ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

পর্যটন

সংকটে সীমাবদ্ধ বাগেরহাটের পর্যটন শিল্প

এস.এস শোহান, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৪৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২২
সংকটে সীমাবদ্ধ বাগেরহাটের পর্যটন শিল্প সুন্দরবন।

বাগেরহাট: বাংলাদেশের ৩টি বিশ্ব ঐতিহ্যের দুটিই বাগেরহাটে। একটি পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন, অন্যটি মুসলিম স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন ঐতিহাসিক ষাট গম্বুজ মসজিদ।

 

দর্শনার্থীরা ইচ্ছে করলেই একদিনে ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের দুই স্থাপনা ভ্রমণ করতে পারেন। এর সঙ্গে এই জেলায় আরও অন্তত ৫০টি প্রাচীন স্থাপনা রয়েছে। যা সব সময় দর্শনার্থীদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে  থাকে। এতসব সম্ভাবনা থাকার পরেও পর্যটকবান্ধব পরিবেশ, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, খাবার ও আবাসিক হোটেল, ট্যুরিস্ট বাস না থাকায় জেলায় পর্যটন শিল্পের তেমন বিকাশ ঘটেনি। এক কথায় নানা সংকটে এই জেলার পর্যটন শিল্প সমৃদ্ধ হয়নি।  

সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগও ভেস্তে যাচ্ছে বলে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে জেলা প্রশাসন বলছে সুন্দরবন, ষাটগম্বুজ মসজিদসহ বিভিন্ন প্রাচীন স্থাপনা কেন্দ্র করে জেলাকে পর্যটনবান্ধব করে গড়ে তুলতে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।

সুন্দরবন ও ষাটগম্বুজ কেন্দ্রিক ট্যুরিস্ট গাইড হাফিজুর রহমান বলেন, বাগেরহাট এমন একটি জেলা, যেখানে ঘুরলে প্রকৃতি-প্রাচীন স্থাপনা, নদী-খালবিল, সমুদ্র বন্দর সবকিছু এক সঙ্গে পাওয়া যায়। এরপরেও আমাদের জেলায় ট্যুরিস্ট বাস, আবাসিক হোটেল, খাবার হোটেলের ব্যাপক সংকট রয়েছে। অনেক সময় বিদেশি এবং উচ্চবিত্ত মানুষেরা বাগেরহাটে ভ্রমণে আসে, কিন্তু তাদের চাহিদা অনুযায়ী আবাসিক ব্যবস্থা না থাকায় তারা খুলনা চলে যান। এটা আমাদের সীমাবদ্ধতা বোঝায়।

ষাটগম্বুজ-সুন্দরবন ট্যুরিজম ট্যুর অপারেটরের পরিচালক মীর ফজলে সাঈদ ডাবলুবলেন, জেলায় ষাটগম্বুজ, সুন্দরবনসহ অনেক পর্যটন স্পট থাকলেও সুযোগ-সুবিধা খুবই কম। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের অভাবে পর্যটকদের সঙ্গে স্থানীয়দের আচার-ব্যবহারের ঘাটতি রয়েছে। এজন্য ষাটগম্বুজ, মোংলাসহ বিভিন্ন স্থানের হোটেল-রেস্টু রেন্টের কর্মচারী ও ট্যুরিস্ট গাইডদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার দাবি জানান তিনি।

ষাটগম্বুজ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ আক্তারুজ্জামান বাচ্চু বলেন, পদ্মা সেতু চালুর ফলে বাগেরহাটের সঙ্গে সারাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হয়েছে। ফলে এখন দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে বাগেরহাটে আসা অনেক সহজ। এরপরেও জেলায় দেশি দর্শনার্থী এলেও, বিদেশি দর্শনার্থীর সংখ্যা অনেক কম। কারণ পর্যটন সম্ভাবনাময় আমাদের এই জেলায় একটি বিমানবন্দর নেই। ষাটগম্বুজ ও সুন্দরবনের জন্য আলাদ কোনো ওয়েবসাইটও নেই। যার কারণে বিদেশি দর্শনার্থীরা ইচ্ছে করলেও সুন্দরবন ও ষাটগম্বুজ সংশ্লিষ্ট তথ্য জানতে পারে না। এটার জন্য সরকারি উদ্যোগে সুন্দরবন ও ষাটগম্বুজের জন্য ওয়েবসাইট তৈরির পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন এলাকায় ব্যানার ও বিলবোর্ড স্থাপন করতে হবে। সেই সঙ্গে এক নজরে বাগেরহাটের দর্শনীয় স্থাপনার বর্ণনা,যাতায়াত ব্যবস্থা, খাবার ও থাকার হোটেলের নাম্বার লিখে প্রচার করা প্রয়োজন বলে দাবি করেন এই জনপ্রতিনিধি।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, বাগেরহাটের কাস্টোডিয়ান মো. যায়েদ বলেন, ষাটগম্বুজ মসজিদ সংলগ্ন ঘোড়াদিঘিকে নান্দনিক করতে ওয়াক ওয়ে তৈরি করা হয়েছে।  দর্শনার্থীদের সুবিধার্থে ষাটগম্বুজের সামনের বিশ্রামাগার নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। তবে এই বিশ্রামাগার জেলায় আগত দর্শনার্থীদের চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। বেসরকারিভাবে স্থানীয় উদ্যোক্তারা যদি বাগেরহাটে হোটেল-মোটেল নির্মাণ করে। তাহলে উদ্যোক্তারা যেমন লাভবান হবেন, তেমনি স্থানীয়রাও লাভবান হবেন।

সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. বেলায়েত হোসেন বলেন, সুন্দরবনে দর্শনার্থীদের জন্য আরও নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর অংশ হিসেবে সুন্দরবনে বিদ্যমান পর্যটন কেন্দ্রগুলোকে আধুনিক ও দর্শনার্থীবান্ধব করা হচ্ছে। এছাড়াও খুলনা রেঞ্জের শেখেরটেক ও কালাবগী এবং শরণখোলা রেঞ্জের আলীবান্ধা ও চাঁদপাই রেঞ্জের আন্ধারমানিক এলাকায় নতুন করে চারটি ইকো-ট্যুরিজম কেন্দ্র করা হচ্ছে।

বাগেরহাট জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আজিজুর রহমান বলেন, জেলার প্রত্যেকটি পর্যটন কেন্দ্রের শোভা বর্ধন, আবাসন ব্যবস্থা, মানসম্মত খাবার, বিপণনকেন্দ্র, সহজ যাতায়াত, সার্বিক নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন পরিকল্পনাআমাদের রয়েছে। এসব বাস্তবায়ন হলে অচিরেই বাগেরহাটের পর্যটন শিল্প আরও বিকশিত হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
সাড়ে ছয়শ বছর আগে বিখ্যাত মুসলিম শাসক খানজাহান (রহ) এর আমলে বাগেরহাটে ষাটগম্বুজসহ নানা প্রাচীন স্থাপনা নির্মিত হয়। এসব স্থাপনার স্থাপত্য রীতি ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনা করে ১৯৮৫ সালে বাগেরহাটকে ঐতিহাসিক মসজিদের শহর হিসেবে ৩২১তম বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত করে ইউনেস্কো। এই তালিকায় বাগেরহাটের ১৭টি স্থাপনা স্থান পায়। চলতি বছরের প্রথম দিকে বিশ্বের ২৫টি হারিয়ে যাওয়া শহর ও বিপন্ন ঐতিহ্যবাহী শহর হিসেবে বাগেরহাটকে তালিকাভুক্ত করে বিশ্বখ্যাত ফোর্বস সাময়িকী।  

এছাড়াও বাগেরহাটের যাত্রাপুরে রয়েছে সনাতন ধর্মীয় প্রাচীন কোদলা মঠ, মোরেলগঞ্জে রয়েছে ব্রিটিশ শাসকদের স্মৃতি বিজড়িত কুঠিবাড়ি, কচুয়ায় রয়েছে ৬শ বছরের পুরোনো কালিবাড়ি। এর বাইরে সম্প্রতি বাগেরহাটের বিভিন্ন এলাকায় আরও ১৬৩টি প্রত্নস্থান (সাইট) শনাক্ত করেছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। তবে ষাটগম্বুজ মসজিদ ছাড়া জেলা শহরের মধ্যে থাকা অন্যান্য স্থাপনাগুলো অযত্ন আর অবহেলায় রয়েছে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হলেও বিচরণ করছে গরু-ছাগল। দেয়ালে-দেয়ালে শুকানো হয় স্থানীয়দের কাপড়, কয়েকটি স্থাপনার দেয়ালও ধসেগেছে। সবকিছু মিলিয়ে সংস্কার ও সংরক্ষণের অভাবে দিন দিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে প্রাচীন এসব স্থাপনা।

অন্যদিকে পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে রয়েছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রল ও মায়াবী হরিণ, কিং-কোবরা, বানর, গুইসাপসহ প্রায় ১০০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী ও সরীসৃপ, ৮ প্রজাতির উভয়চরসহ ৩২০ প্রজাতির বন্যপ্রাণী।  

সুন্দরী, পশুর, গেওয়া, গরান, কেওড়া, গোলপাতাসহ ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে এই বনে। সুন্দরবনের অভ্যন্তরে নদী ও খালে রয়েছে বিশ্বের বিলুপ্তপ্রায় ইরাবতীসহ ৬ প্রজাতির ডলফিন, লবণ পানির প্রজাতির কুমির, রূপালী ইলিশ, চিংড়ি, রূপচাঁদা, কোরালসহ ৪০০ প্রজাতির মাছ এবংশিলা কাঁকড়া। আধুনিক ব্যবস্থাপনার অভাবে কাঙ্ক্ষিত দর্শনার্থী টানতে ব্যর্থ বন বিভাগ।
 
বাংলাদেশ সময়: ১২৪০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২২
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।