ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

তারার ফুল

রুনা লায়লার কাছে একডজন প্রশ্ন

বাংলাদেশি হিসেবে আমি ধন্য

জনি হক, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৪৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ৮, ২০১৫
বাংলাদেশি হিসেবে আমি ধন্য রুনা লায়লা

গানে গানে ৫০ বছর পূর্ণ করছেন রুনা লায়লা। কিংবদন্তি হিসেবেই এই অনন্য মাইলফলক স্পর্শ করলেন তিনি।

১৯৬৫ থেকে ২০১৫- এই দীর্ঘ সময়ে শ্রোতাদের অসংখ্য কালজয়ী গান উপহার দিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি বাংলাদেশকে সাফল্যের সঙ্গে উপস্থাপন করেছেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে।

চলচ্চিত্রের গানে অনবদ্য কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ছয়বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন রুনা। ২০১৩ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারেও সেরা গায়িকার পুরস্কার এসেছে তার ঘরে। এ ছাড়া বাচসাস পুরস্কার, চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতি পুরস্কার, নিগার অ্যাওয়ার্ড (পাকিস্তান) সহ অনেক পুরস্কার  পেয়েছেন। এত দীর্ঘ সময় পেরিয়ে এসেও রুনা লায়লার তুলনা শুধুই তিনি। জনপ্রিয়তা, সফলতা, প্রাপ্তিকে একসঙ্গে নিয়ে এতোটা বছর পাড়ি দিয়ে তিনি নিজেকে নিয়ে গেছেন অন্যরকম এক উচ্চতায়। সুবর্ণজয়ন্তীতে গান, দর্শন, সাফল্য, ভুল-সহ খুঁটিনাটি নানা বিষয়ে বাংলানিউজের একডজন প্রশ্নের উত্তর দিলেন রুনা লায়লা।

বাংলানিউজ : ‘জুগনু’ ছবির প্রথম গান গাওয়ার দিনটির কথা মনে পড়ে?
রুনা লায়লা : কেনো পড়বে না! নিশ্চয়ই মনে পড়ে। ১৯৬৫ সালে মুক্তি পাওয়া ‘জুগনু’ ছবিতে ‘গুড়িয়াসি মুনি্ন মেরি’ আমার জীবনের প্রথম গাওয়া গান। তাই ওটাই আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। সেই শুরু। তারপর থেকে চলতে থাকলো, এখনও চলছে।

বাংলানিউজ : ‘জুগনু’র ওই গান গাওয়ার আগে কি ভেবেছিলেন, সারা দুনিয়ার শ্রোতারা আপনাকে চিনবে?
রুনা :  (হেসে) শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন তো একটা ছিলো। ‘জুগনু’র ওই গানটা ছিলো আমার সেই স্বপ্নপূরণের প্রথম ধাপ। রেডিওতে একসময় অন্যদের গান নিয়মিত শুনতাম। তখন ভাবতাম একসময় আমারও গান বাজবে এভাবে, আমার নাম বলবে। রেডিওতে সবাই শুনবে। সেটা যে সত্যি সত্যি হবে বুঝতে পারিনি, ভাবতে পারিনি। সৃষ্টিকর্তার অশেষ মেহেরবানি, আমার বাবা-মায়ের পরিশ্রম আর বোনের দোয়া; সব মিলিয়ে এটা হয়েছে।

বাংলানিউজ : কোন ধরনের গান শোনা উপভোগ করেন?
রুনা :  আমি ব্যক্তিগতভাবে একটু ক্ল্যাসিকাল নির্ভর গানগুলোই পছন্দ করি। এ ছাড়া স্যাড মেলোডিও পছন্দের। শৈশব থেকে লতাজি (লতা মঙ্গেশকর), আশাজি (আশা ভোঁসলে), ম্যাডাম নূরজাহান, ফেরদৌসী আপা, আঞ্জুমান আরা আপার গান বেশি শুনতাম। তাদের গান শুনে শুনেই বেড়ে উঠেছি।

বাংলানিউজ : সংগীত জীবনের শুরু থেকে আপনি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য তৈরি করেছেন। গায়িকা হিসেবে কি কাউকে অনুসরণ করতেন?
রুনা :  সত্যি বলতে আমি ছোটবেলায় নাচ শিখেছি চার বছর। ওই ব্যাপারটা আমার মধ্যে রয়ে গেছে। গান পরিবেশনের সময় সেটা প্রকাশ পায়। তবে জেনে করি না, অজান্তেই ব্যাপারটা ঘটে। গানে বিশেষ কাউকে কখনও অনুসরণ করিনি। একসময় পশ্চিমা মেয়েদের পরিবেশনা দেখে ভালো লাগতো, ওদের স্বতস্ফূর্ততা উপভোগ করতাম। গান পরিবেশনের সময় সেগুলো আমাকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। সেটা নিজের মতো করে তা উপস্থাপন করেছি।

বাংলানিউজ : পাঁচ দশকে আপনার উল্লেখযোগ্য প্রাপ্তিগুলো কী কী?
রুনা :  সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি মানুষের ভালোবাসা। তাদের স্নেহ, আদর, শ্রদ্ধা। এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর হতে পারে না। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানি যে তিনি আমাকে এতো সুন্দর একটা উপহার (কণ্ঠ) দিয়েছেন। তার দেওয়া উপহারের মাধ্যমে এতো মানুষকে আনন্দ দিতে পেরেছি। আশা করি, ভবিষ্যতেও পারবো।    

বাংলানিউজ : এতদূর আসার পেছনে কণ্ঠ ছাড়া আপনার আর কোন যোগ্যতা বিশেষভাবে কাজে লেগেছে বলে মনে করেন? জীবনে চলার পথে কোনো দর্শন বা আদর্শকে লালন করেছেন?
রুনা :  গানের ব্যাপারে আমি খুব ডেডিকেটেড। গানটা আমার প্যাশন। টাকা আয়ের উদ্দেশ্য নিয়ে সংগীতে আসিনি। গান ভালো লাগতো, তাই গানকে ভালোবেসেছি। সে হিসেবে সাধনা করেছি। এখনও নিজেকে আরও ভালো করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কীভাবে নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়া যায় সে চেষ্টা করি। ডেডিকেশন, আন্তরিকতা, সততা, রেয়াজ, পরিশ্রমের কমতি রাখিনি। আমি সব ব্যাপারে খুঁতখুঁতে। আমি পেশাদারিত্বে বিশ্বাস করি, নিয়মানুবর্তিতায় বিশ্বাস করি। সব মিলিয়ে আমি শৃঙ্খলার মধ্যে চলি।    

বাংলানিউজ : দেখতে দেখতে ৫০ বছর কেটে গেলো। এই দীর্ঘ সংগীতজীবনে স্বর্ণালি সময় কিংবা ব্যর্থতাকে কীভাবে মোকাবেলা করেছেন?
রুনা :  ব্যর্থতা আমার জীবনে খুব একটা আসেনি। এজন্য নিজেকে ভাগ্যবতী মনে হয়। গান গাওয়ার জন্য কখনও কাউকে তোষামোদ করতে হয়নি। বরং যতো দিন গড়াচ্ছে, আমার প্রতি মানুষের আগ্রহ আরও বাড়ছে। যে ক’দিন গান করি এটা যেন থাকে সেই আশা করি। স্বর্ণালি সময়ের কথা যদি বলেন ষাট থেকে আশির দশকের কথা উল্লেখ করবো। প্রতিটি দশকেও ভালো গান পেয়েছি, পুরস্কারও এসেছে।

বাংলানিউজ : এমন কোনো ভুল করেছেন যেটা না করলে জীবনটা অন্যরকম হতে পারতো বলে মনে হয়?
রুনা :  মানুষ ভুল করলেই শেখে। (হেসে) আমিও অনেক ভুল করে শিখেছি। সেটাকে উদাহরণ হিসেবে রেখে সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। আর যা হয়ে গেছে সেগুলো নিয়ে আমি আর চিন্তা করি না। এখন বর্তমান আর ভবিষ্যৎ নিয়েই ভাবি।

বাংলানিউজ : আপনার কোনো অপূর্ণতা আছে?
রুনা :  না। আমি আল্লাহর রহমতে অনেক কিছু পেয়েছি। সবকিছু নিয়ে আমি খুব খুশি। শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিদেশেও সবখানে অনেক সম্মান ও ভালোবাসা পেয়েছি। আমার নিজেরও মাঝে মধ্যে অবাক লাগে ভেবে, এটা কি আমাকে নিয়েই হচ্ছে! তাই নিজেকে পরিপূর্ণ মনে করি।

বাংলানিউজ : কিংবদন্তি উপাধি উপভোগ করেন নিশ্চয়ই?
রুনা :  আমি সাধারণ ছিলাম, আছি এবং থাকবো। আমার পরিবার আমাকে কখনও তারকা হিসেবে দেখেনি। মা-বাবার কাছে আমি সবসময়ই সাধারণ মেয়ে ছিলাম। আমি বিরাট তারকা কিংবা বিরাট গায়িকা, এ বিষয়টা আমাকে কখনও ভাবতে দেওয়া হয়নি পরিবার থেকে। এখনও মানুষ চিনলে আমার আনন্দ হয়। প্রথম প্রথম যে আনন্দটা লাগত, এখনও একই রকম আনন্দ পাই। ভালো লাগাটা একই রকম আছে।

বাংলানিউজ : ভবিষ্যতে কী কী চান?
রুনা :  শিল্পী হিসেবে নিজের আরও উন্নতি করা। মানুষকে আরও ভালো গান উপহার দেওয়ার চেষ্টা করবো। যতদিন বেঁচে আছি মানুষের এই ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা যেন থাকে আমার প্রতি। এই একটাই আমার ইচ্ছে।

বাংলানিউজ : গানের বাইরে কোনো ইচ্ছা আছে?
রুনা :  গান গাওয়ার পাশাপাশি মানুষের সেবা করার চেষ্টা করি, সেটাই করে যাবো। যতদিন আমার পক্ষে সম্ভব সেটা করবো। আর ইচ্ছা ছিলো একটি ক্যান্সার হাসপাতাল গড়ার। সেটা কতোদূর কি হবে জানি না। দেখা যাক।  

বাংলানিউজ : বুদ্ধি প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে আপনি কাজ করেছেন। সার্কের শুভেচ্ছাদূতের দায়িত্ব পালন করেছেন। সামাজিক সচেতনতামূলক বিভিন্ন কাজে যুক্ত আছেন। রাজনীতি নিয়ে ভাবেন?
রুনা :  না। আমি রাজনীতি বুঝি না। আমি যেভাবে আছি সেভাবেই থাকতে চাই। সামাজিক সচেতনতামূলক কাজগুলো করে আনন্দ হয়। মানুষের সেবা করতে পারলে আমার ভালো লাগে।

বাংলানিউজ : এবার পুরস্কার প্রসঙ্গে আসি। ১৯৭৬ সালে ‘দি রেইন’, পরের বছর ‘যাদুর বাঁশি’, ১৯৮৯ সালে ‘অ্যাক্সিডেন্ট’,  ১৯৯৪ সালে ‘অন্তরে অন্তরে’, ২০১২ সালে ‘তুমি আসবে বলে’ এবং ২০১৩ সালে ‘দেবদাস’ ছবির জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেলেন। এবারের অনুভূতি কেমন?
রুনা : এবার যেহেতু সংগীতজীবনে আমার ৫০ বছর পূর্তি হলো, তাই এবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়াটাকে বিরাট ব্যাপার, আনন্দের ব্যাপার। আর এবার সাবিনা ইয়াসমিন ও আমি একসঙ্গে পুরস্কার পেলাম। এটা একটা ইতিহাস। এমন ঘটনা আগে কখনও হয়নি। সব মিলিয়ে খুবই ভালো লাগছে।

বাংলানিউজ : বাংলাদেশের ছবিতে ‘গানেরই খাতায় স্বরলিপি’ আপনার গাওয়া প্রথম গান। এটা জনপ্রিয় না হলে কি এ দেশে এসে প্রতিষ্ঠিত হওয়া সহজ হতো?
রুনা :  আমি বাঙালি মেয়ে বাংলা গাইবো না কেনো? দেশের প্রতি বরাবরই আমার টান ছিলো। ‘গানেরই খাতায় স্বরলিপি’ গানটি গাওয়ার আগেই করাচিতে থাকাকালে রেডিওতে কয়েকটি বাংলা গান রেকর্ড করেছিলাম। এর মধ্যে ‘নোটন নোটন পায়রাগুলো’, ‘আমি নদীর মতন কতো পথ ঘুরে’, ‘ওই দুলছে দেখো দোলনচাঁপা’ গানগুলো তার আগেই বাজছিলো রেডিওতে। সেগুলো এখনও অনেকে গায়। বাংলাদেশের শ্রোতাদের ভালোবাসা পেয়ে আমি খুব খুশি। একজন বাংলাদেশি হিসেবে আমি ধন্য।

বাংলাদেশ সময় : ১৮৪৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ৮, ২০১৫
জেএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

তারার ফুল এর সর্বশেষ