বান্দরবানের রুমা ঘুরে এসে: সবুজের কোলে সাদা-মাটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন একটি বাড়ি। তাতে নেই কোন ধরনের বিলাসিতা।
কৌতূহল নিয়ে সাইনবোর্ডটির লেখা সম্পর্কে জানতে চাইলাম স্থানীয়দের কাছে।
তারা জানান, ঐতিহ্যকে গুরুত্ব দিয়ে সারাবছর গ্রামের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখায় ২০১৯ সালের পরিচ্ছন্ন বাড়ির স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে দেওয়া হয়েছে পুরস্কারও। এমনি অভিনব সব উদ্যোগে ভরা মুনলাইপাড়া।
বান্দরবানের রুমা উপজেলা থেকে তিন কিলোমিটারের ছোট-বড় পাহাড়িপথ পেরিয়ে দেখা মিলবে মুনলাইপাড়ার। মূলত বগালেকে যাওয়া পথে দেখা মিলবে মুনলাইপাড়ার। রাস্তার দুই ধার ঘেঁষা পাড়াটি। অন্য পাহাড়ি জনগোষ্ঠীদের বসতি বা পাড়ার তুলনায় মুনলাইপাড়া অনেকটা আলাদা।
পুরো পাড়ার এদিক-ওদিক কোথাও কোন ময়লা অবর্জনা নেই। সেখানকার ডাস্টবিনগুলোও দেখার মতন। নিজেদের গ্রামকে পরিষ্কার-পরিচ্ছনতা রাখতে অনন্য সব উদ্যোগ নিয়েছে মুনলাইপাড়া কমিউনিটি ট্যুরিজম কো-ম্যানেজম্যান্ট কমিটি।
দেশের প্রথম কমিউনিটি বেজড ট্যুরিজম গড়ে উঠেছে এই মুনলাইতে। মাচাং করে বানানো ঘরগুলো বিভিন্ন ধরনের গাছ-গাছালি দিয়ে সাজানো। বাড়ির উঠান, বারান্দাগুলো কিংবা ঘরের ভেতরে সবখানে শোভা পাচ্ছে বিভিন্ন আকারের গাছ লাগানোর টপ। তাতে লাগানো বিভিন্ন জাতের অর্কিড। ঘরের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রগুলোতে বিলাসিতার ছাপ না থাকলেও আছে ছিমছাম পরিপাটি এবং গোছানো।
কথা হয় মুনলাইপাড়া কমিউনিটি ট্যুরিজম কো-ম্যানেজম্যান্ট কমিটির উপদেষ্টা লাল নুন ন্যাম বমের সঙ্গে।
তিনি বলেন, ১৯৮৩ সালে স্থানীয় ৩০টি বম পরিবার সুনসংপাড়া থেকে এসে জনপ্রতি পাঁচ একর করে জায়গা নিয়ে মুনলাইপাড়ায় বসবাস শুরু করি। তখন একটি সংস্থা টানা তিন বছর আমাদের সহযোগিতা করেন। এখন ৫৮টি পরিবার নিয়ে আমরা পাড়ায় বসবাস করছি। পাড়াটিকে এগিয়ে নিতে নানাভাবে সহযোগিতা করছে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড। ইতোমধ্যে সেখানে নির্মাণ করা হয়েছে মুনলাই সেন্টার। চলতি বছরের ১৩ মার্চ সেন্টারের উদ্বোধন করা হয়। মূলত স্থানীয় নারীদের ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প তৈরি, প্রদর্শনী, সামাজিক আয়োজন, পরিদর্শনসহ বিভিন্ন কাজে সেটি ব্যবহার করা হচ্ছে। এছাড়া চলতি বছর সেখানে তিন পার্বত্য জেলার অংশ হিসেবে জাতীয় অ্যাডভেঞ্চার ফেস্টিবলের নানা ইভেন্ট অনুষ্ঠিত হয়। যা মুনলাই পরিচিতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
মুনলাইপাড়া কমিটির কমিটির সভাপতি থুয়াম লিয়ান বম বলেন, একটি গোছানো, সুন্দরপাড়া হিসেবে গড়ে তুলতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ঠিক রেখে জীবনযাত্রায় যাতে ব্যাঘাত না ঘটে সেটি মাথায় রেখে আমরা পর্যটকবান্ধব পাড়া করার জন্য কাজ করছি। একদিন দেশে পরিচ্ছন্ন গ্রামের স্বীকৃতি পাবো বলে আশা রাখি।
পর্যটকরা স্থানীয় বাসিন্দাদের ঘরের একটি অংশে থাকার সুবিধা রয়েছে। যেখানে রয়েছে আধুনিক সুবিধা। এখানে পর্যটকদের থাকছে ট্রি-টপ, জিপ লাইনিং, বারবিকিউ, ক্যাম্পফায়ার, কায়াকিং, ট্রেকিংসহ নানা আয়োজন। আর এসবের মূল উদ্যোক্তা ‘বেজক্যাম্প বাংলাদেশ’। গত তিন বছর ধরে সংগঠনটি সেখানে কাজ করছে। তারা মুনলাইপাড়ায় পর্যটনের মূল উদ্যোক্তা।
মুনলাইপাড়ার ট্যুরিজমের সমন্বয়ক ও স্থপতি শাহরিয়াজ আলম বলেন, আমরা একটা স্বপ্ন নিয়ে আগাচ্ছি। স্বপ্নটি হচ্ছে একদিন বাংলাদেশে মধ্যে সর্বোচ্চ সুন্দর এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন গ্রাম হিসেবে মুনলাইপাড়াকে ঘোষণা করা হবে। পাশাপাশি স্থানীয়দের জীবন-সংস্কৃতি ঠিক রেখে পর্যটনটা যেন তাদের জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে সেদিকে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করে যাচ্ছি।
দেখতে দেখতে আর কথা বলতে বলতে ফুরিয়ে এলো সময়। এবার ফেরার পালা। প্রকৃতির রূপ, মানুষের সারল্যতা, সামাজিকতা, দূর পাহাড়ে বিদ্যুৎবিহীন গ্রামের পরিষ্কার-পরিচ্ছনতার এমন উদ্যোগ নিশ্চয়ই শহরকে হার মানাবে। হয়তো দেখাদেখি এমন উদ্যোগ আলো ছড়াবে সারাদেশ।
ততক্ষণে আমাদের গাড়ির ছেড়ে দিয়েছে। পথ ছুটছে ভ্রমণের শেষ গন্তব্যে বান্দরবানের উদ্দেশে। তবে মাথায় ঝেঁকে বসেছে রূপবতী মুনলাইপাড়া। যে পাড়া দেশে উজ্জ্বল নক্ষত্র হবে একদিন...
আরও পড়ুন:
বগালেক: যেখানে আকাশ-পাহাড় আর জলের মিতালি
ট্রেকিংপ্রেমীদের জন্য আদর্শের স্থান কেওক্রাডং
বাংলাদেশ সময়: ০৮১৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১১, ২০২০
এডি/এএটি