চট্টগ্রাম: চট্টগ্রামের সংগীত-ধারা আঞ্চলিক ও মাইজভাণ্ডারী গানের কীর্তিমান শিল্পী আব্দুল গফুর হালী। ছয় দশক ধরে সুরসাধনায় মত্ত তিনি।
আবদুল গফুর হালী শুধু শিল্পী নন, তিনি চট্টগ্রামের লোকসংস্কৃতির বটবৃক্ষ। হালী শুধু মাটির গান করেননি, ভাবের রসে মত্ত করেছেন ভক্তদের। গণসংগীতশিল্পীদের মতোই কণ্ঠসৈনিক হিসেবে তাকে পাওয়া গেছে স্বাধীকার আন্দোলনে।
আঞ্চলিক গানের কিংবদন্তী জুটি শ্যামসুন্দর বৈঞ্চব ও শেফালী ঘোষের অসংখ্য জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা গফুর হালী। ৮৬ বছর বয়সেও গান লিখে এবং গেয়ে সংসার চালান তিনি। তার মাইজভাণ্ডারী গান নিয়ে জার্মানির হালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গবেষণামূলক বই বেরিয়েছে। গফুর হালীর জীবন ও গান নিয়ে লেখা হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. হানস হারডারের ‘ডার ফেরুখটে গফুর স্প্রিখট’ নামে গবেষণা গ্রন্থটি আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে আলোচিত হয়েছে। আবদুল গফুর হালীর গান নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে দুটি গবেষণাগ্রন্থ বেরিয়েছে। সাংবাদিক নাসির উদ্দিন হায়দারের সম্পাদনায় ‘সুরের বন্ধু’ ও মোহাম্মদ আলী হোসেনের সম্পাদনায় ‘শিকড়’ নামে এই দুটি গ্রন্থে গফুর হালীর ২০০ গানের স্বরলিপি রয়েছে। গ্রন্থ দুটি ইতিমধ্যে সুধীমহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। আবদুল গফুর হালীর জীবন ও কর্ম নিয়ে ২০১০ সালে চট্টগ্রাম চলচ্চিত্রকেন্দ্রের সভাপতি শৈবাল চৌধুরী ‘মেঠোপথের গান’ নামে একটি তথ্যচিত্র তৈরি করেছেন।
নিউমার্কেটে ছোটখাটো একটা দোকান ছিল শ্যামসুন্দর বৈঞ্চবের। শ্যাম গানের মানুষ। সে সূত্রে তার দোকানে শিল্পীদের আড্ডা বসতো সকাল-সন্ধ্যায়। সে আড্ডায় একদিন ঢুঁ মারেন গানের জগতে নবীন আব্দুল গফুরও। শ্যাম দিল-খোলা মানুষ, গফুরও তেমনই। ফলে দু’জনের মধ্যে ভাব তৈরি হতে সময় লাগেনি। গ্রাম থেকে গান নিয়ে শহরে ছুটে আসেন গফুর। শ্যামের কণ্ঠে তা তুলে দেন। চট্টগ্রাম বেতারে প্রচারিত হয় গানগুলো। বেতারেই একদিন শেফালী ঘোষ বললেন, ‘উদা শ্যামরে দিলে অইতো ন, আঁরেও গান দেওন ফরিব (শুধু শ্যামকে দিলে তো হবে না, আমাকেও দিতে হবে)। ’
শেফালী বারবার তাগাদা দেন আর গফুর ভুলে যান। তখনকার আঞ্চলিক পরিচালক (আরডি) আশরাফুজ্জামানকে নালিশ দেন শেফালী, ‘গফুরদা আমাকে গান দিচ্ছেন না। ’ আরডি ডেকে পাঠান গফুরকে, পাশে বসিয়ে চা খাওয়ান। একথা সেকথা বলার পর শেফালীকে গান দিতে অনুরোধ করেন। গফুর আরডিকে বললেন, ‘একটা দ্বৈত গান আছে। সেটা শ্যাম-শেফালীকে দিয়ে গাওয়ানো যায়। ’ গফুরের প্রস্তাব লুফে আরডি বলেন, ‘আপনি কালই গানটা রেকর্ড করে দেন। ’
দু’দিন পর শ্যামসুন্দরের চকবাজারের বাসায় হাজির হন গফুর। শ্যামের সাইকেলে চড়ে পৌঁছে যান শেফালীর বাসায়। শ্যাম ও শেফালীর কণ্ঠে তুলে দেন সেই গান।
‘ন যাইও ন যাইও/ আঁরে ফেলাই বাপের বাড়িত ন যাইও (ছেলে), /ন গইজ্য ন গইরজ্য/বাপর বাড়িত যাইতাম মানা ন গইরজ্য (মেয়ে)। ’ বেতারে প্রচারের পর আলোড়ন তুলল গানটি। শ্যামসুন্দর বৈঞ্চব ও শেফালী ঘোষের নাম ছড়িয়ে পড়ল হাটে-মাঠে।
এর আগে মলয় ঘোষ দস্তিদারের ‘নাইয়র গেলে আইস্য তারাতারি’ সহ দু’একটি দ্বৈত আঞ্চলিক গান গেয়েছিলেন শ্যাম-শেফালী। কিন্তু ‘নাইয়র’ গানটির দারুণ জনপ্রিয়তা আঞ্চলিক গানে নতুন ধারা সৃষ্টি করে। প্রতিষ্ঠিত হয় নতুন সংগীত জুটি শ্যামসুন্দর বৈঞ্চব ও শেফালী ঘোষ। এই একটি গান গফুরের জীবনের মোড়ও ঘুরিয়ে দেয়। রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেলেন। সংগীতজীবন শুরু করেছিলেন শিল্পী হিসেবে। খ্যাতিমান হলেন গীতিকার ও সুরকার হিসেবে। এটা ১৯৬৪ সালের ঘটনা।
এবার একটু পেছনে ফেরা যাক। আব্দুল গফুরের জম্ম ১৯২৯ সালে পটিয়ার রশিদাবাদে। বাবা আব্দুস সোবহান, মা গুলতাজ খাতুন। লেখাপড়া করেছেন রশিদাবাদ প্রাথমিক বিদ্যালয় ও জোয়ারা বিশ্বম্বর চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয়ে। রশিদাবাদ সাধক শিল্পী আস্কর আলী পণ্ডিতের গ্রাম। আস্কর আলীর গান শুনে বেড়ে উঠেছেন গফুর। ছোটবেলায় তার আধ্যাত্মিক ও মরমী গান গফুরের মনে গভীর প্রভাব ফেলে। গ্রামে লেটোর দল, যাত্রাদলের আনাগোনা ছিল নিয়মিত। হতো পালা গান, গাজীর গান। পুঁথি পাঠের আসর বসত ঘরে ঘরে। এসব আসরের নিয়মিত শ্রোতা ছিল শিশু গফুর।
অল্প বয়সে সিনেমার পোকা ছিলেন গফুর। দোহাজারি রেলস্টেশনটা কাছেই। চার আনা ভাড়া দিয়ে চলে আসতেন শহরে। টিকিট কেটে ঢুকে পড়তেন রঙ্গম সিনেমা হলে, কখনও লায়ন-ঝুমুরে। ছবির গানগুলো হুবহু গাইতে পারতেন গফুর। সে সময় প্রতিটি ছবির গান নিয়ে দু-তিন পাতার বই পাওয়া যেত। গান মুখস্থ করার ক্ষেত্রে ভালোই কাজে আসতো এটা।
কী করে যেন গ্রামে প্রচার হয়ে গেল গফুর ভালো গান করে। একদিন তাকে যাত্রা অনুষ্ঠানের মঞ্চে তুলে দেন স্থানীয়রা। গান শুনে সবাই প্রশংসা করলেন। তবে গফুরের বাবা এসব পছন্দ করতেন না। গান না করার জন্য অনেক শাসন করেছেন। শেষে ঘরে আনলেন বউ। তখন গফুরের বয়স ২২-২৩। বাবা ভেবেছিলেন বিয়ে দিলে হয়তো ছেলে সংসারি হবে। হলো উল্টো।
বিয়ের পর বউয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সংসারী হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন আব্দুল গফুরও। টুকটাক আয়-রোজগারও করছিলেন। পিতার পুরনো ব্যবসাটা রপ্ত করে নিচ্ছিলেন। এ সময় একদিন আচমকা হাজির হলেন ফটিকছড়ির মাইজভাণ্ডারে। এখানেও গানের টান। রমেশ শীল, বজলুল করিম মন্দাকীনি, মৌলানা হাদীর মাইজভাণ্ডারি গান তার মনোজগত বদলে দেয়। লাল পোশাক পরা লোকজন যখন মাইজভাণ্ডারে ঢোল বাজিয়ে নেচে নেচে গাইতেন তখন তিনি আর স্থির থাকতে পারতেন না। তাদের সঙ্গে নাচতেন, গলা মেলাতেন। একদিন মাইজভাণ্ডারের ভক্তদের অনুরোধে গাইতে হলো আব্দুল গফুরকে। গান শেষ করার পর দেখলেন হারমোনিয়াম ভরে গেছে টাকায়। গান গেয়ে টাকা পাওয়া যায়, এ অভিজ্ঞতা তার কাছে ছিল একেবারে নতুন। তিনি সব টাকা জেয়ারতে দিয়ে দিলেন। এটা ১৯৫৫-৫৬ সালের কথা।
বাকিটা শুনুন গফুরের জবানিতে ‘মনে হলো আমার ওপর অদৃশ্য শক্তি ভর করেছে। এই দরবার যেন সব জাতির মিলনমেলা! মাইজভাণ্ডারের প্রেম সাগরে নিজেকে হারিয়ে ফেললাম। ওখান থেকে আসার পর আমাকে কে যেন বলছেন, ‘লেখ লেখ। ’ একদিন গান বাঁধলাম ‘আর কতকাল খেলবি খেলা/ মরণ কি তোর হবে না/ আইল কত গেল কত/ কোথায় তাদের ঠিকানা। ’ ওই সময় পীর শফিউল বশর মাইজভাণ্ডারি (র) আব্দুল গফুরকে ‘হালী’ পদবি দেন।
শিল্পী হিসেবে ততদিনে মোটামুটি নাম হয়ে গেছে আব্দুল গফুরের। এরই মধ্যে অডিশনের ঘোষণা শুনে আগ্রাবাদের বেতার ভবনে হাজির হলেন। অডিশনে সেই গানটিই গাইলেন, ‘আর কতদিন খেলবি খেলা...। ’ বেতারে তখন সরাসরি গান প্রচার হতো। গ্রামে পৌঁছার আগেই গান প্রচার হয়ে গেল। বাড়ির পাশে রৌশনহাট রেলস্টেশন। গফুরের গান শুনে গ্রামের শত শত মানুষ তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ট্রেন থেকে নামার পর তাকে কাঁধে করে বাড়ি পৌঁছে দিলেন সবাই। পরে শুনেছিলেন অডিশনে তিনি নাকি প্রথম হয়েছিলেন।
১৯৬৩ সাল থেকে বেতারে গফুরের লেখা গান প্রচার শুরু হলেও প্রথম সাত-আট বছর নাম উল্লেখ করা হয়নি। গান প্রচার হতো ‘সংগ্রহ’ হিসেব। কারণ গীতিকার ও সুরকার হিসেবে তখনো তালিকাভুক্ত হননি গফুর হালী। ১৯৭২ সালে তালিকাভুক্ত হওয়ার পর শ্রোতারা অবাক হয়ে জানলেন বেতারের অনেক জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা গফুর। সেই থেকে বেতারেই তার ঘরবসতি। এখন বিশেষ শ্রেণীর শিল্পী, গীতিকার ও সুরকার।
গফুর হালীর গানে উত্তাল হন সব বয়সের মানুষ। সত্তরের ঐতিহাসিক নির্বাচন। শেখ মুজিবের নৌকা পাল তুলে ছুটছে কর্ণফুলীতে, শঙ্খের বাঁকা জলে। কোটি বাঙালির সঙ্গে তাল মিলিয়ে নৌকার হাওয়ায় ভাসলেন আব্দুল গফুর হালীও। আজ এখানে, কাল ওখানে গান গেয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালান। গফুর একটা গান একটু বেশিই গাইতেন ‘আল্লাহর দোহাই খোদার দোহাই/ ফকা চৌধুরী হাঁদের দে উয়া ভোটল্লাই। ’ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। আব্দুল গফুর হালী সরাসরি রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেননি। তবে ক্যাম্পে গিয়ে গান গেয়ে উদ্দীপ্ত করতেন মুক্তিযোদ্ধাদের।
আব্দুল গফুর হালীর আঞ্চলিক গানের সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার। মাইজভাণ্ডারি গানও হাজারের বেশি হবে। এসব গানের মধ্যে শেফালী ঘোষের গাওয়া ‘ও শ্যাম রেঙ্গুন ন যাইও রে, ঢোল বাজের আর মাইক বাজের, সোনাবন্ধু, বাইন দুয়ার দি, ন মাতাই ন বুলাই, ছোডকাইল্যা প্রেম আমার, মনের বাগানে’, কল্যাণী ঘোষের গাওয়া ‘পাঞ্জাবিওয়ালা, শঙ্খ খালর মাঝি, দুই কুলের সোলতান, দেখে যারে মাইজভাণ্ডারে’ সহ অসংখ্য গান শ্রেতাদের মুখে মুখে ফেরে। শ্যাম-শেফালীর কণ্ঠে ‘তুঁই যাইবা সোনাদিয়া, বন্ধু আঁর দুয়ারদি যঅ,’ গানগুলো তো চিরসবুজ গান হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। তাঁর গান আরও গেয়েছেন ঊমা খান, সঞ্জিত আচার্য, কান্তা নন্দী, শিল্পীরাণী, আব্দুল মান্নান, সেলিম নিজামী ও শিমুল শীল। এ ছাড়াও তার গান সাম্প্রতিক সময়ে নতুন সংগীতায়োজনে গেয়েছেন সন্দীপন (সোনাবন্ধু), শিরিন (পাঞ্জাবিওয়ালা, মনের বাগানে), বেবী নাজনীন (শঙ্খ খালর মাঝি)। এসব গান নতুন প্রজন্মের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
গফুর হালীর গানে আছে মাটির ছোঁয়া। আছে অসাম্প্রদায়িক চেতনা। পীরের প্রতি ভক্তি ও আধ্যাত্মিকতা আছে ওতোপ্রোতভাবে। হালী বলেন, ‘চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা মাটির সঙ্গে গাঁথা, এ ভাষার সঙ্গে এ এলাকার মানুষের নাড়ির টান। তাই আমার গানও এসব থেকে সৃষ্টি। ’
১৯৭৫ সালের দিকে বিটিভির একজন কর্মকর্তার অনুরোধে আঞ্চলিক নাটক লেখা শুরু করেন গফুর হালী। যদিও নাটকটি পরে প্রচার হয়নি। নাটক নিয়ে মধুর স্মৃতি জানাতে গিয়ে হালী বলেন, ‘গুলবাহার নাটক নিয়ে একবার কক্সবাজার গিয়েছিলাম। প্রথম প্রদর্শনীই ফাটাফাটি হিট। অভিনয় করেছিল অঞ্জু ঘোষ, পংকজ বৈদ্য সুজন। নাটকের একটি দৃশ্যে অঞ্জু ঘোষ কলা গাছ ধরে কেঁদেছিলেন। নিলামে সে কলা গাছের দাম উঠেছিল ১০০ টাকা। ’
গান গেয়ে কী পেলেন? এমন প্রশ্ন ছিল গফুর হালীর কাছে। এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে উত্তেজনায় কণ্ঠ ধরে আসে গফুর হালীর। তিনি বলেন, ‘পয়সা তো কম কামাইনি। সেসব কোথায় জানি না। সংসার কীভাবে চলেছে তা-ও জানি না। জানে আমার স্ত্রী। তবে এটা জানি সংসারে কষ্ট ছিল। কী পেয়েছি কী পাইনি তা হিসাব করিনি। করব না কখনো!’
বাংলাদেশ সময় : ১৩২০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১৪