ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

খেলা

ময়মনসিংহের ক্লাবপাড়ার সমৃদ্ধ ইতিহাসের গল্প 

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪৫ ঘণ্টা, আগস্ট ৮, ২০১৮
ময়মনসিংহের ক্লাবপাড়ার সমৃদ্ধ ইতিহাসের গল্প  ময়মনসিংহের ঐহিতহ্যবাহী ক্রীড়া সংস্থা। ছবি: অনিক খান

ময়মনসিংহ: দেশের প্রাচীন ফুটবল ক্লাবের কথা উঠলেই সবার আগে উচ্চারিত হয় ময়মনসিংহ মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের নাম। ঢাকা মোহামেডানের যাত্রা শুরুর ৩৮ বছর আগে ১৮৯৮ সালে এখানে প্রতিষ্ঠিত হয় ক্লাবটি। ফুটবলের নানা গৌরবময় ইতিহাসের স্বাক্ষী এই ক্লাবটি ক্রিকেট ঐতিহ্যও সুবিশাল।

৮০’র দশকে জাতীয় দলের কৃতি ক্রিকেটার মাহবুবুর রহমান সেলিম কিংবা সদরুল আলমের কথাই ধরুন। তাদের হাতেখড়িও এই ক্লাবেই।

ফুটবলার হাবিবুর রহমান এরও ঠিক ১০ বছর আগে প্রেসিডেন্ট কাপে ইরানের বিপক্ষে গোল করে দেশজুড়ে আলোচিত হয়েছিলেন।

ময়মনসিংহের ক্লাব অঙ্গনে আরেক প্রাচীন ক্লাব হচ্ছে পণ্ডিতপাড়া অ্যাথলেটিকস ক্লাব। ১৯১০ সালে ক্লাবটি প্রতিষ্ঠা করেন মুক্তাগাছার জমিদার শশীকান্ত আচার্য চৌধুরীর ছেলে স্নেহাংশু আচার্য চৌধুরী।

>>আরও পড়ুন...ময়মনসিংহ সার্কিট হাউজ মাঠ ও ঐতিহ্যবাহী ক্রীড়াপল্লি

ময়মনসিংহের ফুটবল লিগের ইতিহাসে সর্বোচ্চ শিরোপা অর্জনের রেকর্ড এখনো নিজেদের কব্জায় রেখেছে ক্লাবটি। স্বাধীনতার পর প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগেও সর্বোচ্চ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে এরাই। আবার বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের ‘আনসাং হিরো’ খ্যাত মাহমুদুল্লাহ রিয়াদও উঠে এসেছেন এই ক্লাব থেকেই।

শুধু মাহমুদুল্লাহই নন, বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের এক সময়কার দাপুটে অলরাউন্ডার সানোয়ার কিংবা পেসার সাইফুল এবং হালের মোসাদ্দেক হোসেন সৈকতকেও আবিষ্কার করেছে এই ক্লাবগুলোই। ফলে আবুল মনসুর সড়কের এই ক্রীড়া পল্লীতে যারপরেনাই রয়েছে বনেদিয়ানার প্রকাশ।

এছাড়া আবাহনী ক্রীড়া চক্র, দীপু-সায়েম ক্রীড়া চক্র, ফ্রেন্ডস ইলেভেন ক্লাব, কাউন্টি ক্লাব, উদয়ন ক্রীড়া চক্র, মুকুল ফৌজ অ্যাথলেটিকস ক্লাব, শাপলা ক্রীড়া চক্র, রেনেসা ক্লাব, সূর্যমুখী যুবমেলা অ্যাথলেটিকস ক্লাব, সোনালী অতীত ক্লাবসহ প্রতিটি ক্লাবই যেন এখানকার ক্রীড়া সংস্কৃতির এক একটি ইতিকথা।

শহরের সার্কিট হাউজ মাঠের ক্রীড়াপল্লীর এই ক্লাবগুলো ছাড়াও নগরীর পাড়া-মহল্লা-ওয়ার্ড পর্যায়েও রয়েছে সমৃদ্ধ ক্লাব চর্চা। শহরের ১২নং ওয়ার্ডে ক্লাব চর্চাকে বিকশিত করেছে স্থানীয় বলাকা বয়েজ ক্লাব। প্রতি বছর স্থানীয় সমাজ কল্যাণ মাঠে ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজনে করে এই ক্লাব। সন্ধ্যার পর আলোতে বসে এই টুর্নামেন্ট। ফাইনালে থাকে গরু-খাসির পুরস্কার।  

এই ক্লাবের সভাপতি আনিসুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ময়মনসিংহে রয়েছে ক্রীড়া সংস্কৃতির এক ঐতিহ্য ধারা। বড় ক্লাবগুলোর জনপ্রিয়তার প্রভাবে পাড়া মহল্লাতেও বিকশিত হচ্ছে ক্লাব চর্চা।

ক্লাব সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ময়মনসিংহে প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট ‍লিগে খেলছে এমন ক্লাবের সংখ্যা ১১টি। আর প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লিগের ক্লাব হচ্ছে ১২টি। তবে গত আট বছর যাবত এখানে প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগ শেষ করতে পারেনি জেলা ক্রীড়া সংস্থা, এমন অভিযোগ ক্লাব সংশ্লিষ্টদের। এজন্য তারা অতীত সময়ে জেলা ক্রীড়া সংস্থার অযোগ্য ও ব্যর্থ নেতৃত্বকেই দায়ী করেছেন।  

জানা যায়, ১৯৯৯ সালে ময়মনসিংহে প্রথম প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগ শুরু হয়। এরপর শাপলা, পণ্ডিতপাড়া ও আল হেলাল স্পোর্টিং ক্লাব সর্বোচ্চ শিরোপা জিতে। দুইবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে মন্ত্রীর ছেলে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহিত উর রহমান শান্তর দিপু-সায়েম ক্লাব।

১৯৮৫ সালে শাপলা ক্রীড়া চক্র, ঠিক পরের বছরেই অসিত মেমোরিয়াল ক্লাব ও ফ্রেন্ডস ইলেভেন ক্লাব, ১৯৫৮ সালে কাউন্টি ক্লাব, ১৯৮১ সালের গোড়ার দিকে আবাহনী ক্রীড়া চক্র, ১৯৭৭ সালে সূর্যমুখী যুবমেলা অ্যাথলেটিকস ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়। এরমধ্যে ক্রিকেট চর্চায় কাউন্টি ক্লাব সুনাম কুড়িয়েছে। এ ক্লাব থেকেই হাতেখড়ি হয়েছিলো জাতীয় দলের সাবেক অল-রাউন্ডার সানোয়ারের।  

পাড়াভিত্তিক ক্লাবগুলোর মধ্যে আল হেলাল ক্রীড়া চক্রের বর্ণাঢ্য ইতিহাস রয়েছে। আর ফুটবল, ক্রিকেট এবং হকি-সব বিভাগেই দুর্দান্ত নৈপুণ্য দেখিয়েছে ক্লাবটি।  

প্রায় ২২ বছর ময়মনসিংহ পণ্ডিতপাড়া অ্যাথলেটিকস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক কোষাধ্যক্ষ ফারুক হোসেন। বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, কমপক্ষে ১৮ বার স্থানীয় ফুটবল লিগে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার অসাধারণ কৃতিত্ব রয়েছে আমাদের ক্লাবের। এর মধ্যে আমার সময়েই ছয়বার প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার নজির রেখেছে ক্লাবটি। তবে জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাবেক নেতার দক্ষতার অভাবেই গত কয়েক বছর যাবত ময়মনসিংহ প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগ সম্পন্ন হয়নি।

ময়মনসিংহ নগরী ক্রিকেটের জন্য নামকরা। স্মৃতিময় ক্রীড়াঙ্গনের অতীত। এগিয়ে যাচ্ছে ক্রীড়া সংস্কৃতির ঐতিহ্যের ধারক ময়মনসিংহ। শুধু ক্রিকেট নয় ফুটবলেও ময়মনসিংহ ঐতিহ্যময়। জেলার ক্রীড়াঙ্গনের গর্বের ইতিহাস সমৃদ্ধ।  

দেশের নারী ফুটবলকে অন্যরকম উচ্চতায় নিয়ে গেছে জেলার ধোবাউড়া উপজেলার কলসিন্দুরের মেয়েরা। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তারা সাফল্য ধরে রেখেছে।  

ময়মনসিংহ ক্রীড়াঙ্গন, ক্রীড়াবিদ, ক্রীড়া সংগঠকদের এক বিশাল ক্যানভাস। ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে খ্যাত ময়মনসিংহ জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আমির আহমেদ চৌধুরী রতন। ষাটের দশকে ঢাকায় নিজের ক্রিকেট যোগ্যতার প্রমাণ রেখেছেন তিনি।  

এই ক্রীড়া সংগঠকের মতে, ক্রীড়াঙ্গনের সরব অবস্থান থেকেই গড়ে ওঠেছে ক্লাবগুলো। ক্রীড়া নগরী ময়মনসিংহে যে ক্লাব চর্চা শুরু হয়েছে তা নানা সমস্যা ও প্রতিকূলতার মধ্যেও সম্ভাবনার সর্বদ্বার উন্মোচন করে চলেছে। বর্তমান সরকারের সময়ে জেলার ক্রীড়া চর্চায় গতিশীলতা ফিরে এসেছে।

দেশের অ্যাথলেটিকসদের মধ্যে ময়মনসিংহের কৃতি খেলোয়াড়দের সুনাম ছিল এক সময়। হাল সময়ে সেই ক্ষেত্রে পিছিয়ে গেছে ময়মনসিংহ। ১৯৭৭ সালে প্রথম বিভাগীয় অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতায় ১২ সোনা ও ৭ রুপা জিতে রানার্সআপ হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিল ময়মনসিংহ।  

এই ময়মনসিংহই চল্লিশের দশকে তৈরি করেছিল মতিয়ার রহমান, রাখাল মজুমদার, মকবুল হোসেনদের মতো খেলোয়াড়। স্বাধীনতার আগে পূর্ব পাকিস্তান গেমসে ১১০ মিটার হার্ডলসে প্রথম হওয়ার কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন জাহাঙ্গীর ফয়েজ।  

এখনো পণ্ডিতপাড়া অ্যাথলেটিকস ক্লাব, মুকুল ফৌজ অ্যাথলেটিকস ক্লাব ও সূর্যমুখী যুবমেলা অ্যাথলেটিকস ক্লাব থাকলেও গড়ে ওঠছে না মতিয়ার ও মকবুলদের মতো খেলোয়াড়। মূলত এই ক্লাবগুলো অ্যাথলেটিকসের চেয়ে ক্রিকেট-ফুটবল নিয়েই বেশি ব্যস্ত।  

ময়মনসিংহের ক্লাবপাড়ার সমৃদ্ধ ইতিহাসের বিষয়ে ময়মনসিংহ জেলা ক্রীড়া সংস্থার সভাপতি ও জেলা প্রশাসক (ডিসি) ড. সুভাষ চন্দ্র বিশ্বাস বাংলানিউজকে বলেন, ময়মনসিংহের ক্লাবগুলো হচ্ছে কৃতি খেলোয়াড় তৈরির ‘গ্রোমিং গ্রাউন্ড’। জাতীয় ক্রিকেট দলের অনেক খেলোয়াড়ের প্রতিভা বিকাশের সূচনাও করেছে এই ক্লাবগুলো।  

ভবিষ্যতেও দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়েও নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতে সক্ষম হবে এমন প্রত্যাশার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, এখানকার তরুণ-তরুণীরা ক্রীড়াঙ্গনের এই জেলার সুনাম বয়ে আনতে কাজ করবেন।  

বাংলাদেশ সময়: ১৯৩৩ ঘণ্টা, আগস্ট ০৮, ২০১৮ 
এমএএএম/এনটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।