স্থানীয় লোকজনের পাশাপাশি দূর-দূরান্ত থেকে আসা পর্যটকেরা বন্ধু-বান্ধব, পরিবার–পরিজন নিয়ে সুন্দরবনের সৌন্দর্য উপভোগ করছেন। পিছিয়ে নেই বিদেশি ভ্রমণপিপাসুরাও।
পর্যটকবাহী লঞ্চে করে দর্শনার্থীরা বনের গহিনে প্রবেশ করছেন। সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার হোটেল-মোটেলগুলোতে দর্শনার্থী ও পর্যটকে পরিপূর্ণ। যারা তিন থেকে পাঁচদিন সময় নিয়ে এসেছেন তারা সুন্দরবনের করমজল, হাড়বাড়িয়া, হিরণপয়েন্ট, কটকা, কচিখালী ও দুবলার চরে ঘুরে সৌন্দর্য উপভোগ করছেন।
এদিকে অনেক পর্যটকের ভিড় বাড়ায় কর্মব্যস্ততা বেড়েছে পর্যটন ব্যবসায়ী ও বন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। পর্যটকদের নিরাপত্তায় বন বিভাগ ও পুলিশ কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। সুন্দরবনের করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রটি দূরত্বের দিক দিয়ে লোকালয়ের সবচেয়ে কাছের ও দর্শনীয় হওয়ায় এখানে পর্যটক লেগেই রয়েছে। করমজল পর্যটন কেন্দ্রের ফুট টেইলার, সুউচ্চ ওয়াচ টাওয়ার, লবণ পানির কুমির, মায়া ও চিত্রল হরিণ, বানর ও বিলুপ্তপ্রায় কচ্ছপসহ বিভিন্ন পশু-পাখি এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে আনন্দ উপভোগ করে থাকেন পর্যটকরা।
এছাড়া পর্যটকদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছে সুন্দরবনের কটকা, কচিখালী, হিরণ পয়েন্ট, দুবলারচর, হাড়বাড়িয়াসহ বিভিন্ন আকর্ষণীয় পর্যটন স্পটগুলো।
সুন্দরবনের করমজল প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাওলাদার আজাদ কবীর বাংলানিউজকে বলেন, মোংলা থেকে সবচেয়ে কাছাকাছি দর্শনীয় স্থান হলো সুন্দরবনের করমজল ও হাড়বাড়িয়া। যারা অধিক ব্যয়ে বনের গহিনে যেতে পারেন না তারা স্বল্প খরচেই এ দুই জায়গা ঘুরে দেখেন। করমজলে রয়েছে দেশের একমাত্র লবণ পানির কুমিরের প্রজননকেন্দ্র। সেখানে গড়ে উঠেছে কচ্ছপের প্রজননকেন্দ্র।
তিনি বলেন, গতবছরের ২৫ ডিসেম্বর থেকে চলতি মাসে ১৫ তারিখে দেশি-বিদেশি মিলে আট হাজার পর্যটক এসেছেন কেবল মাত্র করমজলে।
সুন্দরবন পূর্ব ও পশ্চিম বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, প্রতিবছরই প্রকৃতির স্বাদ ও সুন্দরবনের সৌন্দর্য দেখতে দেশি-বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা বাড়ছে। সুন্দরবনে প্রতি মৌসুমেই সাধারণত দেড় থেকে দুই লাখ দেশি-বিদেশি পর্যটকের আগমন ঘটে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সুন্দরবন ভ্রমণ করেন এক লাখ ৮১৭ জন, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এক লাখ ২৮ হাজার ১৭৫ জন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এক লাখ ৮৩ হাজার ৪৯০ জন পর্যটক, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ভ্রমণ করেন দুই লাখ ২১ হাজার ৯৬৯ জন পর্যটক। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সুন্দরবন ভ্রমণ করেন দুই লাখ ৫১ হাজার ৯৬৯ জন পর্যটক। গত বছর পর্যটনখাত থেকে সুন্দরবন বিভাগের রাজস্ব আয় হয় দুই কোটি টাকা। অন্যদিকে সুন্দরবনের গহিনে হিরণপয়েন্ট, কটকা, কচিখালী, দুবলার চরে রয়েছে সরাসরি সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার অপার সুযোগ। বনের অভ্যন্তরে হেঁটে বেড়ানো হরিণ, বানরসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণী দেখে সবাই মুগ্ধ হয়।
গেলো বছরের ডিসেম্বর শুরুর সঙ্গে সঙ্গে পর্যটকদের পদচারণায় মুখরিত হতে শুরু করেছে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন। ভ্রমণপিপাসুদের ভিড় বাড়ছে সুন্দরবনের পর্যটন স্পটগুলোতে। জমে উঠতে শুরু করেছে এ খাতসংশ্লিষ্ট অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড।
খুলনার রূপসী বাংলা ট্যুরিজমের সিইও কাজী মঞ্জুর-উল-আলম বাংলানিউজকে বলেন, অপরূপ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের জোয়ার ভাটা, বনের সুন্দরী গাছ, বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার, মায়াবী চিত্রা হরিণ আর বিচিত্ররূপের এ বনকে দেখতে দেশ-বিদেশের পর্যটকরা প্রতিদিন ভিড় জমাচ্ছেন এখানে। ফলে কর্ম ব্যস্ততা বেড়ে গেছে ট্যুর অপারেটরদের।
মোংলায় অবস্থিত পর্যটন কর্পোরেশনের হোটেল পশুরের ইব্রাহিম বলেন, সুন্দরবন ভ্রমণের জন্য আমাদের হোটেলে পর্যটকরা এসে ভিড় জমাচ্ছেন। এদের মধ্যে দেশির থেকে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা বেশি।
মোংলার বাদাবন ইকো-কটেজের পরিচালক মো. লিটন জমাদ্দার বাংলানিউজকে বলেন, নতুন বছরের প্রথমদিক থেকে পর্যটকদের ঢল সুন্দরবনে নামতে শুরু করেছে। পর্যটকদের পদচারণায় সুন্দরবন এখন মুখরিত। তিনি আরও বলেন, ঘরে বসে সুন্দরবনের পাক-পাখালির ডাক, পায়ে হেঁটে বনের অপার সৌন্দর্য উপভোগ, নিরাপত্তার সঙ্গে রাতযাপন, মানসম্পন্ন খাবার, স্বল্প খরচে লোকালয় থেকে খুব কাছে ভ্রমণ করেই বিশ্বের একমাত্র ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন উপভোগের সুযোগ থাকায় পর্যটকরা এখন অনেকে কটেজে রাত্রিযাপন করেন।
ঢাকা থেকে সুন্দরবনে ঘুরতে আসা আবিদ ও আকাশ বলেন, সুন্দরবন ভ্রমণের স্বপ্ন দীর্ঘদিনের। প্রকৃতির সৌন্দর্যে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে ছিলো। ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইড সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে লীলাভূমি জীব-বৈচিত্রের আঁধার। সুন্দরবন শুধু দেশের নয়, বিশ্বের দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম। তাই বন্ধুদের নিয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্যে হারিয়ে যেতে চলে এসেছি।
যেভাবে যাবেন: একদিনেই সুন্দরবন ভ্রমণ করতে চান তাহলে করমজল পর্যটন কেন্দ্রে যেতে পারেন। ঢাকার মতিঝিল, আরামবাগ, শ্যামলী, কল্যাণপুর, গাবতলী থেকে গ্রিনলাইন, সোহাগ, হানিফ, ঈগল, এ কে ট্রাভেলসসহ বিভিন্ন এসি/ননএসি বাস খুলনার উদ্দেশে ছেড়ে যায় সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত। এছাড়া সায়েদাবাদ থেকে সুন্দরবন, পর্যটক, বনফুলসহ বিভিন্ন বাস খুলনা, বাগেরহাট ও মোংলার উদ্দেশে ছেড়ে যায় সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত। খুলনায় ট্রেনে এবং যশোর পর্যন্ত বিমানে যাওয়া যাবে। পাশাপাশি নৌপথেও আসা যায়। খুলনা নেমে লোকাল বাসে বাগেরহাট, মোংলা যাওয়া যাবে। মোংলা থেকে করমজল লঞ্চ বা ট্রলারে মাত্র ৪৫ মিনিটের পথ হওয়ায় দিনে যেয়ে দিনে ফিরে আসার সুবিধা রয়েছে। এছাড়া ভ্রমণে তুলনামূলক খরচও কম। মোংলা থেকে ট্রলারে করে করমজল যেতে খরচ হবে ট্রলারপ্রতি এক হাজার ৫শ থেকে দুই হাজার ৫শ টাকা। হাড়বাড়িয়া যেতে খরচ হবে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। প্রতিটি ট্রলারে ২০ থেকে ৩০ জন পর্যন্ত যাওয়া যায়। সুন্দরবনে থাকতে হলে সাহায্য নিতে হবে ট্যুর অপারেটরদের। খুলনার বিআইডাক্লিউটিএ’র লঞ্চ ঘাট থেকে সুন্দরবনে যাওয়া যায়। সুন্দরবন ভ্রমণের জন্য সাধারণত তিনদিন দুই রাতের প্যাকেজ থাকে। তারাই ভ্রমণের অনুমতিসহ সবকিছুর দায়িত্ব নেবে। খুলনা ও মোংলায় রয়েছে এমন শতাধিক ট্যুর অপারেটর। ঢাকাতেও মিলবে।
প্যাকেজের আওতায় সুন্দরবনের করমজল, হাড়বাড়িয়া, কটকা, কচিখালী, জামতলা সমুদ্রসৈকত, দুবলারচর, হিরণ পয়েন্ট ঘুরে দেখা যায়। সুযোগ আছে খুলনার কয়রা এবং সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও মুন্সিগঞ্জ থেকে। একটি ট্রলারে ১০ থেকে ১৫ জনের মতো থাকার সুবিধা রয়েছে। নিরাপত্তায় ট্রলারে থাকবেন বনরক্ষীরা, থাকবেন একজন গাইড। সাধারণত পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা ও খুলনা রেঞ্জের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্পট ঘুরে দেখানো হয়। ভ্রমণ পরিকল্পনা অনুযায়ী আপনিও সময় করে বেড়িয়ে যেতে পারেন বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন থেকে।
বাংলাদেশ সময়: ০৯১৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৯, ২০২০
এমআরএম/এএটি