কক্সবাজার থেকে ফিরে: অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি পৃথিবীর বৃহৎ ব-দ্বীপ বাংলাদেশ। যেখানে মিলবে সমতলে হাঁটার সুখ, পাহাড়ে ট্র্যাকিংয়ের চ্যালেঞ্জ, নদী সাঁতরে ওপার ছোঁয়ার দারুণ রোমাঞ্চতা।
নদীমাত্রিক দেশটির সব নদীই গিয়ে মিশেছে দেশটির দক্ষিণের বঙ্গপোসাগরে। আর এই সাগরের কোল ঘেষেই রয়েছে কক্সবাজারের মতো একটি নয়নাভিরাম শহর। পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত যার গর্ব।
কক্স সাহেবের বাজার থেকে কক্সবাজার, বাংলা ব্যাকরণে এমনটা শেখানো হলেও ইতিহাস বলছে এই শহরের আদি নাম ‘প্যানোয়া’।
আর সেই ইতিহাস যেমন সুন্দর তেমন মোহনীয়, তারচেয়েও বেশি সমৃদ্ধ।
প্যানোয়া নামের আক্ষরিক অর্থ ‘হলুদ ফুল’। আর এর আরও একটি প্রাচীন নাম হচ্ছে ‘পালঙ্কী’। সেই পালঙ্কী থেকে এখনকার কক্সবাজারের পথ চলার সুদীর্ঘ ইতিকথা জানাতেই আজকের এই প্রয়াস।
ইতিহাস বলছে, ১৬১৬ সালে মুঘল অধিগ্রহণের আগে পর্যন্ত 'কক্সবাজার' জেলাসহ চট্টগ্রামের একটি বড় অংশ আরাকান রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। মুঘল সম্রাট শাহ সুজা পাহাড়ি রাস্তা ধরে আরাকান যাওয়ার পথে কক্সবাজারের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হন এবং এখানেই অস্থায়ী দূর্গ স্থাপনের আদেশ দেন। তার যাত্রাবহরের প্রায় একহাজার পালঙ্কী কক্সবাজারের চকরিয়ার ডুলাহাজারা নামের স্থানে অবস্থান নেয়। ডুলহাজারা অর্থ হাজার পালঙ্কী। মুঘলদের পরে ত্রিপুরা, আরকান তারপর পর্তুগিজ ও ব্রিটিশরা এই এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয়। আর কক্সবাজার নামটি আসে ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স নামে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক অফিসারের নাম থেকে।
তার আগে কক্সবাজারের নাম ছিল পালঙ্কী। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অধ্যাদেশ- ১৭৭৩ জারি হওয়ার পর ওয়ারেন্ট হোস্টিং বাংলার গভর্নর হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন। তখন হিরাম কক্স পালঙ্কীর মহাপরিচালক নিযুক্ত হন। ক্যাপ্টেন কক্স আরাকান শরণার্থী এবং স্থানীয় রাখাইনদের মধ্যে বিদ্যমান হাজার বছরের পুরোনো সংঘাত নিরসনের চেষ্টা করেন এবং শরণার্থীদের পুনর্বাসনে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি সাধন করেন।
কিন্তু কাজ পুরোপুরি শেষ করার আগেই ১৭৯৯ সালে তিনি মারা যান। তার পুনর্বাসন অবদানকে স্মরণীয় করে রাখতে একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং এর নাম দেওয়া হয় কক্সসাহেবের বাজার। আর কক্সবাজার থানা প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৫৪ সালে এবং পৌরসভা গঠিত হয় ১৮৬৯ সালে।
২ হাজার ৪৯১.৮৬ বর্গ কিলোমিটার বা ৯৬২ দশমিক ১১ বর্গমাইলের এই কক্সবাজার- বিভাগীয় চট্টগ্রাম শহর থেকে ১৫২ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। এর উপজেলাসমূহের মধ্যে রয়েছে কক্সবাজার সদর উপজেলা, উখিয়া, কুতুবদিয়া, চকোরিয়া, টেকনাফ, মহেশখালী, রামু ও পেকুয়া।
ঢাকা থেকে এর দূরত্ব ৪১৪ কিলেমিটার। এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পর্যটনকেন্দ্র। সারি সারি ঝাউবন, বালুর নরম বিছানা, সামনে বিশাল সমুদ্র এসব নিয়েই মনোরম কক্সবাজার। বিশাল নীল জলরাশি আর সমুদ্রের গজর্ন নিয়ে এই কক্সবাজার। যেখানে মাইলকে মাইল শুধু সৈকত, যা ১২০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত।
সবুজ-শ্যামল প্রকৃতি ঘেরা সৌন্দর্য্যমণ্ডিত এই জেলার ওপর দিয়েই বয়ে গেছে মাতামুহুরী, বাঁকখালী, রেজু, কুহেলিয়া ও নাফ নদী। পর্যটন, বনজ সম্পদ, মৎস্য, শুঁটকি মাছ, শামুক, ঝিনুক ও সিলিকা সমৃদ্ধ বালুর জন্য কক্সবাজার জেলা দেশ-বিদেশের ভ্রমণবিলাসীদের কাছে সব সময়ের জন্য অন্যতম আনন্দ-বিনোদন কেন্দ্র।
চট্টগ্রাম বিভাগের এই কক্সবাজার জেলা নানান স্বাদের মাছের জন্যও বিখ্যাত। তাই এখানকার প্রধান প্রধান উৎপাদিত পণ্যের মধ্যে রয়েছে সামুদ্রিক মাছ, শুঁটকি ও চিংড়ি। এছাড়া পোনা, ধান, পান, সুপারি ও লবন উৎপাদন হয়ে থাকে এই জেলায়।
কক্সবাজারের অনুপম সৌন্দর্য ও চিত্তাকর্ষক স্থানসমূহ:
সুবিশাল কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতই মূলত কক্সবাজারের প্রধান পর্যটন কেন্দ্র। তবে এর আরও দর্শনীয় এবং ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থানসমূহ আছে। এর মধ্যে রয়েছে চিত্তাকর্ষক মেরিন ড্রাইভ, সবুজ প্রকৃতি ঘেরা হিমছড়ি, ইনানী সৈকত, সেন্টমার্টিন দ্বীপ, সোনাদিয়া দ্বীপ, বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক, টেকনাফ জালিয়ার দ্বীপ, রামু সীমা বিহার ও একশ ফুট সিংহ গজ্জা, শাহ ওমরের সমাধি, আদিনাথ মন্দির, মাথিন কূপ, কুতুব আউলিয়ার, সমাধি, রামকোট হিন্দু মন্দির, রামকোট বুদ্ধ কেয়াং, লামার পাড়া বুদ্ধ কেয়াং এবং ঐতিহাসিক একগম্বুজ মসজিদ।
এরপরের পর্বে বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য থাকবে কক্সবাজারের বিখ্যাত শুঁটকি নিয়ে করা একটি সচিত্র প্রতিবেদন।
আরও পড়ুন >>>প্রকৃতিতে হেমন্তের পরশ, সাগরে ছুটছেন পর্যটকরা
বাংলাদেশ সময়: ১৬২৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৫, ২০২৩
এসএস/এসএএইচ