ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

অপরূপা হাম হাম ঝর্না

শামসীর মো. সাইফুল আযীয | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১২১ ঘণ্টা, আগস্ট ৩, ২০১৪
অপরূপা হাম হাম ঝর্না ছবি: লেখক

সম্প্রতি দেশব্যাপী বেশ আলোচিত হাম হাম ঝর্না দেখতে যাওয়ার প্ল্যান বারবারই এদিক সেদিক হয়ে যাচ্ছিল। তবে শেষমেষ আমাদের যাওয়া আটকালো না কোনো কিছুতেই।

সায়েদাবাদ থেকে শ্রীমঙ্গল যাওয়ার শেষ বাস ছাড়ে রাত সাড়ে দশটায়! সবাই একটা বিষয় নিয়ে চিন্তিত, মাঝ রাত্তিরে বাস থেকে নেমে কি করব!

আমাদের চিন্তা শেষ হবার আগেই রাত আড়াইটায় বাস আমাদের শ্রীমঙ্গল নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। এদিক ওদিক হেঁটে আমরা ভাবছি একটা হোটেলে উঠে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিলে খারাপ হয় না। এমন সময় এক টহল পুলিশ বাইকে করে এসে হাজির। জানতে চাইলো কোথায় যাব। আমাদের গন্তব্যের কথা শুনে তার অভিব্যক্তি দেখে মনে হল ওইটা কি কোনো যাবার জায়গা হলো!

এভাবে রাস্তায় ঘোরাঘুরি করলে সমস্যা হতে পারে জানিয়ে হোটেলে ওঠার পরামর্শ দিয়ে যেভাবে এসেছেলো ঠিক সেভাবেই চলে গেলো।

পুলিশ সাহেব চলে যাবার পর আমরা ভাবলাম ধরে নিয়ে যদি মারধর না করে  সকালে ছেড়ে দিত তাহলে অবশ্য মন্দ হতো না। সেই সঙ্গে ফ্রি ফ্রি থানায় একটা রাত্রিযাপনের অভিজ্ঞতাও হয়ে যেতো। অবশ্য পুলিশের থেরাপি ছাড়া থানায় থাকা সম্ভব না বলে সে ইচ্ছা ত্যাগ করে আমরা একটা হোটেলে উঠে গেলাম।

সকাল সাড়ে ছয়টায় নাস্তা শেষ করার আগেই হামহাম জয়ী নাসির ভাইয়ের ঠিক করে দেওয়া গাড়ি নিয়ে হাজির ড্রাইভার আলাল ভাই ও তার সহকারী। পর্যাপ্ত পানি, চিপস, বিস্কিট নিয়ে শুরু হলো আমাদের যাত্রা।

জলপতনের শব্দটাকেই  স্থানীয় ভাষায় হাম হাম বলা হয়। আমরা যেমন বলি কলকল। ৭ হাজার নয়শ’ ৭০ একর আয়তনের রাজকান্দি সংরক্ষিত বনাঞ্চল -শ্রীমঙ্গলের কুরমা বন বিটের পাহাড়ের পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত ন্যাশনাল টি কোম্পানির চাম্পারায় চা বাগান আর পূর্ব-দক্ষিণে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্তাঞ্চল। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার পূর্ব দিকে দুর্গম পথের শেষে বনের মাঝে অবস্থিত এ জলপ্রপাতটি।

নয়নাভিরাম চা বাগানের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দু’পাশে রেখে আমরা এগিয়ে যেতে থাকি। পেছনে থেকে যায় লাউয়াছড়া সংরক্ষিত বনাঞ্চল। কুরমা বন বিট থেকে আমাদের সাথে যোগ দিলেন গাইড মোহাম্মদ শামীম। কলাবন চা শ্রমিক পাড়ায় এসে আমাদের গাড়ি থেকে নেমে যেতে হলো। লোকালয়ের কাঁদা মাড়িয়ে আমরা পথ চলতে লাগলাম।

যেখান থেকে বনের শুরু সেখানে এসে শামীম ভাই আমাদের সবার হাতে একটা একটা করে বাঁশের লাঠি ধরিয়ে দিলেন, পূর্ববর্তী কোনো দল সফর শেষে সেগুলো ফেলে গিয়েছিল যেমনটা আমরাও ফেলে এসেছিলাম অনাগত ভ্রমণকারীদের জন্য, ভ্রমণের একমাত্র বিশ্বস্ত সঙ্গী এই বাঁশ।

হামহাম যাওয়ার জন্য দুটো রাস্তা আছে, ঝিরিপথে অথবা পাহাড়ি পথ ধরে। আমাদের গাইড মোকামটিলা নামক পাহাড়ি পথেই নিয়ে চললেন সবাইকে। শুরুটা বেশ কোমল মসৃন। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে পথের রুক্ষতা, কোথাও হাঁটু পর্যন্ত পানি, কোথাও ঘন কাঁটাযুক্ত বন, কোথাও খাড়া পাহাড়ি ঢাল, যেতে হবেই, তাই বেশি ভাবার অবকাশ নেই, আমরা এগিয়ে যাই। কপাল ভালো বৃস্টি ছিল না, না হলে এই পথ পাড়ি দেওয়া সহজসাধ্য নয়।

আমরা হেঁটে চলি কাঠুরেদের তৈরি করা ট্রেইল ধরে। শামীম ভাই জানান কিছুদিন আগে ভালুকের আক্রমনে আহত হওয়া গ্রামবাসীর গল্প, অবশ্য আমাদের কাছে তা গল্পই মনে হয়- কারণ ভালুক বা ওই ধরনের প্রাণীর কোনো অস্তিত্ব কোথাও চোখে পরেনি আমাদের। বনজ গাছের পাশপাশি পাহাড়ের খাজে আলোর সন্ধানে বেড়ে উঠা লিকলিকে লম্বা বাঁশের সাড়ি।

ক্ষণে ক্ষণে থেমে পানি পান করছিলাম আমরা। এপর আবার হেঁটে যাওয়া। তার ওপর হঠাৎ করে নিচে নেমে যাওয়া পাহাড়ি ঢাল মাঝে মাঝে ভয় জাগিয়ে দিয়ে যাচ্ছিল আমাদের। মুখে কিছু না বললেও মনে মনে হয়ত সবাই ভাবছিলো  কখন শেষ হবে এই পথ!

 অবশেষে শামীম ভাই জানান, এটাই শেষ ঢাল তারপর পুরোটা জলা পথ। প্রথমে স্বস্তি পেলেও সেটা উবে যেতে বেশি সময় লাগেনি যখন হঠাৎ করে কোমড় সমান পানি সামনে এসে হাজির হলো। পানি মাড়িয়ে যাচ্ছিতো যাচ্ছিই। ঝর্না আর আসেনা!
 
ঝর্না নিয়ে কোন ক্লাসে যেনো একটা কবিতা পড়েছিলাম। মনে পড়ছে না। ঝর্নার অপরূপ সৌন্দর্য কি সুন্দর করে কবি তুলে ধরেছিলেন হরিণের মতো চপলা চঞ্চলা বিশেষণে বিশেষায়িত করে। কিন্তু আমাদের ঝর্না কই?

আবারও কোমড় সমান পানি ভাঙানোর পর অবশেষে...আহ! বাঁক পেরোনোর পরেই অপরূপ ঝর্না আমাদের সামনে...

হাম হাম, পাহাড়ের বুক চিরে জলের পতন, অপরূপ ছন্দে জলের পতন। ক্লান্তিকর ভ্রমণ পথের কথা এক নিমেষেই ভুলিয়ে দেবে হাম হাম তথা জলের কলতান।

ফিরতি পথ- যে পথে এসেছি সে পথেই ফিরব নাকি ঝিরি পথ ধরে ফিরব, কিছুক্ষণ আলোচনার পর অন্য পথটা দেখার আশায় ঝিরি পথ ধরলাম।

শুরুটা তেমন ঝামেলার না হলেও হঠাৎ করে দেখা গেলো কোমর সমান বা তার বেশি পানি ঝিরিতে, উপায় নাই, ব্যাগ মাথায় নিয়ে নেমে যেতে হলো পানিতে। সামনে যে আরও বিপদ সঙ্কুল পথ সেটা কি আর আমরা জানতাম। ঝিরিতে পানি এতো বেশি যে তা দিয়ে পার হবার কোনো উপায় নেই, বাধ্য হয়ে পাহাড়ের খাঁজ বেয়ে ওঠা নামার পিচ্ছিল পথ দিয়ে আমাদের ফিরতে হলো, সামান্য পিছলে গেলেই ভয়ংকর ইনজুরির হাতছানি।  

ঝিরি পথের অবস্থা ভয়ানক খারাপ। ব্যাগ থেকে যে ক্যামেরা বের করে ছবি তুলবো তারো উপায় ছিলো না। কোনো কোনো জায়গায় কোনো মতে পা-টা রাখা যায়, তাও এদিক সেদিক হলেই কাহিল অবস্থা।

এই বিপদ সঙ্কুল পথ একসময় শেষ হলে আমরা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। পরক্ষণেই ভুল ভাংলো, এইবার অত্যাচার শুরু হলো কাদা মাটির। বৃষ্টির কারণে আর আগে আর অনেক ভ্রমণকারীর কারণে প্রায় হাঁটু সমান কাদা, তাও বিশাল একটা পথ জুড়ে, সেই সাথে আছে কাঁটা যুক্ত বেত বন।

সমতলে এসে যেন আমরা হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। অবশেষে আম‍াদের  ভ্রমণের সার্বক্ষণিক সঙ্গী বাঁশগুলোকে পথের ধারেই রেখে আসলাম পরবর্তী কোনো দলের জন্য। নিশ্চিত ভাবে তারাও ফিরে এসে আমাদের মতো ঘোষণা করবে আর কখনোই যাব না ঐ ঝর্না দেখতে।

প্রিয় পাঠক, ভ্রমণ যাদের নেশা, বেড়ানোর সুযোগ এলে যারা উড়িয়ে দেন সব বাধা, কাজের অংশ হিসেবে যারা ভ্রমণ করেন কিংবা যাদের কালেভদ্রে সুযোগ হয় ভ্রমণের তারা সবাই হতে পারেন ট্রাভেলার্স নোটবুক’র লেখক। আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন বাংলানিউজের পাঠকদের সঙ্গে।

আর একটা কথা লেখার সঙ্গে ছবি পাঠাতে ভুলবেনই না, সেই সঙ্গে বাতলে দিন সেখানে যাওয়ার পথঘাটের বিবরণও।

প্রিয় পাঠক, আপনার ভ্রমণ আনন্দ বিশ্বজুড়ে বাঙালির কাছে ছড়িয়ে দিতে আমাদের ই-মেইল করুন  [email protected] এই ঠিকানায়।

লেখ‍া ও ছবি: শামসীর মো. সাইফুল আযীয

বাংলাদেশ সময়: ১১২১ ঘণ্টা, আগস্ট ০৩, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।