ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

পর্যটন

পর্ব-৩

ঝরনার শিলং

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩, ২০১৮
ঝরনার শিলং বাংলাদেশে দিকে যাচ্ছে ঝরনার পানি

[পূর্বপ্রকাশের পর]
মেঘালয় আর স্বচ্ছ জল যেন মিলেমিশে একাকার। রাস্তার পাশে, অনেক দূরে, ছোট-বড়-মাঝারি আকৃতির ঝরনা বিরামহীন ঝরছে। চাইলে একটি ঝরনা এক নজরে দেখে অন্য স্পটে চলে যাওয়া যায়। আবার যারা প্রকৃতিপ্রেমী, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঝরনার দিয়ে তাকিয়ে থাকলেও বোধহয় তাদের মন তৃপ্ত হবে না। 

কিছু ঝরনা অবিশ্বাস্য রকমের সুন্দর। যেন রূপকথার রাজ্য থেকে উঠে এসেছে।

ডিজনির সিনেমাতেই শুধু তাদের দেখা মেলে। বোরহিল ফলস এরকমই একটি ঝরনা। এর অবস্থান মেঘালয়-বাংলাদেশ সীমান্তে, পাহাড়ের নিচের অংশে। বিপুল পানি বোরহিল ফলস দিয়ে প্রবল গর্জনে গড়িয়ে পড়ছে। বর্ষা মৌসুম হওয়ায় ঝরনাটি তার রাজকীয় সৌন্দর্য পূর্ণরূপে মেলে ধরেছে।  

বোরহিল ফলসযতক্ষণ তার সামনে ছিলাম এক পলকে তাকিয়ে ছিলাম। যেন সম্মোহিত হয়ে গেছি। ঝরনাটির অস্বাভাবিক সৌন্দর্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছে আরেকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। মূল সড়ককে সংযুক্ত করা একটা সেতুর উপর থেকে বোরহিল ঝরনা দেখতে হয়। এই সেতুর একদিকে খাসি পাহাড় আর বোরহিল, অন্যদিকে বাংলাদেশের সমতল ভূমি। ঝরনার পানি সেতুর নিচ দিয়ে প্রবল গর্জনে ছুটে চলেছে বাংলাদেশের দিকে। সে এক অসাধারণ দৃশ্য।
দূরে  দেখা যায় বাংলাদেশ
আরেকটি দারুণ সুন্দর ঝরনা এবং তার সংলগ্ন সেতুও সিলেট থেকে পরিষ্কার দেখা যায়। সেই ঝরনাটি বোরহিল ফলস থেকে ডাউকি যাওয়ার পথেই পড়ে। বিশাল আকৃতির ঝরনাটি এতো শক্তিশালী যে বেশ দূরে দাঁড়ানোর পরও এর পানির ছাঁট আমাদের ভিজিয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমরা এই ঝরনাটির নাম জিজ্ঞেস করতে ভুলে গিয়েছিলাম।

ঝর্ণার পানি বাংলাদেশের দিকে বয়ে চলেছেমেঘালয়ের বিখ্যাত ঝরনাগুলোর মধ্যে আরও রয়েছে এলিফ্যান্ট ফলস। শিলং থেকে খুব কাছে এই ঝরনাটি তিন ধাপে ঝরছে। প্রথম ধাপ থেকে শেষ ধাপ পর্যন্ত সুন্দর সিঁড়ির ব্যবস্থা আছে যেন পর্যটকরা ঝরনাটির তিন রূপ আর তিন ধরনের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন। পুরো জায়গাটি ঘিরে সুন্দর পার্ক গড়ে তোলা হয়েছে। সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামা করা একটু কষ্টকর হলেও খুব কম সময় ব্যয় করে কাছ থেকে তিন ধাপের একটি বিরল ঝরনা দেখা আর ছবি তোলার জন্য এটি আদর্শ জায়গা।  

এই নদীর উপর খাসি আদিবাসীরা তৈরি করেছে লিভিং রুটস ব্রিজমেঘালয়ের প্রত্যেকটি ঝরনাই একেকটা দুর্দান্ত নদীর জন্ম দিয়েছে। প্রচণ্ড স্রোতস্বীণি আর দুর্বার গতির নদীগুলোও সৌন্দর্যে অনন্যা। ডাউকি নদীর কথা প্রথম পর্বেই বলেছি। মেঘালয়ে ডাউকি যেন এক পূর্ণ যৌবনা বিদ্রোহীনি। বাংলাদেশে এসে সে পরিণত হয়েছে শান্ত, সর্বংসহা বাঙালি নারীতে। আর একটা নদীর কথা বিশেষভাবে বলতেই হয়। এই নদীটি পাহাড়ের অনেক উপর দিয়ে ছুটে চলা পোষ না মানা টগবগে ঘোড়া যেন।

তার সৌন্দর্যকে আরও মহিমান্বিত করেছে একটি সেতু। নাম তার মাওলিনং লিভিং রুটস ব্রিজ। লিভিং রুটস ব্রিজ মেঘালয়ের খাসি ও জৈন্তিয়া আদিবাসিদের লোকজ জ্ঞানের এক অসাধারণ উদাহরণ। তাদের পূর্বপুরুষেরা একটি বিশেষ পদ্ধতি জানতেন যা ব্যবহার করে খরস্রোতা নদীর দু’পাশের রাবার বা এই প্রজাতির গাছের বিভিন্ন অংশের আকৃতিকে একটু একটু করে এমনভাবে পরিবর্তন করা হতো যেন সেই অংশগুলো সংযুক্ত হয়ে চলাচালের উপযোগী প্রাকৃতিক সেতুতে পরিণত হয়।  লিভিং রুটস ব্রিজ

মেঘালয়ের অনেক দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় খরস্রোতা নদীর উপর এ ধরনের লিভিং রুটস ব্রিজ আছে। সেতুগুলো খুবই টেকসই। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে আদিবাসীরা এই প্রাকৃতিক সেতু ব্যবহার করে চলেছেন। কোনো কোনো লিভিং রুটস ব্রিজের নির্মাণ কাজ শুরু করেছিল এক প্রজন্ম আর তা সমাপ্ত করেছে পরবর্তী প্রজন্ম। মাওলিনং লিভিং রুটস ব্রিজ দেখতে হলে পাহাড়ি সিঁড়ি বেয়ে বেশ নিচে নামতে হয়। সুন্দর ব্যবস্থাপনার কারণে পর্যটকরা থেমে থেমে বিশ্রাম নিয়ে সেতুটি পর্যন্ত যেতে পারেন।  

আর নদীর দু’পাশের বড় বড় গাছের শেকড় ও গাছপালা জোড়া লেগে তৈরি হওয়া একটা প্রাকৃতিক সেতু দিয়ে নদী পার হওয়ার অভিজ্ঞতা সত্যিই দারুণ। তবে সেতুতে সেলফি তোলার কিন্তু উপায় নেই!  দু’পাশে গার্ড বসে আছে। এ যে মানুষের নিজ হাতে তৈরি শিল্প, সিমেন্টের কংক্রিট স্থাপত্যতো আর নয়। তাই সেতুর রক্ষণাবেক্ষণের স্বার্থে একসঙ্গে বেশি লোক ওঠা আর অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা দুটোই নিষেধ।

লেডি হাইড্রা পার্কএবার একটু শিলং শহরের কথা বলতে চাই। পাহাড়ি শহর বলতেই মেঘ ভেসে বেড়ানো দার্জিলিং বা পাহাড়সুন্দরী রাঙামাটির যে চেহারা মনে ভেসে ওঠে শিলং সে রকম নয়। সে যেন পাহাড়ের উপর এলোমেলো কংক্রিটের জঙ্গল। হোটেলের মান মোটামুটি। এখানে কেনাকাটা করার মতো তেমন কোনো কিছু পাওয়া যায় না।  

এ বিষয়ে তেমন আগ্রহ ছিল না বিধায় আমাদের এটা কোনো সমস্যা বলে মনে হয়নি। আমরা চারদিনই পথের পাশের ছোট দোকানে খেয়েছি। ওরা আমাদের মতো ভাত, মাছ, মাংস খায়। ভারতীয় বিভিন্ন মসলাযুক্ত হওয়ায় ওদের নিরামিষ আইটেমগুলো দারুণ সুস্বাদু। আরও পাওয়া যায় আলু-পরোটা, লুচি আর মজার মজার মিষ্টি।

শিলং মমো ও চাইনিজ খাবার বিশেষ করে চাওমিনের জন্য বিখ্যাত। শিলং ও এর কাছাকাছি এলাকায় ঘোরার অনেক জায়গা আছে। এর মধ্যে লেডি হাইড্রা পার্কের কথা না বললেই নয়। বাগান, শিশুপার্ক, চিড়িয়াখানা কী নেই সেখানে।  

উইলিয়ম লেকএছাড়াও দেখেছি উমিয়াম লেক, তবে অনেক উপর থেকে। লেকটিকে আরও কাছ থেকে দেখতে পারলে বা স্পিডবোটে চড়তে পারলে বেশি ভালো লাগতো। শিলং শহরে অনেকগুলো মিউজিয়াম আছে। গিয়েছিলাম গলফ কোর্স দেখতেও। তবে তেমন কোনো বিশেষত্ব চোখে পড়েনি।
 

মেঘালয় ঘুরে আমার কাছে মনে হয়েছে সেখানে কেউ চাইলে শুধু দুই রাতের জন্য যেতে পারেন এবং চেরাপুঞ্জিসহ বিখ্যাত কয়েকটা স্পট ঘুরে ফেরত আসতে পারেন। আর যাদের আমার মতো পাহাড়, ঝরনা বা নদীর সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটিয়েও আশ মেটে না তাদের একটু লম্বা সময় নিয়ে যাওয়া উচিত। নইলে কোনো কিছুই ভালোভাবে দেখা সম্ভব হবে না।  

** গা ছমছমে গুহা আর ঝরনার শীতলতায়
** মেঘ, পাহাড় আর রূপকথার দেশে

বাংলাদেশ সময়: ০৮৪২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৩, ২০১৮
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।