ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

তারার ফুল

তারেক মাসুদের প্রতি বাংলানিউজের শ্রদ্ধা

‘দেখো এই মানুষগুলো কীভাবে ছবিটা দেখছে!’

ক্যাথেরিন মাসুদ (অতিথি লেখক) | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২৫০ ঘণ্টা, আগস্ট ১২, ২০১৪
‘দেখো এই মানুষগুলো কীভাবে ছবিটা দেখছে!’ স্মৃতির অ্যালবাম : ক্যাথেরিন মাসুদ ও তারেক মাসুদ

যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে জন্ম ও বেড়ে ওঠা। পারিবারিক আবহটা যেমন ছিল তাতে শিক্ষাঙ্গনই তার কর্মক্ষেত্র হওয়ার কথা ছিল।

কিন্তু ক্যাথেরিন মাসুদ বেছে নিলেন চলচ্চিত্রকে। বাংলাদেশে এসেছিলেন গবেষণা কাজের উদ্দেশ্যে। ঘটনাচক্রে পরিচিত হলেন চিত্রশিল্পী এসএম সুলতান, কথাশিল্পী আহমদ ছফা এবং তাদের মাধ্যমে তখনকার তরুণ নির্মাতা তারেক মাসুদের সঙ্গে। অত:পর তারেক মাসুদের সঙ্গে বন্ধুত্ব, বিয়ে ও একসাথে চলচ্চিত্র যাত্রা। কিন্তু ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় তারেক মাসুদের মৃত্যুতে সব বদলে গেলো। এখন প্রয়াত নির্মাতার অসমাপ্ত অনেক কাজ এবং স্মৃতি নিয়ে ক্যাথেরিন মাসুদের দিনযাপন। তারেক মাসুদের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে বাংলানিউজটোয়েন্টিফোরের জন্য জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু স্মৃতি রোমন্থন করে লিখেছেন ক্যাথেরিন মাসুদ...

পরিচয়...
তারেক ও আমার পরিচয়টা কীভাবে হলো তা অনেকেই জানতে চায়। এর মূল কৃতজ্ঞতা আমি দেবো সাহিত্যিক আহমদ ছফাকে। আহমেদ ছফার সঙ্গেই আমার পরিচয় আগে হয়। সেই সময় তিনি থাকতেন ইন্দিরা রোডের পরিত্যাক্ত একটি বাড়িতে। বাড়িটা ছিল ডাক্তার মফিজ চৌধুরীর। স্বাধীনতা-উত্তর বঙ্গবন্ধুর সরকারে তিনি ছিলেন শিল্প মন্ত্রী। সেই বাড়িতে আহামেদ ছফা, ডাক্তার মফিজ চৌধুরীসহ তারেক মাসুদও থাকতেন। আর বাড়িটাকে তখন বলা হতো পাগলা ঘর! ওই সময় সেই বাড়িতে অনেকেই আসতেন আড্ডা দিতে। আমি গিয়েছিলাম আহমেদ ছফার আমন্ত্রণে। আমার এখনও মনে আছে সেদিন বৃষ্টি পড়ছিল। মাসটা ছিলো জুলাই। যতদূর মনে পড়ে, জুলাই মাসের শেষের দিকে (২৯ তারিখ) আমি গিয়েছিলাম আহমেদ ছফার সঙ্গে দেখা করতে। সেখানে তারেক (তারেক মাসুদ) ছিল, শর্টফিল্ম ফোরামের আরও অনেকেই ছিলেন। সেদিন জানতে পারি শিল্পী এসএম সুলতানের ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করছে তারেক। এ ব্যাপারে সে আমাকে কিছু কাগজও দিয়েছিল। সুলতানের সঙ্গে আমার আগে থেকেই পরিচয় ছিল। তার কাজও আগেই দেখেছি। অসাধারণ ছিল তার শিল্প। এজন্য আমিও আগ্রহ প্রকাশ করি প্রামাণ্যচিত্রের বিষয়ে। এরপর থেকে প্রায়ই আমি ওই বাড়িতে যেতাম। তাদের আড্ডার অংশ হতাম। আর তারেকও আমাকে প্রায়ই ফোন দিয়ে জানতে চাইতো, ‘ক্যাথরিন তুমি কি আজ আসছ?’ এভাবেই তারেকের সঙ্গে আমার পরিচয়। সেই বাড়িটা এখন আর নেই। সেখানে এখন বিপণি বিতার গড়ে উঠেছে।



‌আদম সুরতের শুরু
‘আদম সুরত’-এর সম্পাদনার কাজ চলছিল ডিএফপিতে। তারেক প্রায়ই যেত সেখানে। কিন্তু আমাকে নিতো না। বলতো- ‘জায়গাটা অনেক নোংরা। ’ কিন্তু আমি একদিন জোর করে গেলাম ওর সঙ্গে। ডিএফপির সম্পাদনা কক্ষে ঢুকে দেখি চারদিকে ফিল্মের টুকরা পড়ে আছে। টুলের ওপরে, ফ্লোরে সব জায়গায় মানুষের চুলের মতো পা ফেলারও জায়গা নেই। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম এভাবে কাজ হয়? তারেক আমাকে হাসতে হাসতে বললো, ‘হ্যাঁ এভাবে ফিল্ম কেটে একটার সঙ্গে আরেকটা জোড়া লাগিয়ে কাজ হয়। ’ তারপর থেকে প্রতিদিন যেতাম ওখানে। আর তারেকই আমার টিচার বলা যেতে পারে। ও-ই আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। আমার সব প্রশ্নের উত্তর ধৈর্য সহকারে দিতো। আর এভাবেই ঢুকে গেলাম ‘আদম সুরত’-এর কাজে। আমাদের সঙ্গে আরও অনেকেই ছিল। জুনায়েদ হালিম ছিলেন আমাদের সঙ্গে। শেষের দিকে ভারতে আমরা বিভিন্ন কাজে ঘুরলাম। যেমন শব্দমিশ্রণের কাজ, ল্যাবের কাজ, ফাইনাল প্রিন্টিংয়ের কাজ। একসঙ্গে দুইটা কাজ হলো আমাদের সেই সময় ঘোরাঘুরিও হলো। সেই সঙ্গে ফিল্মের কাজও হলো। এবং সেই অভিজ্ঞতা থেকেই আমি ফিল্মের সঙ্গে অনেক বেশি জড়িয়ে যায়। আর তারেকের সঙ্গে তখন আমার যাত্রা শুরু হয়ে গেছে। তারেকের সঙ্গে আমার ফিল্মের সম্পর্ক কিংবা তারেকের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক, কোনটাই আলাদা করা যায় না।

নিউইয়র্কের জীবন
‘আদম সুরত’-এর কাজ শেষ হওয়ার পর আমরা আমেরিকায় চলে যাই। আমাদের বিয়ে আগে হয়ে গেলেও আমার পরিবারের কারও সঙ্গেই তারেকের তখন পরিচয় নেই। আমরা একসঙ্গে আমেরিকা গেলাম। আমার ভাই, মা-বাবার সঙ্গে তখন তারেকের পরিচয় হলো। সে সময় আমাদের তেমন কোনো পরিকল্পনা ছিল না। আমরা তখন সিদ্ধান্ত নিলাম, নিউইয়র্কে কয়েকদিন থাকবো। আমাদের পরিকল্পনা ছিল, বছরখানেক থেকে তারপর আমরা বাংলাদেশে চলে আসব। তখন আমাদের ফিল্মের কাজ শেষ হয়েছে। আয়-রোজগার করার জন্য কিছু একটা করবো ভাবছিলাম। তারেক তখন প্রথমবারের মতো চাকরি খুঁজছিল। আমার জন্য বিষয়টা অনেক সহজ ছিল। আমি আগেও অনেক কাজ করেছি। কিন্তু তারেকের ব্যাপারে ওখানকার সবাই বলতো, ‘আপনি অতিরিক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন। ’ একথা বলার কারণ তারেক শর্টফিল্মের সঙ্গে জড়িত। একটা শর্টফিল্ম উৎসবের সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করেছে। তখন আমি ভাবলাম ওখানে একটা পুরনো বইয়ের দোকান আছে স্ট্র্যান্ড নামে, ওই জায়গায় তারেক যদি আবেদন করে তাহলে হয়তো কাজ হয়ে যেতে পারে। কারণ ওখানে অনেক শিল্পী, চলচ্চিত্র নির্মাতা কাজ করেন। আর তারেক তো শিল্প-সাহিত্য নিয়ে অনেক জানতো। সেখানে একটা পরীক্ষায় খুব ভালো ফল করার পর লাইব্রেরিতে তারেকের চাকরিটা হয়ে যায়।



মুক্তির গানের নেপথ্যে
নিউইয়র্কে থাকা অবস্থায় একদিন হঠাৎ আমরা খবর পাই লিয়ার লেভিন নামে এক মার্কিন চিত্রগ্রাহক-পরিচালকের কাছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অনেক মূল্যবান দলিল আছে। এরপর তার সঙ্গে ফোনে বেশ কয়েকবার কথা হওয়ার পর অবশেষে আমরা দেখা করতে পারলাম। আমরা তার কাছে জানতে পারি, তিনি প্রায় ২০ ঘণ্টার মতো দৃশ্যধারণ করলেও ছবিটির কাজ শেষ করতে পারেননি। এরপর তিনি তার বাড়ির বেজমেন্ট থেকে কিছু ভিডিওচিত্র এনে দেখানোর পর আমরা খুবই উদ্বুদ্ধ হয়ে গেলাম। তার তোলা ছবিগুলো ছিল অসাধারণ, রঙিন এবং সেই সময়ের লাইভ সাউন্ডের কাজ। আমরা এগুলো দেখে সিদ্ধান্ত নিলাম, একটা কিছু করতে হবে। এরপরই আমাদের চাকরি জীবনের অবসান। দীর্ঘ চার বছর ধরে চললো ‘মুক্তির গান’-এর কাজ। এরপর কাজ শেষে ছবিটির চারটি প্রিন্টসহ আমরা নিউইয়র্ক থেকে চলে এলাম বাংলাদেশে। আমরা ছবিটি বাণিজ্যিকভাবে মুক্তি না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। এরপর কোনোরকম আর্থিক সহযোগিতা ছাড়া নিজেরাই ছবিটি ১৯৯৫ সালের ৪ ডিসেম্বর শাহবাগের পাবলিক লাইব্রেরিতে প্রথম প্রদর্শনের ব্যবস্থা করি। প্রথম প্রদর্শনীতে দর্শক ছিলেন ২০ জনের মতো। কিন্তু তারেক ছিল আশাবাদী। সে বলছিলো, ‘দেখো এই মানুষগুলো কীভাবে ছবিটা দেখছে! আমি ছবিটা নিয়ে আশাবাদী। ’

মাটির ময়নার চিত্রনাট্য
তারেকের খুবই ইচ্ছা ছিল, তার ছোটবেলার গল্প নিয়ে কাজ করার। আমিও তাকে সবসময় উৎসাহ দিতাম এ বিষয়ে কাজ করার জন্য। কিন্তু সেটা নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র করা সম্ভব ছিল না। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিই চলচ্চিত্র করার। এজন্য চিত্রনাট্যের কাজে আমরা চলে যাই তারেকের গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের নূরপুরে। সেখানে গিয়ে চিত্রনাট্যের কাজ করতে গিয়ে শুরু হলো বৃষ্টি আর বন্যা। মহাসড়ক চলে গেল পানির নীচে। এজন্য আমাদের আটকে থাকতে হলো প্রায় ১৫ দিন। এভাবে থাকতে থাকতে আমরা তারেকের ছোটবেলার স্মৃতিময় ঘটনাগুলো সেই জায়গা এবং চিত্রায়নের জায়গায় বসেই মোটামুটি চিত্রনাট্যের বেশ বড় একটা অংশের কাজ শেষ করলাম। তারেক মূলত সংলাপ ও গল্প গঠন এবং আমি চিত্রায়নের দিকগুলোর কাজ একে একে করতে থাকলাম।

* (ওপরের ছবিতে) স্মৃতির অ্যালবাম : একমাত্র পুত্রসন্তান নিষাদের সঙ্গে তারেক মাসুদ ও ক্যাথেরিন মাসুদ

বাংলাদেশ সময় : ২২৪৭ ঘণ্টা, আগস্ট ১২, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

তারার ফুল এর সর্বশেষ