গাড়িতে যাওয়ার সময় ভাবছিলাম হয়তো আগের মতোই দেখবো, সামান্য কিছু হেরফের হতে পারে! কিন্তু ভাবনা ও বাস্তবতার মধ্যে বিশাল ফারাক। এ যেনো এক নতুন নীলাচল, চোখ ধাঁধানো পরিবর্তন।
নতুন নতুন বিষয় সংযোজন করা হয়েছে। এক কথায় বলতে গেলে, ২০১৮ এর নীলাচল অনেক পরিণত, পরিপাটি ও বিস্তৃত। আগে কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল আর এখন জেলা প্রশাসনের আন্তরিকতায় সেগুলো কাটিয়ে পূর্ণতা পেয়েছে।
২০১৬ সালে পাহাড়ের চূড়ায় গোলঘরের কোল ঘেঁষে চেয়ার পাতা, দু'দিকে ভিউ পয়েন্ট, আর ছিল ফুল ও শোভাবর্ধণকারী বৃক্ষরাজি। পূর্বদিকে অনেকদূর পর্যন্ত বিস্তৃত পাহাড়টির উত্তর কোল ঘেঁষে ছিল চারটি কটেজ।
আর তেমন কিছুই ছিল না, একবারে পূর্বকোণে ছিল একটি গোলঘর। এখন পূর্বদিকে পুরো পাহাড়টিকে নিখুঁত করে সাজানো হয়েছে। সকালে সূর্যোদয় দেখা এবং ছবি ধারণের জন্য স্থাপন করা হয়েছে নব দিগন্ত নামের ভিউ পয়েন্ট।
এখানে দাঁড়িয়ে বগলদাবা করতে পারবেন উদীয়মান সূর্যকে। সঙ্গে মেঘের স্পর্শ আপনাকে কল্পনার জগতে নিয়ে যাবে। এখানে নেই কোনো যন্ত্রের বিদঘুটে শব্দ, কর্ণপাত হবে শুধুই পাখির কিচির-মিচির ডাক। আপনার মনকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে শৈশবের সোনালী অতীতে।
শুধু পূর্বদিকে শ্রীবৃদ্ধিতেই থেমে নেই নীলাচল! পশ্চিমেও সম্প্রসারণ চোখে পড়ার মতো। নির্মাণ করা হয়েছে বেশ কয়েকটি ভিউ পয়েন্ট, ওর্য়াকওয়ে, পাহাড়ের গা ঘেঁষে সিঁড়ি আরও কতো কী? এখানে বসে দেখতে পাবেন থরে থরে সাজানো পাহাড়, বান্দরবান শহর এবং দূরের বসতি।
এখানেও নির্মল বাতাস আপনার মনকে বিমোহিত করে তুলবে। আগে এখানে খাবারের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। এতে পর্যটকদের বেকায়দায় পড়তে হতো, খাবারের জন্য যেতে হতো বান্দরবান শহরে। এখন সেই সমস্যাও দূরীভূত হয়েছে, চালু করা হয়েছে উন্নতমানের রেস্তোরাঁ। যেখানে পেটপূজার পাশাপাশি রয়েছে সভা, সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামের দারুণ আয়োজন।
অবশ্য ২০১৬ সালে ভিজিটের সময়ে এই পরিবর্তনের বিষয়ে আভাস দিয়েছিলেন তৎকালীন বান্দরবান জেলা প্রশাসক দিলীপ কুমার বণিক ও এনডিসি হোসাইন মুহাম্মদ আল-মুজাহিদ।
তারা জানিয়েছিলেন, কিছুদিন পর এলে আরও অনেক পরিবর্তন দেখতে পাবেন। তখন মনে মনে ভেবেছিলাম এটা হয়তো কথার কথা, কতজন কত কথা বলে! কিন্তু এবার এসে যা দেখলাম তাতে মনে হলো পর্যটনবান্ধব এই দুইকর্তা মনে হয় একটু কমেই বলেছিলেন।
তারা শুধু নীলাচল নয়, পুরো জেলার চিত্রই বদলে দিয়েছেন। ঠিক গল্পের দৈত্য যেমন রাতারাতি রাজপুরী তৈরি করেন মালিকের হুকুমে। তেমনি পর্যটনের দমকা হাওয়া যেনো সবকিছু এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়েছে।
বর্তমান জেলা প্রশাসন এবং এনডিসি আলী নূরও বেশ তৎপর পর্যটনসমৃদ্ধ জেলাটিকে এগিয়ে নেওয়ায়। পর্যটন স্পটগুলোর শ্রী বৃদ্ধিতে নিত্যনতুন আইডিয়াকে বাস্তবায়নে মনোনিবেশ করছেন তারা।
২০১৬ সালে বাংলানিউজের চোখে নীলাচলের প্রাকৃতিক রূপ ছিল এমন- ‘পাহাড়ের সঙ্গে মেঘের মিতালী! তাই বুঝি কিছুক্ষণ পরপর পেজা তুলার মতো মেঘ উড়ে এসে পাহাড়কে ঝাপটে ধরছে। অটল অবিচল পাহাড় যেন মেঘের এই দুষ্টুমী উপভোগ করছে। কতকাল, কত যুগ ধরে চলছে তাদের খেলা– তার কোনো ইয়াত্তা নেই!’
আর পাহাড়ের সঙ্গে মেঘের এই লুকোচুরি খেলা দেখতে প্রতিদিন হাজার হাজার পযর্টক হাজির হন বাংলাদেশের ভূ-স্বর্গ নীলাচলে।
বান্দরবান শহর থেকে ৫ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত নীলাচলে দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টাই চলে পাহাড়-মেঘের এই লুকোচুরি খেলা।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় দুই হাজার ফুটের বেশি উঁচু নীলাচল পাহাড়ের মন যখনই খারাপ হয়, যখনই সে মুখ ভার করে থাকে- তখনই কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসে একদল মেঘ; যে কিনা পাহাড়ের শরীরে বুলিয়ে দেয় কোমল পরশ।
কখনও বা খেলার ছলে পাহাড়ের ঢাল থেকে চূড়া পযন্ত এঁকে দেয় রংধনু। যা আমাদের এ সফরেই চোখে পড়লো। নীলচাল থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে যেনো পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে গড়ে ওঠা বসতির উপর দিয়ে চলে গেছে সাত রঙে রাঙনো এই ধনুক!
এরই পাশে বৃত্তাকারে তৈরি হওয়া একটি মেঘের কুণ্ডলীর ভেতর দিয়ে ঠিকরে পড়ছে সূর্যের কিরণ। দূর থেকে মনে হচ্ছিল অন্ধকারের রাজ্যে কে যেন পাঁচ ব্যাটারির একটি টর্স লাইট জ্বেলে দিয়েছেন।
আগে যারা নীলাচল ঘুরে গেছেন, আর ভাবছেন আমি তো নীলাচল দেখেছি। আর তো দেখার কিছু নেই, তাদের উদ্দেশ্যে বলা যায়, এমন সিদ্ধান্ত নেওয়াটা মনে হয় যুক্তিযুক্ত হবে না।
শুধু নীলাচল নয়, মেঘলা থেকে জীবননগর, চিম্বুক থেকে প্রান্তিক লেক শৈলপ্রপাত সবখানেই পরিবর্তনের হাওয়া। যেন হাত বাড়িয়ে ডাকছে এসব পর্যটন স্পট।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৫৩ ঘণ্টা, মার্চ ১৪, ২০১৮
এসআই/এমএ