‘বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব-২০১৪ উপলক্ষে রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়ামে বসেছিল যেন বসেছিল চাঁদ-তারার হাট। ২৯ নভেম্বর শুরু হওয়া এই উৎসব সাঙ্গ হলো ২ ডিসেম্বর।
গুণীশিল্পীদের সুরের সাগরে ভেসে যেতে হাজার হাজার শ্রোতা পাঁচ দিন নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে। এই পাঁচদিন সন্ধ্যা নামতেই সুরের টানে প্রতিদিনই সবাই দলে দলে এসেছেন উৎসবস্থলে।
এবারের উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব উৎসর্গ করা হয়েছিল পল্লীকবি জসীমউদদীনকে। বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশ ও পরিচর্যায় অমূল্য অবদানের জন্য স্মরণ করা হয়েছে সদ্যপ্রয়াত বরেণ্য সংগীতশিল্পী ফিরোজা বেগম, গুরু রামকানাই দাস এবং সংস্কৃতিকর্মী ও বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের ট্রাস্টি সুবীর চৌধুরীকে।
উৎসবটির আয়োজক বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের বলেছেন, ‘দেশভাগের আগে কিছু শিল্পী উচ্চাঙ্গসংগীতকে শুধু ভারতে নয়, পুরো বিশ্বে বিখ্যাত করে তুলেছিলেন। আমরা অনেকেই জানি না, তাদের বেশিরভাগই জন্মেছিলেন আমাদের দেশে। প্রথম বছর কথা দিয়েছিলাম এমন সব শিল্পীদের আমরা নিজেরাই তৈরি করবো। সে অনুযায়ী আমরা বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয় নামের একটি স্কুল চালু করেছি। এ উৎসবে অংশ নেওয়া প্রথিতযশা শিল্পীরাও বলছেন বাংলাদেশের শ্রোতাদের কোনো তুলনা হয় না। ’
স্কয়ার টয়লেট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অঞ্জন চৌধুরী বলেন, ‘স্কয়ার গ্রুপ এ আয়োজনের সাথে থাকতে পেরে গর্বিত। আমরা বিশ্বাস করি আগামীতে এর পরিধি আরও বড় হবে। ’
পাঁচ দিনের বিশাল উৎসবের বিশেষ কিছু মুহূর্ত নিয়ে বাংলানিউজের তারার ফুলের এই আয়োজন। চলুন আলোকচিত্রে চোখ রেখে আরেকবার ফিরে দেখা যাক বর্ণিল এই উৎসব।
* এবারের উৎসবের প্রথম দিনের প্রথম পরিবেশনা ছিলো বাংলা গানের।
* তিনতাল বাদনের মধ্য দিয়ে তবলার পরিবেশনা শুরু করেন আজিনক্যা জোশি। তার সহযোগী শিল্পী হিসেবে হারমোনিয়ামে ছিলেন গৌরব চট্টোপাধ্যায়।
* নৃত্যাঞ্জলি দিয়ে পরিবেশনা শুরু করে মারীচ বধ, ইয়েনাথাবাম এবং তিল্লানা পরিবেশন করেন বিদুষী মালবিকা সারুক্কাই।
* একতালে বিলম্বিত, তিনতালের দ্রুত এবং তারপর একতালের দ্রুত বাগেশ্রী রাগ পরিবেশন করেন রুচিরা কেদার । এরপর পিলুর ঠুমরী গেয়ে পরিবেশনা শেষ করেন রুচিরা কেদার। তবলায় ছিলেন সঞ্জয় অধিকারী।
* সেতারে রাগেশ্রী বাজিয়ে পরিবেশনা শুরু করেন ওস্তাদ শহীদ পারভেজ খান। এরপর মিশ্র খাম্বাজ ও কিছুটা রাগ মাণ্ড বাজিয়ে শোনান তিনি। ধুন দিয়ে শেষ হয় তার পরিবেশনা। তার সঙ্গে তবলায় সঙ্গত করেন ওস্তাদ আকরাম খান।
* গৌতম সরকার, মোঃ জাকির হোসেন , ইনামুল হক (মৃদঙগ) ও বিশ্বজিত নট্টের সম্মিলিত তবলাবাদনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় দ্বিতীয় দিনের উৎসব। তারা তিনতালের লহড়া পরিবেশন করেন। হারমোনিয়ামে ছিলেন আলমগীর পারভেজ।
* কণ্ঠসংগীত পরিবেশন করেন সুপ্রিয়া দাশ। তিনি নন্দ রাগে একতালে বিলম্বিত এবং তিনতালে মধ্য লয়ের খেয়াল পরিবেশন করেন। কাফি ঠুমরী দিয়ে পরিবেশনা শেষ করেন সুপ্রিয়া। তবলায় সবুজ আহমেদ আর হারমোনিয়ামে ছিলেন সঞ্জীবন সান্যাল।
* গুরু কড়াইকুডি মানি এবং তার দল পরিবেশন কবেন কর্নাটকি তালবাদ্য। মৃদঙ্গমে ছিলেন গুরু কড়াইকুডি মানি। এ ছাড়া থালোমে নাগায় নারায়ণন, খঞ্জিরায় অমৃত নটরাজ আর ঘটমে ছিলেন সুরেশ বৈদ্যনাথন।
* কৌশিক ধ্বনি রাগে মত্ত তালে বিলম্বিত ও তিলতালে মধ্য লয়ে সন্তুর বাজান রাহুল শর্মা।
* পণ্ডিত রাজন মিশ্র ও পণ্ডিত সাজন মিশ্র ভৈরব রাগে বিলম্বিত, দ্রুত খেয়াল এবং তারানা পরিবেশন করেন। এরপর ললিত রাগে মধ্যলয়ে খেয়াল পরিবেশনের পর গেয়ে শোনান ভৈরবী ঠুমরী। তাদের সঙ্গে তবলায় ওস্তাদ আকরাম খান এবং হারমোনিয়ামে ছিলেন গৌরব চট্টোপাধ্যায়।
* তৃতীয় দিন নিশিত দে পরিবেশন করেন সেতার। তিনি পুরিয়া ধনেশ্রী রাগ বাজান। তার সঙ্গে তবলায় ছিলেন ইফতেখার আলম প্রধান।
* কণ্ঠসংগীতে ছায়ানট রাগে ঝুমরা তালে বিলম্বিত, দ্রুত তিনতালে মদ্ধ্যলয়ের খেয়াল এবং মিশ্র খাম্বাজ ঠুমরী পরিবেশন করেন মঞ্জুষা পাতিল। তবলায় সঙ্গত করেন সঞ্জয় অধিকারী।
* পণ্ডিত শিবকুমার শর্মার সন্তুরের পরিবেশনায় ছিলো ঝাঁপতাল, আদ্ধা ও তিনতালে বাজানো রাগ চারুকেশী। শ্রোতাদের অনুরোধে তিনি বাজিয়েছেন পাহাড়ী ধুন।
* পণ্ডিত উলহাস কাশালকার ললিত রাগে একতালে বিলম্বিত ও তিনতালে দ্রুত খেয়াল ও তারানা, দেশকার রাগে তিনতালে মধ্যলয়ের খেয়াল ও ভৈরবী রাগ পরিবেশন করেন। তাকে কণ্ঠ সহায়তা দেন সামিহান কাশালকার। তবলায় সঙ্গত করেন পণ্ডিত যোগেশ শামসি, হারমোনিয়াম বাজান গৌরব চট্টোপাধ্যায়।
* ড. অসিত রায় রাগ বাগেশ্রীতে আলাপ, জোড়, ঝালা ও চৌতাল এবং সুরফাক্তা তালে বন্দিশ পরিবেশন করেন। পাখওয়াজ বাজান পণ্ডিত মোহন শ্যাম শর্মা।
* কর্নাটকী কণ্ঠশিল্পী বিদুষী অরুণা সাইরাম দক্ষিণ ভারতীয় রাগ হিন্দোলম, স্বামী পুরন্দর দাসের কম্পোজিশন ও রাগ কাটানা কূটুহলম এবং সংক্ষেপে রাগ তোড়ি পরিবেশন করেন। এ ছাড়া কাজী নজরুল ইসলামের গান ‘আমার কালো মেয়ে রাগ করেছে’ গেয়ে শোনান তিনি।
* সেতারে পণ্ডিত রবিশঙ্করের সৃষ্টি রাগ পরমেশ্বরীতে আলাপ, জোড়, ঝালা এবং বিলম্বিত ও দ্রুত তিনতালে গৎ পরিবেশন করেন পণ্ডিত কুশল দাশ। তার সঙ্গে তবলায় ছিলেন পণ্ডিত যোগেশ শামসি।
* চতুর্থ দিনের শুরুতে অমিত চৌধুরী ভরতনাট্যমে নাটেশা কৌথুওয়াম পরিবেশন করেন রাগ নাট্টাই এবং আধিতালে। এরপর তিনি বসন্ত রাগে নটনম আডিনা এবং রাগ পূরবীতে রূপক তালে তিল্লানা পরিবেশন করেন।
* তিনতালে তবলাবাদন করেন স্বরূপ হোসেন। তার সঙ্গে হারমোনিয়াম সঙ্গত করেন আলমগীর পারভেজ।
* ওস্তাদ আমজাদ আলী খাঁর দুই পুত্রসন্তান আমান আলী খান ও আয়ান আলী খান সরোদবাদন করেন। সাড়ে নয় মাত্রায় ঝিঞ্ঝটি রাগ বাজিয়ে পরিবেশনা শুরু করেন ভ্রাতৃদ্বয়। এরপর রাগেশ্রী ও একটি ভাটিয়ালি ধুন বাজান তারা।
* কণ্ঠসংগীতে সামিহান কাশালকার পরিবেশন করেন মালকোশ রাগে বিলম্বিত, দ্রুত খেয়াল ও তারানা এবং সোহিনি রাগে দ্রুত খেয়াল। তবলায় সঞ্জয় অধিকারী আর হারমোনিয়ামে ছিলেন গৌরব চট্টোপাধ্যায়।
* পণ্ডিত তেজেন্দ্র নারায়ণ মজুমদারের সরোদ ও গনেশ রাজাগোপালনের বেহালার যুগলবন্দী দর্শক-শ্রোতাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিলো। তারা দক্ষিনী রাগ হিন্দোলম ও রাগ চারুকেশী পরিবেশন করেন। সবশেষে পল্লীকবি জসীমউদদীন রচিত ‘রঙিলা’ গানের সুরের ওপর ভিত্তি করে একটি ধুন বাজান তারা। তবলায় পণ্ডিত যোগেশ শামসি আর মৃদঙ্গমে ছিলেন রবিশংকর ভদ্রাচার।
* কৌশিকী চক্রবর্তী বাগেশ্রী রাগে একতালে বিলম্বিত, তিনতালে মধ্যলয়ের খেয়াল ও তারানা পরিবেশন করেন। এরপর দুটি পাহাড়ি ঠুমরী গেয়েছেন তিনি। তার সঙ্গে তবলায় ছিলেন পণ্ডিত যোগেশ শামসি।
* প্রবাদপ্রতিম শিল্পী পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার বংশীবাদন ছিলো উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ। তিনি প্রথমে বাজান মত্ত তালে রাগ আহির ভৈরব। এরপর তোলেন কীর্তনের সুর। রাগ ভৈরবী বাজিয়ে নিজের পরিবেশনা শেষ করেন তিনি। তাকে তবলায় সঙ্গত করেন ওস্তাদ যোগেশ শামসি।
* সমাপনী দিনে শুরুতেই সম্মিলিত কণ্ঠে বাংলা গান পরিবেশন করেন অদিতি মহসিন, অনিন্দিতা চৌধুরী, আজিজুর রহমান, বিমান চন্দ্র বিশ্বাস, বুলবুল ইসলাম, চন্দনা মজুমদার, ইলোরা আহমেদ শুক্লা, ফাহিম হোসেন চৌধুরী, ফরিদা পারভীন, ইফফাত আরা দেওয়ান, জান্নাত-ই-ফেরদৌস, ঝুমা খন্দকার, খায়রুল আনাম শাকিল, কিরণ চন্দ্র রায়, লাইসা আহমেদ লিসা, মাসুদা নার্গিস আনাম, মিতা হক, মহিউজ্জামান চৌধুরী, নাসিমা শাহীন, প্রিয়াঙ্কা গোপ, শাহীন সামাদ, শাহীন কবির পলাশ, শামা রহমান, শারমিন সাথী ইসলাম, সেমন্তী মঞ্জারি, সুবির নন্দী, সুমা রানী রায়, তানিয়া মান্নান, ইয়াসমিন মুসতারী এবং ইয়াকুব আলী খান। তারা গেয়ে শোনান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’, ‘ধন্য ধন্য বলি তারে’ এবং ‘এই পদ্মা এই মেঘনা’ গান তিনটি।
* ভরতনাট্যম পরিবেশন করেন বিশাল কৃষ্ণ। শিব বন্দনা, পরনের বিভিন্ন প্রকার, তেহাই, পাঁচ গণনার বিভিন্ন কম্পোজিশন ও ময়ূরের গত পরিবেশন করেন তিনি।
* প্রবাদপ্রতীম কণ্ঠশিল্পী বিদুষী কিশোরী আমানকার পরিবেশন করেন রাগ কেদার ও দরবারি কানাড়া। তার সঙ্গে তবলায় ভারত কামাত, হারমোনিয়ামে শ্রীয়োগ কুন্ডালকার আর বেহালায় ছিলেন মিলিন্দ রায়কার। কণ্ঠ সহযোগিতা দেন নন্দিনী বেদেকার ও তেজশ্রী বিভাস আমানকার।
* অশ্বিনী ভিডে দেশপান্ডে পরিবেশন করেন রাগ যোগ এবং রাগ পরজ। তবলায় পণ্ডিত যোগেশ শামসি আর হারমোনিয়ামে ছিলেন গৌরব চট্টোপাধ্যায়।
* উদয় ভাওয়ালকারের ধ্রুপদ ছিলো পরবর্তী পরিবেশনা। তিনি রাগ বেহাগে আলাপ ও ধামার এবং সুরতালে বান্দিস পরিবেশন করেন। তার সঙ্গে পাখওয়াজে ছিলেন প্রতাপ আওয়াধ, কণ্ঠ সহযোগিতা করেন চিন্তন উপাধ্যায়।
* প্রবাদপ্রতীম শিল্পী ওস্তাদ আমজাদ আলী খাঁর সরোদবাদন ছিলেন এবারের উৎসবের শেষ আকর্ষণ। তিনি সরোদে রাগ খাম্বাজ, ভৈরবী এবং যোগিয়া পরিবেশন করেন। তবলায় সত্যজিৎ তালওয়ালকার আর পাখওয়াজে ছিলেন পণ্ডিত ফতেহ সিং গাঙ্গানি।
বাংলাদেশ সময় : ২১৪৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩, ২০১৪