ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

তারার ফুল

রাজীব আশরাফের যাযাবর পাখনা

জনি হক, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪২৫ ঘণ্টা, জুন ১১, ২০১৫
রাজীব আশরাফের যাযাবর পাখনা রাজীব আশরাফ/ছবি: নূর/ বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

রাজীব আশরাফকে বাহ্যিকভাবে দেখে বেশিরভাগ মানুষই টের পায় না তার মেধার পরিধি! একটা ঘটনা জানা থাকলে ধরে নিন আপনি ওই দলের নন। ঘটনাটা গত বছরের।

পশ্চিমবঙ্গের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু ছাত্রের হাতে এক ছাত্রীর যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়ার ঘটনায় শিক্ষার্থীরা নেমে পড়ে রাস্তায়। পোস্টারে, দেয়ালে আর তাদের স্লোগানে ছিলো ‘হোক কলরব’। অর্ণবের গানের দু’টো শব্দে যে আগুন, তার গীতিকারের নাম রাজীব আশরাফ। তাকে অন্য সব গীতিকারের কাছ থেকে আলাদা করা যায় অনায়াসে। তার গানের শব্দ, কথা, বক্তব্য অন্যদের সঙ্গে মেলে না।

রাজীবের লেখা বেশিরভাগ গানই জনপ্রিয়। শিরোনামগুলো দেখলে মনে হতে পারে, ‘আরে গানটা তো শুনেছি!’ তালিকাটা ছোট নয়। আবার অতো বড়ও নয়। কিন্তু প্রতিটিই শ্রোতাপ্রিয়। রহস্যটা কী? হেসে উত্তর দিলেন, ‘রহস্য-টহস্য কিছু নেই। নির্মাতারা কোন তথ্যটা গানে আনতে চান তা জেনে নির্দিষ্ট আবেগ বা রোমান্সকে তুলে ধরার চেষ্টা করি শব্দে শব্দে। তবে ভালো গান লেখার জন্য পুরো গল্পটা শোনা খুব জরুরি। আর আমি নিজে সন্তুষ্ট না হলে কাউকে গান দেই না। ’

চলুন জানিয়ে দেই রাজীব কী কী গান লিখেছেন। অর্ণবেরগুলো আগে বলা যাক। ‘হোক কলরব’ অ্যালবামের ‘হোক কলরব’ ও ‘প্রকৃত জল’, ‘ডুব’ অ্যালবামের ‘ধূসর মেঘ’ ও ‘ঘুম’, ‘রোদ বলেছে হবে’ অ্যালবামের ‘রোদ বলেছে হবে’, ‘একটা মেয়ে’, ‘প্রতিধ্বনি’, ‘মন খারাপের একটা সকাল’ ও ‘কে আমি’, ‘খুব ডুব’ অ্যালবামের ‘ইট কাঠ পাথরের’ ও ‘যখন জোনাক জ্বলে’, ‘গুরুস অব লাভ’ অ্যালবামের ‘নাম ছিলো না’, অন্য একটি অ্যালবামের ‘বিভ্রম’। ‘ইট কাঠ পাথরের’ গানটি ব্যবহার হয়েছিলো এয়ারটেলের টেলিছবি ‘অরুণোদয়ের তরুণদল’-এ। একই টেলিছবিতে রাজীবের লেখা ও অর্ণবের ‘এই মন মেলেছে ডানা’ গানটি আড়ং তাদের একটি প্রচারণায় ব্যবহার করেছে।

মুঠোফোন প্রতিষ্ঠান এয়ারটেল প্রযোজিত প্রায় সব টেলিছবিতে গান লিখেছেন রাজীব। সবটারই সুর=-সংগীত স্টুডিও ফিফটি এইটের। সেগুলো হলো- ‘জলকণা উড়ে যায়’ (ভালোবাসি তাই), ‘ভালোবাসি তাই ভালোবেসে যাই’ (ভালোবাসি তাই ভালোবেসে যাই), ‘এই আমার শহর’ (অ্যাট-এইটিন অলটাইম দৌড়ের ওপর), ‘যাযাবর পাখনা’ (মাংকি বিজনেস), ‘এই যাত্রার শেষ কোথায় অজানা’ (ইউ-টার্ন)।

স্টুডিও ফিফটি এইটের দলনেতা আরাফাত মহসিন পরিচালিত ‘জোনাক পোকা’ টেলিছবিতে ‘নিঝুম রাতের তারা’, আদনান আল রাজীবের ‘মিডেল ক্লাস সেন্টিমেন্ট’ নাটকে ‘প্রহর’, ওল্ড স্কুলের মোবাশ্বের চৌধুরীর সুর-সংগীতে তারিনের কণ্ঠে ‘কালো মখমল’ নাটকের গানও রাজীবের লেখা। এ ছাড়া লাবিক কামাল গৌরবের একক অ্যালবামে তার লেখা গান থাকবে। এসবের আগে হাবিবের সুর-সংগীতে চ্যানেল ওয়ানের থিম সং ‘সম্ভাবনার দুয়ার’ রাজীবের লেখা। বাংলালিংক, মোজো, সেভেন আপ-সহ কয়েকটি বিজ্ঞাপনচিত্রের জিঙ্গেল লিখেছেন।

চলচ্চিত্রের গানও লিখছেন রাজীব। স্টুডিও ফিফটি এইটের সুর-সংগীতে রেদওয়ান রনির ‘আইসক্রিম’ ছবিতে অর্ণব গেয়েছেন রাজীবের লেখা ‘বোকা চাঁদ’। এর আগে অর্ণব অন্যের সুরে ঢাকার ছবিতে গাননি। অমিতাভ রেজার ‘আয়নাবাজি’ ছবিতেও অর্ণব নিজের সুর-সংগীতে একটি গেয়েছেন।

লেখালেখির উৎস কী? প্রশ্নটা শুনে একটু ভেবে রাজীব উত্তর দিলেন, ‘আমি সবকিছুর ভেতর দিয়ে যাই। সবকিছুই আমাকে এক ধরনের অভিজ্ঞতা দেয়। আমি প্রতিটি জিনিস টুকে রাখি। ফেসবুকে প্রতিদিনই কিছু না কিছু লিখি। ছন্দ বা অন্ত্যমিল শিখতে গিয়েও অনেক লিখেছি। তাই আমি গদ্য লিখলেও পদ্য হয়ে যায়! আমার বেশিরভাগ গানই কবিতা হিসেবে লিখেছি আগে, গান ভেবে লিখিনি। সুরারোপ করার পর তা গানে রূপান্তরিত হয়েছে। এসব কথাকে আমার ব্যক্তিকেন্দ্রিক অন্তর্গত রোদন বলা যায়। এটা সুর করার পর গান হয়ে যায়। তাই আমাকে কেউ হুটহাট লিরিক দিতে বললে পারি না। ’

ছোটবেলায় খেলাধুলায় আগ্রহ ছিলো না রাজীব আশরাফের। স্কুলের বাইরের অবসর সময়টুকু কাটাতেন বই পড়ে। তখন থেকেই নিজের মধ্যে লেখালেখির ইচ্ছে জন্মেছিলো। উত্তর কাফরুলে উত্তরসূরী নামে একটি সংগঠন ছিলো। সেখানে অন্য ছেলেমেয়েদের পাশাপাশি দলবেঁধে গিয়ে নাচ, গান, আবৃত্তির মতো সংস্কৃতি চর্চার সুযোগ পেয়েছিলেন। লুৎফর রহমান রিটন সম্পাদিত ছোটদের কাগজে তার প্রথম লেখা ছাপা হয়। এরপর বিভিন্ন পত্রিকায় লেখালেখি করেছেন। এখন তো দেশসেরা গীতিকারদের তালিকায় যুক্ত হয়ে গেছে তার নাম।

গীতিকার হিসেবে পাওয়া সম্মানী নিয়ে রাজীব কি খুশি? ‘কিছু অসন্তুষ্টি তো আছেই। তবে আমাদের শিল্পীদেরকেও কিন্তু ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। অর্ণব আমার জন্য এ কাজটা করে। একই গানের জন্য ওর কাছ থেকে আমি কিন্তু দু’বারও সম্মানী পেয়েছি। আমি মনে করি, সময়ের বাংলা গান ও ভবিষ্যতের বাংলা গানকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য দরকার সুষ্ঠু আইন। ’

রাজীব বিজ্ঞাপনও বানিয়েছেন। এ তালিকায় উল্লেখযোগ্য- বাংলালিংক, ওয়ারিদ, এয়ারটেল, টুডে টি, টুডে মিল্ক, এপি নুডলস প্রভৃতি। বাংলাদেশ গেমসের জন্য বানিয়েছিলেন তথ্যচিত্র। স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বানিয়ে হাতটা আরও পাকিয়েছেন। এগুলো হলো- ‘জলচর’ (ঋতু সাত্তার), ‘বিস্ময়’ (বাংলাদেশ শর্টফিল্ম ফোরামের ২০ বছর পূর্তি লোগো ফিল্ম) এবং ‘অ্যাকুরিয়াম’। আগামীতে ‘নক্ষত্রের পতন’ নামে একটি ছবি পরিচালনা করবেন। একজন পকেটমার, হিজড়া, বিহারী ছেলে, তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিক ও শৈশবে সদরঘাটে হারিয়ে যাওয়া তরুণকে ঘিরে এর গল্প। তাদের বেঁচে থাকার সংগ্রামই মূলত তুলে ধরা হবে এতে। কোরবানি ঈদের পর প্রজেক্ট প্রপোজালের সঙ্গে সংযুক্তির জন্য কিছু অংশের চিত্রায়ন করবেন বলে জানালেন।

শুধু লেখা বা নির্মাণই নয়, রাজীব আশরাফ অভিনয়ও করেছেন নাটক-টেলিছবিতে। এর মধ্যে আছে আশুতোষ সুজনের ‘টিনের তলোয়ার’, অমিতাভ রেজার রচনা ও আবিদ মল্লিক পরিচালিত ‘কিশোর ছবি আঁকতে পারে’, মনোয়ার কবিরের রচনা ও অনিমেষ আইচের ‘হলুদ’, নূরুল আলম আতিকের ‘মজিদের টেলিভিশন’, অমিতাভ রেজার পরিচালনায় ‘একটা ফোন করা যাবে প্লিজ’ প্রভৃতি।

গদ্য-পদ্য লেখা আর ক্যামেরার কারিকুরির বাইরে এশিয়াটিকে সৃজনশীল বিভাগে কর্মরত আছেন রাজীব আশরাফ। তার যাযাবর পাখনা ভবঘুরে নয়, সেই ডানা নানাদিকে উড়ে-ঘুরে বিচরণ করে ঠিকই কোথাও না কোথাও গোছানো! এসব শুনে বিনয়ী হাসি দিয়ে নিজেরেএকটা ইচ্ছের কথা জানালেন, ‘কবিতার বই বের করতে চাই। গল্পের বইও বের করতে চাই। ’

বাংলাদেশ সময় : ১৪১৬ ঘণ্টা, জুন ১১, ২০১৫
জেএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

তারার ফুল এর সর্বশেষ