো বাঁশ মাটিতে পুঁতে মাঝখানে দড়ি দিয়ে সে দড়ির উপর দিয়ে হাঁস যেমন সাঁতার কাটে তেমন করে সামনে গেলে লং জাম্পে দুরত্ব আরও বাড়ে। পরে জেনেছিলাম, সেটা ছিল লং জাম্পে হিচ কিক টেকনিক। ১৯৭৫ সালে তিনি শহীদ হন। তার সেই উৎসাহ দেওয়া, চিঠি লেখা-এই স্মৃতি এখনো মনে পড়ে। ’
অভিভাবক ও তরুণ খেলোয়াড়দের উদ্দেশ্যে: অভিভাবকদের বলবো, মেয়েদের খেলাধুলায় দিন। তাদের বেড়ে উঠতে দিন নিজের মতো করে। সফল খেলোয়াড় হতে অবশ্যই খেলাধুলার পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনাও এগিয়ে নিতে হবে। খেলাধুলার পাশাপাশি পড়ালেখা করলে জীবনে অনেক উন্নতি করা যায়। তরুণ খেলোয়াড়দের উদ্দেশ্যে বলছি, অনেক বেশি শৃঙ্খল হতে হবে, কোচদের কথা শুনতে হবে। সিলেবাস অনুসরণ করতে হবে। কোচ এবং শিক্ষকরা যে উপদেশমূলক ও গঠনমূলক কথা বলে তা মেনে চললে তোমরা সফল হতে পারবে। আমি কিন্ত এসব মেনে চলেছি বলেই খেলোয়াড়ী জীবন শেষ করে ভালো একটা পদে চাকরি করতে পারছি।
যাদের কাছে কৃতজ্ঞ: জীবনে চলার পথে যাদের সহযোগিতার কথা না বললেই নয়; তারা হলেন আমার মা, ভাই, স্বামী আব্দুস সাত্তার, দুলাভাই আব্দুস সালাম, মোয়াজ্জেম স্যার, ফারুক স্যার ও খন্দকার তারেক মামা। তবে সফলতার পেছনে আমার স্বামী ও বোন-দুলাভাইয়ের অবদানই সবচেয়ে বেশি।
আগামীর স্বপ্ন: স্বপ্ন দেখি, আমার দেশের ছেলে-মেয়েরা অলিম্পিকে পদক ছিনিয়ে আনছে। এটাও হয়তো কখনো পূরণ হবে। সে লক্ষ্যে বিকেএসপি’তে খেলোয়াড় তৈরীর কাজ করে যাচ্ছি।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৩ ঘণ্টা, ২২ অক্টোবর, ২০১৫
এসকে/আরএম
** জাতীয় দলে নিয়মিত খেলতে চান ছন্দা
** সুমনার অনুপ্রেরণার নাম সালমা
** হকিতে হতাশ নন সিফাত
** মায়ের অনুপ্রেরণায় বিকেএসপিতে সাইফ
** বিকেএসপি’তে আরও জনবল প্রয়োজন
** দেশসেরা খেলোয়াড়রা বিকেএসপি’র আবিষ্কার
** গতিশীল হচ্ছে বিকেএসপি’র আঞ্চলিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র
** এগিয়ে যাচ্ছে বিকেএসপি