ইন্দির ঠাকুরণ অতিশয় বৃদ্ধা। বিধবা।
এই খানিকটা নিশ্চল, অসহায়, আশ্রয়হীন, সর্বজয়ার চোখে স্বার্থপর ইন্দির ঠাকুরণ ভারতীয় উপমহাদেশের নারীর প্রতীক তো বটেই, প্রতিনিধিত্ব করে তৎকালীন সমাজ বাস্তবতাও। ইন্দির ঠাকুরণ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন চুনিবালা দেবী। তার সরল-স্বাভাবিক অথচ আশ্চর্য অভিনয় ক্ষমতা তো লোকে দেখেছেই ‘পথের পাঁচালী’তে, দেখছে এখনও, দেখবে অনন্তকাল। সত্যজিৎ রায় এই বৃদ্ধাকে কোথা থেকে, কীভাবে পেলেন, সে একটা গল্প বৈকি!
আজকে যখন সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ ৬০-এর চৌকাঠে পা দিতে যাচ্ছে, ক’দিন পরেই বয়স ৬০ হবে, তখন আমরা ইন্দির ঠাকুরণ মানে চুনিবালা দেবীর গল্প বলতে চাই আরেকবার। এই বৃদ্ধা ছবিটির জন্য এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে স্বয়ং সত্যজিৎ বলে গেছেন ‘চুনিবালা দেবীকে নিয়ে কাজ করার সময় বারবার এই কথাটাই মনে হয়েছে যে, এঁর সন্ধান না পেলে আমাদের পথের পাঁচালি হতো না। ’ তার মুখে এমন কথা এলো কেনো? সেটা জানার জন্য আমাদের ফিরে যেতে হবে ‘পথের পাঁচালী’র শুরুতে।
ইন্দির ঠাকুরণকে পাওয়া যাচ্ছে না
সব প্রস্তুত। অপু, দুর্গা, হরিহর, সর্বজয়া- এ চরিত্রগুলোতে কারা কাজ করবেন; সেটা নির্বাচন হয়ে গেছে। বাকি কাস্টিংগুলোও মোটামুটি সত্যজিৎ রায়ের মাথায় আছে। শুধু নেই ইন্দির ঠাকুরণ। বিভূতিভূষণ যেভাবে চরিত্রটির বর্ণনা দিয়েছেন উপন্যাসে, ‘পঁচাত্তর বৎসরের বৃদ্ধা, গাল তোবড়াইয়া গিয়াছে, মাজা ঈষৎ ভাঙিয়া শরীর সামনের দিকে ঝুঁকে পড়িয়াছে। দূরের জিনিস আগের মতো ঠাহর হয় না’- এমন চরিত্রের কাউকে পাওয়া মুশকিলই। বিশেষ করে সত্যজিৎ আগেই যখন পত্রিকায় ঘোষণা দিয়ে ফেলেছেন, সিদ্ধান্তও পাকাপাকি যে, ‘এ ছবিতে মেকআপ ব্যবহার করা হবে না। ’ আর তাছাড়া চেহারাই তো সবটা নয়। অন্য সমস্যাও আছে। এতো বয়স্ক একজন মহিলা, শুটিংয়ের ধকল সহ্য করতে পারবেন কি-না, সংলাপ ঠিকঠাক মুখস্ত রাখতে পারবেন কি-না, এসব ব্যাপারও তো আছে। এদিকে ইন্দির ঠাকুরণকে রেখেই শুরু হয়ে গেছে ছবির কাজ। ভেতরে ভেতরে খোঁজ চলছে। খোঁজ মিলছে না, সে চিন্তাও আছে।
চরিত্রের খোঁজে পাইকপাড়ায়
‘পথের পাঁচালী’র সেজো ঠাকুরণ যিনি, রেবা দেবী, তিনি সত্যজিৎ রায়কে খোঁজ জানালেন একজন বৃদ্ধার। তার নাম চুনিবালা দেবী। নিভাননী দেবীর মা। এক রোববার। সকালবেলা। ঠিকানা জোগাড় করে সত্যজিৎ রায় ছুটলেন পাইকপাড়ায়, নিভাননী দেবীর বাড়িতে। বর্ণনা ঠিকঠাক। যেভাবে ইন্দির ঠাকুরণের বর্ণনা উপন্যাসে দিয়েছেন বিভূতিভূষণ। এখন দেখতে হবে বাদবাকি বিষয়গুলো। সত্যজিৎ জানতে চাইলেন, ‘আপনি ছড়া জানেন? আবৃত্তি করতে পারেন?’ উত্তর, ‘ঘুমপাড়নি মাসিপিসি’ ছড়ার দশ-বারো লাইনের বেশি আমি কখনও শুনিনি। ’ চুনিবালা ছড়াটির আদি সংস্করণ পড়ে গেলেন গড়গড় করে। অর্থাৎ, সংলাপ মুখস্ত রাখতে পারবেন কি-না- এ আশংকা আর থাকলো না। পরের প্রশ্ন, ‘এখান থেকে ভোর ছ’টায় রওনা হয়ে পনেরো মাইল দূরে গ্রামে গিয়ে শুটিং করে আবার সন্ধ্যেবেলা সেই পনেরো মাইল পথ মোটরে ফিরে আসতে পারবেন?’ চুনিবালার উত্তরে অনেকখানি দৃঢ়তা, ‘খু-উ-ব’।
একেই বলে আন্তরিকতা!
ইন্দির ঠাকুরণ, মানে চুনিবালা দেবী, একদিন সত্যজিৎকে বলেছিলেন, ‘আপনারা যখন তরুণীকে মেকআপ করে বুড়ি না সাজিয়ে আমাকে বেছে নিয়েছেন, তখনই বুঝেছি কোনদিকে আপনাদের ঝোঁক। ’ অর্থাৎ চুনিবালা কিন্তু ঠিকই সত্যজিতের কাজের ধরণটা ধরে ফেলেছিলেন। শুরুতেই। তাই তিনি সবসময় সচেতন থাকতেন, শুধু ক্যামেরার সামনের সময়টুকুতেই নয়। বাইরেও, নানান খুঁটিনাটি ব্যাপারে। গল্পে ইন্দিরের তো স্বভাব থাকে যে, ছেঁড়াফাঁড়া শাড়িতে গিঁট বেঁধে চালিয়ে নেওয়া। অবশ্য স্বভাবও বলা চলে না। এ ছাড়া তার উপায়ও নেই। ইউনিট থেকে চুনিবালাকে একটা ছেঁড়া থান দেওয়া হলো। বলাও হলো, ‘আপনি ইচ্ছেমতো গেরো বেঁধে ছিদ্রগুলোর একটা ব্যবস্থা করে নেবেন। ’ কিছুদিন কাজের পর ছেঁড়াশাড়িটি এমন অবস্থায় পৌঁছালো, ওটা আর পরার মতো থাকলো না। একদিন সত্যজিৎ রায় শুনলেন, চুনিবালা কাকে যেন বলছেন, ‘এ কাপড়ের যে দশা এতে লজ্জা ঢাকা যায় না। ’ তড়িঘড়ি করে আরেকটা থান এনে ছেঁড়ার মাত্রা খানিকটা কমিয়ে তাকে দেওয়া হলো। কিন্তু ইন্দিরের বেশে পরদিন যখন চুনিবালা সেটে এলেন, নতুন নয়, পরনে পুরনো থানটাই!
একজন বৃদ্ধার আশ্চর্য স্মৃতিশক্তি
মাঝে মধ্যে টিমের তো ভুল হতোই। হয়ও। হতো না চুনিবালার। একেবারে নিখুঁত কন্টিউনিটি মনে রাখতেন তিনি। ‘আমার ডান হাত যে ভিজে ছিল সেদিন?’
‘কই, আমার মুখে ঘাম দিলেন না?’
‘এ শটে ত আমার গায়ে চাদর থাকবে না। ’
‘আমার পুঁটলি কি ডান হাতে ছিলো? না, পুঁটলি বাঁ-হাতে দিন। ঘটি ডান হাতে...’ প্রায়ই এ ধরণের খুঁটিনাটি অথচ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলো ধরিতে দিতেন চুনিবালা।
দু’টো মৃত্যুদৃশ্য
চুনিবালা সত্যজিৎকে বললেন, ‘বইয়ে আছে বুড়ি চণ্ডীমণ্ডপে মরছে। আপনি দেখাচ্ছেন বাঁশবনে। ধার্মিক বুড়ি- তার কি বাঁশবনে মরাটা ভালো দেখায়?’ বই, মানে বিভূতিভূষণের মূল উপন্যাসে এটা আছে। চুনিবালা সেটা পড়েছেন, অথবা শুনেছেন কারও কাছ থেকে। সত্যজিৎ যখন উপন্যাস থেকে চলচ্চিত্র বানাচ্ছেন, তখন কিছু পার্থক্য তো এসেই যাবে। ঘটনার, স্থানের, মানসিকতার। চুনিবালা সবই মেনেছিলেন, কেবল এই মৃত্যুর বেলায় এসে খানিকটা আপত্তি করে বসলেন। সত্যজিৎ বোঝাতে চেষ্টা করলেন, ‘বাঁশবনে মৃতদেহের আবিষ্কার অপু-দুর্গার শিশুমনে যে ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে, ছবি ও নাটকের দিক থেকে তার মূল্য অনেক। ’ চুনিবালা মানলেন।
দৃশ্য এ রকম- বাগানে বুড়ি হাঁটুতে মাথা গুঁজে বসে আছেন। দুর্গা বুড়িকে ওইভাবে বসে থাকতে দেখে মনে করে যে, বুড়ি ঘুমিয়েছে। ফলে সে কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দেয়। বুড়ির মৃতদেহ ধপ করে মাটিতে পড়ে। এই দৃশ্য কতোখানি বাস্তব হয়ে উঠবে, কতোখানি আবেদন সৃষ্টি করবে; সেটা সম্পূর্ণ নির্ভর করছে চুনিবালার ওপর। সত্যজিৎ লিখছেন, ‘তিনি যদি গুরুতর আঘাতের সম্ভাবনা অগ্রাহ্য করে তার দেহকে মাটিতে ফেলতে পারেন, তবেই শট-এর ও অভিনয়ের সার্থকতা। ’ চুনিবালা কতোখানি স্বার্থকভাবে, গুরুতর আঘাতের সম্ভাবনাকে কতোখানি হেলায় উড়িয়ে দিয়ে অভিনয়টা করেছিলেন, সেটার প্রমাণ তো আমরা ‘পথের পাঁচালী’তে পাই-ই।
আরেকটা ঘটনা। এটাও মৃত্যুর। ইন্দির ঠাকুরণ মারা গেছেন। তার শবযাত্রা। নিয়ে যাওয়া হচ্ছে শ্মশানের দিকে। দৃশ্যটি এমন। সকাল পর্যন্ত চুনিবালা জানেন না, এমন একটি শট তাকে দিতে হবে। ভোর পাঁচটা। মেঠো রাস্তায় শটের তোড়জোড় চলছে। ট্যাক্সিতে করে পৌঁছালেন চুনিবালা। সত্যজিৎ রায় ‘কোনোমতে সাহস সঞ্চয় করে’ তাকে বললেন, ‘আজ আপনাকে খাটে চড়াবো। ’ চুনিবালা বিচলিত হলেন না। রাগলেনও না- ‘বেশ তো, এ অভিজ্ঞতা আর ক’জনের হয়? আমার আপত্তি নেই। ’
বাঁশের খাট। মাদুর বিছানো হলো তার ওপর। চুনিবালাকে শুইয়ে, চাদরে মুড়ে, দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলা হলো। তারপর শুরু হলো কাজ। আসল ঘটনা এরপরেই। শট শেষ। খাট নামানো হয়েছে মাটিতে। বাঁধনও খুলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু চুনিবালা দেবীর আর নড়চড় নেই। ব্যাপার কী? অজানা আশঙ্কায় সবাই পরস্পরের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করেন। খারাপ কিছু ঘটলো না তো! হঠাৎ ধড়ফড় করে উঠে বসলেন চুনিবালা, ‘শট হয়ে গেছে? কই, আমাকে তো কেউ বলেনি! আমি তাই মড়া হয়ে পড়ে আছি। ’ ঘটনা শেষ করে সত্যজিৎ রায় বলছেন, ‘আশ্চর্য অভিনয়!’
বাংলাদেশ সময়: ১৯১৩ ঘণ্টা, আগস্ট ১৯, ২০১৫
কেবিএন/জেএইচ