বোম্বে কিংবা মুম্বাই, যে নামেই ডাকুন না কেন- এটিই ভারতের সর্বাধিক জনবহুল শহর। সারা ভারতবর্ষ থেকে মানুষ এখানে পাড়ি জমায় নানা স্বপ্নের খোঁজে।
সমুদ্রবেষ্টিত এ শহরটি পৃথিবীর কাছে বলিউডের শহর নামে অধিক পরিচিত। হালের শাহরুখ-সালমান-আমির খান থেকে শুরু করে কিংবদন্তি অমিতাভ বচ্চনেরা এ শহর থেকে নির্মিত সিনেমায় অভিনয় করে বিশ্ব মাতিয়েছেন।
করোনা ভাইরাস মহামারির সর্বশেষ ভয়াল ঢেউয়ের পর আবারও বাংলাদেশের মানুষদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে ভারতে প্রবেশদ্বার। এক পারিবারিক কারণে ভারতের এই স্বপ্নের শহর মুম্বাইতে ভ্রমনের অভিজ্ঞতা হয়েছিল চলতি মাসেই। ভ্রমণ অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে পাঠকদের জন্য আজ রইলো মুম্বাই শহরে প্রথমবার ভ্রমণের জন্য কিছু ‘থিংস টু ডু’-এর খণ্ডগল্পের প্রথম পর্ব।
গেটওয়ে অব ইন্ডিয়া এবং আরব সাগরে বোট রাইড
গেটওয়ে অব ইন্ডিয়া, পাশ্ববর্তী আরব সাগর এবং ঐতিহ্যবাহী তাজমহল প্যালেস হোটেল হলো মুম্বাই শহরে বিকেল কাটানোর মোক্ষম এক যায়গা। মুম্বাই শহরের অন্যতম ল্যান্ডমার্ক এই গেটওয়ে-এর দেয়ালে খোদাই করে লেখা আছে: ‘Erected to commemorate the landing in India of their imperial majesties King George V and Queen Mary on the second of December MCMXI.’ যার মানে দাঁড়ায় উক্ত স্থাপত্যটি নির্মাণ করা হয়েছিল ১৯১১ সালে কিং জর্জ ফাইভ এবং কুইন ম্যারি বোম্বে অ্যাপলো বান্ডার আগমনের স্মৃতি রক্ষার্থে।
গেটওয়ে ঢুকতে কোনো টিকেটের প্রয়োজন নেই। এর পাশেই রয়েছে ছোট সব বোট যেগুলোতে চড়ে আপনি আরব সাগরে ভেসে বেড়াতে পারবেন। হাতে সময় থাকলে এমন কোনো বোটে ঘুরে আসতে পারবেন এলিফ্যান্টা কেভস, তবে তার জন্য পুরো একদিন হাতে সময় নিয়ে বেরোনো উচিত।
হোটেল তাজ
তাজমহল প্যালেস হোটেল পর্যটকদের কাছে তাজ হোটেল নামে পরিচিত। ২০০৮ সালে হোটেলটিতে এক জঙ্গি হামলার পর এটি বিশ্বব্যাপী আরও পরিচিতি পায়। তাজ হোটেলের নির্মাণ নিয়ে গল্পটা বেশ চমকপ্রদ। বৃটিশ ভারতের অগ্রণী শিল্পপতি ছিলেন টাটা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা জামসেদজি টাটা। সেসময়ে ওয়াটসন’স হোটেল নামে এক প্রসিদ্ধ হোটেল ছিল, যেটিতে ক্ষমতাবান ইংরেজদের পদচারণায় মুখরিত থাকতো। জামসেদজি একদিন হোটেলটিতে প্রবেশ করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হন, তাকে হোটেল থেকে বের করে দেওয়া হয়। যেখানে হোটেলের বাইরে লেখা ছিল, ‘হোটেলটি শুধুমাত্র সাদা চামড়ার মানুষদের জন্য’।
ক্ষোভের আগুনে জ্বলতে থেকে তিনি একটি নতুন হোটেল নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন, যেটিতে ভারতীয়দের অগ্রাধিকার থাকবে। সেই হোটেলটিই আজকের তাজ হোটেল নামে পরিচিত। কোনো এক বিকেলে এককাপ দামী চা খেতে খেতে ঐতিহ্যের স্বাদ নেবার দারুণ এক স্থান হিসেবে বেছে নেওয়া যেতেই পারে এই স্থানটিকে।
ছত্রপতি শিভাজি টার্মিনাস
স্লামডগ মিলিয়নিয়ারের ‘জয় হো’ গানের দৃশ্যায়ন থেকে রা-ওয়ান সিনেমার ভিএফএক্স অ্যাকশন দৃশ্য, সিনেমা থেকে ছত্রপতি শিভাজি টার্মিনাস স্থানটি এই প্রথম নিজ চোখে দেখার সৌভাগ্য হলো। ১৮৮৭-৮৮ সালে স্থাপিত এই রেলওয়ে স্টেশনটি বর্তমানে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান। ভারতের ব্যস্ততম স্টেশনগুলোর একটি এই টার্মিনাস মুম্বাই শহরের প্রধানতম রেলওয়ে স্টেশন।
ভারতের সেই সময়ের শাসন সম্রাজ্ঞী যুক্তরাজ্যের রাণী ভিক্টোরিয়ার শাসনের স্বর্ণজয়ন্তী বর্ষে (১৮৮৭) এটি নির্মাণ হয় বলে স্টেশনটির নামকরণ করা হয়েছিল ‘ভিক্টোরিয়া টার্মিনাস’ নামে, যার নাম পরবর্তীতে মারাঠিদের জাতীয় বীর শিভাজির নামে পরিবর্তন করা হয়। সময় নিয়ে পুরো স্টেশনের ভেতরটা ঢুঁ মেরে সামনে এসে এর সদরগেটসহ তোলা একটি ছবি আপনার সারা জীবনের স্মৃতি হয়ে থাকবে।
দিওয়ালির (দীপাবলি) রাতে মোটরসাইকেলে শহর ভ্রমণ
গনেশ পূজা এবং দিওয়ালি মুম্বাই শহরের অন্যতম প্রধান দুই উৎসব। ভাগ্যক্রমে দিওয়ালির রাতে আমার মুম্বাই শহরে থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। আলোকজ্বল রাতটিতে মোমবাতি, ফানুশ, ফায়ারওয়ার্কস আর পটকায় মুম্বাই শহর সেদিন হয়ে উঠেছিল আলোর নগরী! মোটরসাইকেলে করে সেদিন মুম্বাইয়ের বন্ধু রামকৃষ্ণের বাইকে ঘুরেছিলাম ভাণ্ডুপ, মালাণ্ড, জুহু ব্যান্ডস্ট্যান্ড, দাদার, চৈতন্য ভূমি হাজি আলী দরগা থেকে শুরু করে মেরিন ড্রাইভ। মারাঠি অধ্যুষিত দাদার এর শিভাজি পার্কে দিওয়ালি উপলক্ষে মানুষের মিলনমেলা আর রাস্তাভর্তি ট্রাফিক জ্যাম দেখে মনে হচ্ছিল, বাংলাদেশের কোনো এক ঈদে মানুষের আনন্দ উদযাপন আর এর মধ্যে কোনো তফাৎ নেই!
মুম্বাই মেরিন ড্রাইভে আরেক বিকেল
আমাকে যদি প্রশ্ন করা হয় মুম্বাই শহরের সেরা স্থান কোনটি, বিনা দ্বিধায় আমার উত্তর হবে স্থানটির নাম মেরিন ড্রাইভ। আরব সাগরের তীরে প্রায় তিন কিলোমাটর বাঁধাই করা সি শেপ-এর ওয়াকওয়ে এটি। বিকেলে হাওয়া খেতে খেতে মেরিন ড্রাইভে বসে সূর্যাস্ত দেখা অন্যতম এক সেরা অনুভূতি। তবে করোনা মহামারির সময়ে কয়েক সেকেন্ড মাস্ক খুলে ছবি তুলতে গিয়ে আমাকে গুনতে হয়েছিল দুইশ রুপি জরিমানা! করোনা নিয়ন্ত্রণে কর্তৃপক্ষের এমন কঠোরতা সত্যি প্রসংশার দাবি রাখে।
জুহু-ব্যান্ডস্ট্যান্ড-গিরগাও চপাটি সৈকত
সমুদ্রবেষ্টিত মুম্বাই শহরে রয়েছে কয়েকটি বিখ্যাত সমুদ্র সৈকত। এরমধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় সৈকতের নাম জুহু বিচ। এছাড়াও মেরিন ড্রাইভের পাশে রয়েছে গিরগাও চপাটি সৈকত। পর্যটকেরা এখানে বসে সময় কাটানোর পাশাপাশি নানা স্ট্রিট ফুডে স্বাদ নিয়ে থাকেন। তবে মুম্বাই শহরের তুলনামূলক নির্জন ও ব্যতিক্রমী বিচ ব্যান্ডস্ট্যান্ড বিচ, যেখানে সমুদ্রের পাশে দেখা মিলবে প্রকাণ্ড সব পাথরের।
বাংলাদেশ সময়: ২০১৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৪, ২০২১
জেআইএম