ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

মেঘ পাহাড়ের দেশে

কিন্নরী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২২০ ঘণ্টা, আগস্ট ৬, ২০১৪
মেঘ পাহাড়ের দেশে

বাড়ি-ঘর সবকিছু আস্তে আস্ত ছোট হতে লাগলো। আমরা ভাসতে লাগলাম হাওয়ায়।

কিছুক্ষণ পর চারপাশে শুধুই মেঘ। প্লেন যখন ভুটানের ওপর- দেখতে পেলাম মেঘ ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা সবুজ পাহাড়। আর দুই পাহাড়ের মধ্যদিয়ে হঠাৎ যেন ফুরিয়ে গেল পথ। ওমা-এটা কী স্বপ্ন! মাত্র
এক ঘণ্টায় পৌঁছে গেলাম ভুটান? পারো বিমান বন্দর।

হৈ হৈ করে নেমে এলাম। বিমান বন্দরের ঝক্কি-ঝামেলা শেষ করে বেরিয়ে এলাম ভুটানের রাস্তায়। ছোট ছিমছাম একটা বিমান বন্দর। জানা না থাকলে মনে হবে ভুটানের কোনো সম্ভ্রান্ত মানুষের বাড়ি বুঝি। বাইরেরই গাড়ি অপেক্ষা করছিল। আমাদের গাইড সোনাম। পরে অবশ্য প্রিয় সোনম মামা। গাড়ি ছুটে চললো পাহাড়ের কোলঘেঁষে। চারপাশে শুধু পাহাড় আর পাহাড়, মেঘ আর মেঘ। হাত বাড়ালেই যেন ধরা দেবে সাদা জলেরা।

খুব অল্প কিছু মানুষের নিত্য যাতায়াত পথে। মায়েদের পিঠে বাঁধা তাদের শিশুরা। চলার তালে তালে তারাও, পুতুলের মতো শাথা নাড়তে নাড়তে চলেছে। এদের গড়ন, পোশাকের ধরনের মতোই বাড়ি-ঘরগুলোও যেন এক ছাঁচে তৈরি। সোনাম মামার কাছ থেকে জানলাম ঐতিহ্যের বাইরে গণপূর্ত বিভাগ বাড়ি বানানোর অনুমতি দেয় না। ভাবলাম আমাদের দেশেও এমন কড়াকড়ি নিয়ম থাকলে ভালো হতো।

এখানকার প্রকৃতি আর মানুষ দেখতে যখন আমরা মহাব্যস্ত তখন কানের মধ্যে অবিরাম বেজে চলেছে কলকল ছল ছল একটা শব্দ। আবিষ্কার করলাম অনেকক্ষণ ধরেই একটা ছোট নদী আমাদের সঙ্গ দিচ্ছে। নদীটার বুকজুড়ে ছোট বড় অনেক পাথর। সোনাম মামা জানালো কোনো এক পাহাড়ি ঝরনা থেকে এর উৎপত্তি। আর এর বিস্তার ভুটানময়। একেক নগরে একেক নাম। যেমন এখানে পারো নদী। নদীটা কিন্তু এখানকার শান্ত পাহাড় শান্ত মানুষের যেন একেবারে বিপরীত। অনেকটা বোধহয় আমার মতোই। নেচে গেয়ে চলছে সারাক্ষণ। মানুষগুলোকে খুব সুখী সুখী মনে হচ্ছিল, যেনো যা আছে তাই নিয়ে ভরপুর। বাড়তি ভোগ-বিলাস বা চাওয়া-পাওয়া নেই। যা নেই তার পেছনে ছোটা নেই। যা নেই তাকে জোর করে টেনে আনা নেই।

চোখে পড়লো না কোনো সাইনবোর্ড বা বিজ্ঞাপণচিত্র। বাবা জানালো সুখের মানদণ্ডে সম্পদের প্রাচুর্য মাপা হয় এখানে। রিসোর্টের পথেই বেশ কিছু দেখার মতো জায়গা। দেখলাম কাঠের সেতু, নিচে সেই স্রোতধারাটি। একটা ফুল ছিঁড়ে সেতুর একপাশ থেকে ছুঁড়ে দিলাম। জলদি অপরপ্রান্তে দৌড়ে এলাম ফুলের গতিপথ দেখার জন্য। ততোক্ষণে ফুল বহুদূরে। সেতুর এক কোণে আমি আর বাবা এদিক থেকে ওদিকে ছোটাছুটি করছি।

মা প্রকৃতি দেখছে না, তার চোখ লেন্সে– কাছেই এক কিশোরী বসে আছে। তার সামনে এক ঝুড়ি লাল টুকটুকে ফল। নাম জিজ্ঞেস করতেই বললো-পাম ফল।

খুব অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম কিশোরী জবাব দিচ্ছে ইংরেজিতে। ভেবেছিলাম ও পড়ালেখা জানে না। কথা শুনে অবাক হয়ে গেলাম। দেখা হলো অসম্ভব সুন্দর জেলা পরিষদ ভবন, দুর্গের বেশে জাদুঘর। সব ভবন ঘিরে আছে বহু প্রজাতির গোলাপ এবং অনামী রঙিন ফুল।

গোলাপগুলোকে জড়িয়ে ধরতেই বুঝতে পারলাম কোনো গোলাপেই গন্ধ নেই। জানি না কেনো? পাহাড়ের কতো উপরে উঠেছিলাম জানা নেই। উপর থেকে পারো শহর দেখতে দেখতে সোনালি আলো ছড়িয়ে বেলা গড়িয়ে গেলো। সেই সঙ্গে শুরু হলো টুপটাপ বৃষ্টি। এসময় ভুটানের আবহাওয়া এরকমই। এই রোদ, এই বৃষ্টি। শিলা পাহাড়ের গা বেয়ে আমরা রিসোর্টের দরজা দেখেই মুগ্ধ। ভেতরে না জানি আরো কতো মুগ্ধতা ছড়িয়ে আছে। ঢুকতেই সামনে সব বিচিত্র রঙের ফুল। রুমে ঢুকে বুঝতে পারলাম খুব ক্লান্ত আমরা। এভাবে আবার শহরের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়া সম্ভব নয়। কিন্তু হাতে সময় নেই আমাদের।

একটু ফ্রেশ হয়েই বেরিয়ে পড়লাম শহর দেখবো বলে। পরিপাটি-ছিমছাম। দোকান-রাস্তা সব কিছু। ঘুরতে ঘুরতে বেশ মজার অভিজ্ঞতা হলো, কোন কোন দোকান দেখে মনে হলো বাসার ড্রয়িং রুমে পসরা সাজিয়ে বসেছেন দোকানীরা। পরদিন সকালে আমরা রাজধানী থিম্ফুর পথে রওনা হলাম। পথে পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে ভিন্ন ভিন্ন ভঙ্গিতে ছবি তুলতে লাগলাম। কখনও ফুলের মাঝে, কখনও গাছ ধরে, কখনও পাহাড়ের একটু ওপরে। এতে কি হলো পারো থেকে দেড় ঘণ্টার পথ আমরা এলাম তিন ঘণ্টায়। থিম্ফু গেট পার হতেই চোখে পড়লো পাখির মতো ঝাঁকে ঝাঁকে আসছে স্কুল ফেরত ছাত্র-ছাত্রীরা। কারো কোনো তাড়া নেই। সবাই হেসে খেলে বাড়ি ফিরছে। হাসতে হাসতে একে অন্যের উপর হেলে পড়ছে। ওদের কাণ্ড দেখে আমারও খুব হাসি পেতে লাগলো। খুব অবাক হলাম ছোট ছোট বাচ্চারা একা একা যাচ্ছে। কেউ কোথাও বসে গল্প করছে।

কাউকে কাউকে দেখলাম ভাগাভাগি করে টিফিন খাচ্ছে। গাড়িতে কেবল দূর থেকে আসা ছাত্র-ছাত্রীদের ফিরতে দেখলাম। তাও সেটা হাতে গোনা। যে রকম হাসিখুশি আর দুশ্চিন্তাহীন ওরা চলাফেরা করছে তা ঢাকায় আমি কল্পনাও করতে পারি না। আমাদের উৎসাহ দেখে সোনাম মামা আমাদের বিভিন্ন স্কুলের সামনে নিয়ে গেল। বাবা সেখানে যেই ছাত্র-ছাত্রীদের পাচ্ছে তাদের সাথেই হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠছে। তুলছে ছবিও। সোনাম মামা আমাদের সঙ্গে একজনের পরিচয় করিয়ে দিলেন। তিনি স্কুলের কাউন্সিলর এবং মনস্তত্ত্ববিদ। তিনি আমাদের ভুটানের শিক্ষা সম্পর্কে ধারণা দিলেন। আগেই খেয়াল করেছিলাম –মাত্র দু’দিন আগে বিশ্বকাপ  শেষ হলো অথচ কোথাও পতাকা উড়ছে না। কারণ জিজ্ঞাসা করতেই তিনি জানালেন- তারা এখনই ছেলেমেয়েদের অন্য দেশের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে চান না।

তিনি আরো জানান, সব স্কুলেই ছেলে মেয়েদের কাছ থেকে তাদের সমস্যার কথা জানতে চাওয়া হয়। স্কুলের ছোট ছেলে-মেয়েরাও নানা মানসিক সমস্যায় থাকতে পারে বলে তারা মনে করেন। থিম্ফু গেট দিয়ে ঢোকার পর থেকেই লক্ষ্য করছিলাম, একজন আছেন আমাদের সঙ্গে। যেদিকেই আমরা যাই না কেনো। বোটানিক্যাল গার্ডেন, রিসোর্ট, মার্কেট, সচিবালয়, রাজার বাড়ি সব দিকেই তিনি আছেন। বলছি বুদ্ধের কথা। পাহাড়ের উঁচুতে তাকে এমন একটি জায়গায় বসানো হয়েছে, যেনো থিম্ফুর যে কোনো প্রান্ত থেকে ব্রোঞ্জের তৈরি মূর্তিটি চোখে পড়ে। গেলাম সেই মূর্তির কাছেও। গিয়েই জানলাম মূর্তিতে খণ্ড খণ্ড করে জাহাজে করে নিয়ে আসা হয়েছে থাইল্যান্ড থেকে। তবে পাহাড়ের চারপাশে যেভাবে দেয়াল তোলা হচ্ছে সেটা দেখে ভালো লাগলো না। কেমন যেনো প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হচ্ছে।

বুদ্ধ’র কাছ থেকে ফেরার সময় হঠাৎ মায়ের খুব মাথা-ব্যথা শুরু হলো। আমরা কোনো ফার্মেসি খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আর ঢাকায় প্রতি অলিগলিতে ফার্মেসি। সোনাম মামা জানালো- ভুটানের মানুষ এখনো ফাস্টফুডে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি। এছাড়া ওরা রুটিনের বাইরেও কিছু খায় না। তাই অসুখও কম, ফার্মেসিও কম। সোনাম মামা আরো বলল, ইদানীং ফাস্টফুডের চল হওয়ায় ভুটানে ক্যানসার ছাড়াও বিভিন্ন রোগ দেখা দিতে শুরু করেছে।

এরপর আমরা রওয়ানা হলাম, ভুটানের জাতীয় স্টেডিয়াম দেখতে। অনেক বড় মাঠ। বাবা জানালো মাঠটিতে নাকি টার্ফ বসানো। দু’তিনটি দলে ভাগ হয়ে অনুশীলন চলছে। বাবা বল নিয়ে একটু দৌড়াদৌড়ি করলো। ততোক্ষণে সন্ধ্যা নেমেছে। থিম্ফুর দখল নিতে শুরু করেছে মেঘ। আমরা রিসোর্টের পথে রওনা দিলাম। যেতে যেতে দেখতে পেলাম রাজার বাড়ি কেমন আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে।

পরদিন মেঘ ফুঁড়ে আবার যখন আমরা আকাশে তখনও আমার মন পড়ে আছে পাহাড়ী নদী, আপেল গাছ আর পাহাড়ের শরীর জুড়ে ফুটে থাকা বনফুলে। আমি বাবার দিকে হেলে বায়না ধরলাম, বাবা আমি আর কোনো দেশে যেতে চাই না। শুধু ভুটানেই আসতে চাই।

প্রিয় পাঠক, ভ্রমণ যাদের নেশা, বেড়ানোর সুযোগ এলে যারা উড়িয়ে দেন সব বাধা, কাজের অংশ হিসেবে যারা ভ্রমণ করেন কিংবা যাদের কালেভদ্রে সুযোগ হয় ভ্রমণের তারা সবাই হতে পারেন ট্রাভেলার্স নোটবুক’র লেখক। আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন বাংলানিউজের পাঠকদের সঙ্গে।

আর একটা কথা লেখার সঙ্গে ছবি পাঠাতে ভুলবেনই না, সেই সঙ্গে বাতলে দিন সেখানে যাওয়ার পথঘাটের বিবরণও।

প্রিয় পাঠক, আপনার ভ্রমণ আনন্দ বিশ্বজুড়ে বাঙালির কাছে ছড়িয়ে দিতে আমাদের ই-মেইল করুন  [email protected] এই ঠিকানায়।

বাংলাদেশ সময়: ০১৪৫ ঘণ্টা, আগস্ট ০৬, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।