ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বাণিজ্যমেলা

জৌলুস হারিয়েছে বাণিজ্য মেলা

শেখ নাসির হোসেন ও সাঈদ শিপন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০১১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৪
জৌলুস হারিয়েছে বাণিজ্য মেলা

ঢাকা: আয়োজক প্রতিষ্ঠানের অদক্ষতা, দুর্নীতি, পক্ষপাতিত্ব ও দলীয় নেতাদের চাঁদাবাজির কারণে জৌলুস হারিয়েছে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা। আগে বিভিন্ন দেশ আগ্রহ নিয়ে অংশ নিত মেলায়।

কিন্তু ১৯তম বাণিজ্য মেলায় তেমন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দেশ অংশগ্রহণ করেনি। ফলে বাণিজ্য মেলার সেই উদ্দেশ্য ব্যর্থই হয়েছে বলে অভিযোগ স্টল মালিক ও দর্শনার্থীদের।
 
দর্শনার্থীদের অভিযোগ এবারের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা ‘হকার মেলা’ হয়ে গেছে। তাছাড়া এখানে তো সব দেশীয় পণ্য। ভাল কোনো দেশের প্যাভিলিয়ন নেই।

ব্যবসায়ীদের অভিযোগ অন্যবারের তুলনায় এবার মেলায় চাঁদাবাজির পরিমাণ অনেক বেড়েছে। ফলে ভবিষ্যতে এ ধরনের মেলায় অংশ নেওয়া নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেন তারা।
 
আয়োজক প্রতিষ্ঠানের দাবি বাংলাদেশসহ মোট ১২টি দেশ মেলায় অংশ নিয়েছে। তবে অধিকাংশ দেশের প্যাভিলিয়নের মধ্যে প্রদর্শীত হচ্ছে দেশীয় পণ্য। আবার এক শ্রেণির মানুষের বিরোধীতার কারণে সরাসরি মেলায় পণ্য প্রদর্শন করতে পারেনি পাকিস্তান। এমনকি বাইরে তাদের পতাকাও উড়ানো হয়নি।
 
অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন দেশের নামে প্রায় ৪০টি প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ নিয়েছে সরকার দলীয় স্থানীয় নেতা-কর্মীরা। অবশ্য তাদের সাথে যোগসাজস রয়েছে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) উচ্চ পর্যায়ের। আর এজন্য তারা নিয়েছেন মোটা অঙ্কের ঘুষ।
 
মেলার ঐতিহ্য হারানোর বিষয়টি অস্বীকার করছে আয়োজক প্রতিষ্ঠান ইপিবি। প্রতিষ্ঠানটির ভাইচ চেয়ারম্যান সুভাশিষ বসু বলেন, মেলা ঐতিহ্য হারায়নি। এবার আমাদের মেলা শতভাগ সার্থক হয়েছে। মোট ১২টি দেশ মেলায় অংশ নিয়েছে। দর্শনার্থীরাও মেলা উপভোগ করছেন। তাছাড়া আমাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করা হচ্ছে তার একটাও সত্য না।
 
এবারের মেলায় রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন দেশের নামে প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ নিয়েছে সরকার দলীয় নেতা-কর্মীরা। সেসব প্যাভিলিয়নে নামমাত্র বিদেশি পণ্য থাকলেও ছোটছোট স্টল তৈরি করে ভাড়া দেওয়া হয়েছে দেশীয় ব্যবসায়ীদের কাছে। ফলে বিভিন্ন দেশের পণ্য না পেয়ে অনেকটাই হতাশ দর্শনাথীরা।
 
স্থানীয় নেতা-কর্মীরা প্যাভিলিয়নের মধ্যে ছোট ছোট স্টল থেকে নিয়মিত ভাড়া নেওয়ার পাশাপাশি চাঁদা নিচ্ছেন বলেও অভিযোগ স্টল মালিকদের। তবে চাঁদাবাজির হার মেলার প্রথমদিকে কম থাকলে শেষের দিকে মারাত্মক আকার ধারণ করে। সরাসরি ইপিবি’র কাছ থেকে স্টল বরাদ্দ না নেওয়ায় অনেকটা বাধ্য হয়েই চাঁদা দিতে হচ্ছে এসব স্টল মালিকদের।
 
অন্যবারের তুলনায় এবারের বাণিজ্য মেলায় চাঁদাবাজির হার বেড়েছে অনেক। ফলে বিদেশি ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি বিপাকে দেশীয় ব্যবসায়ীরা। চাঁদাবাজির সঙ্গে আয়োজক প্রতিষ্ঠান রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ও পুলিশ সদস্যরাও জাড়িত আছেন বলে অভিযোগ স্টল মাকিলদের।
 
মেলা প্রাঙ্গণে হকার প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকলেও এবারের মেলায় গুলিস্তানের মতো হকার উপস্থিতি অনেকটা ব্যথিত করেছে দর্শনার্থীদের। মেলায় অবৈধভাবে হকার প্রবেশ করিয়ে বড় অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রবেশ পথ ইজারাদার প্রতিষ্ঠান ‘মীর ব্রাদার্স’র কিছু অসৎ কর্মী। প্রতিদিনই ব্যবসার ধরন বিবেচনায় দুইশ’ থেকে দুই হাজার টাকা নিয়ে এসব হকারদের প্রবেশ করিয়েছে তারা। যদিও এসব টাকার কোনো হিসেব রাখা হয়নি। বিভিন্ন গেটে দায়িত্বরত কর্মীরা এসব কাজ করেছে।
 
অন্যদিকে এসব হকার উচ্ছেদেও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে ইপিবি। বিভিন্ন সময় লোক দেখানো অভিযান চালালেও হকার ঠেকাতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানটি।

তবে প্রতিষ্ঠানটির দাবি তারা প্রতিদিনই হকার ধরে বের করে দেয় কিন্তু তারা কিভাবে যেন আবার ভিতরে প্রবেশ করে। প্রবেশ পথে দায়িত্বে যেহেতু ইপিবি নেই তাই কারা এ হকার আনছে তাও নাকি তারা বুঝতে পারছেন না ইপিবি কর্তৃপক্ষ।
 
আবার ইপিবির বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগও করেছেন সনামধন্য কয়েকটি কোম্পানি। তারা মেলায় অংশ নেওয়ার জন্য আবেদন করলেও পরবর্তীতে অংশ নিতে পারেননি। কারণ হিসেবে জানা গেছে ইপিবি’র ভাইচ চেয়ারম্যান সুভাশিষ বসু ও সদস্য সচিব বিকর্ণ কুমার ঘোষ পক্ষপাতিত্ব করে নিজেদের পছন্দের কোম্পানিকে ভাল জায়গা বরাদ্দ দিয়েছন। ফলে মেলায় অনেক স্বনামধন্য কোম্পানিও তাদের পণ্য প্রদর্শন করতে পরেনি।
 
ইতোমধ্যে ইউনিলিভার কোম্পানির পছন্দের জায়গা অন্য কোম্পানিকে বরাদ্দ দেওয়ায়  ইবিপিকে উকিল নোটিশ দিয়েছে কোম্পানিটি। এমনকি একটা মামলাও করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
 
এছাড়া মেলা প্রাঙ্গণে আসা অনেকটা অনিরাপদ মনে করেন অনেক দর্শনার্থী। বিশেষ করে যারা এবারের মেলায় ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছে। তাদের অভিযোগ অন্যবারের মেলায় সকল জায়গায় সিসি ক্যামেরার ব্যবস্থা থাকলেও এবার তা করা হয়নি। ফলে মেলা প্রাঙ্গণে পকেটমার ও ছিচকে চোরের উৎপাত বেড়ে গেছে। অনেকে হারিয়েছেন তাদের মূল্যবান জিনিসপত্র। তবে এ বিষয়ে ইপিবি তেমন কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি।
 
বিভিন্ন স্টল মালিকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তারা সরাসরি আয়োজক প্রতিষ্ঠান রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) কাছ থেকে স্টল ভাড়া নেননি। তারা এখানে ‘রাজু’ ও ‘মুকুল’ ভাইদের মাধ্যমে স্টল নিয়েছেন। এরা রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতা বলে জানায় স্টল মালিকরা।
 
মেলার ঐতিহ্য বিষয়ে দেশে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফবিসিসিআই) সভাপতি কাজী আকরাম বলেন, প্রতিবছর একই ধরনের আয়োজন করায় মেলায় সেই জৌলুস কিছুটা হারিয়েছে সত্য। তবে আমরা মেলায় নতুনত্ব আনার চেষ্টা করছি। এজন্য সময় প্রয়োজন।
 
তিনি আরও বলেন, আমরা শুরু থেকেই একটা স্থায়ী মেলা কমপ্লেক্সের দাবি জানিয়ে আসছি। যেটা থাকলে বাণিজ্য মেলার কিছু সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে। ফলে মেলায় ঐতিহ্য আবারও ফিরে আসবে।

তাছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এবার তড়িঘড়ি করে মেলার আয়োজন করায় বেশ কিছু ত্রুটি রয়ে গেছে বলেও জানান তিনি।
 
বাংলাদেশ সময়: ১০৩৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।