আন্তঃনগর চিত্রা এক্সপ্রেস থেকে: ইসমাইল ইসলাম (০৯)। একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র হলেও জীবিকার তাগিদে এবং নিজের লেখাপড়ার খরচ চালাতে রাতে বিভিন্ন ট্রেনে ট্রেনে ঘুরে ফল বিক্রি করে সে।
রোববার রাতের ট্রেনে ঢাকা থেকে খুলনায় যাওয়ার পথে বঙ্গবন্ধু সেতুর আগে দেখা হয় ইসমাইলের সঙ্গে। রাত ১১টার দিকে চিত্রা এক্সপ্রেস যখন টাঙ্গাইল স্টেশনে থামে তখন ওই ট্রেনে ওঠে ইসমাইল। মাথায় একটি স্টিলের বড় গামলা, আর গামলা ভর্তি কলা।
ট্রেনের শেষ বগিতে ওঠা ইসমাইল মাঝামাঝির বগিতে কলা বিক্রর জন্য যখন আসে তখন ট্রেন বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব পাড় স্টেশনের কাছাকাছি। ইসমাইল তার কলা বিক্রির জন্য ট্রেনে যখন আমাদের একদম কাছাকাছি তখন সামনের সিটের এক ব্যক্তি তার কাছ থেকে কলা কেনার জন্য গতিরোধ করেছেন।
ওই ক্রেতার কাছে অপেক্ষার মাঝেই পাশের ছিটের একটি ইংরেজি দৈনিকের খুলনা প্রতিনিধি ও আমার ভ্রমণ সঙ্গী দিপঙ্কর দাদা ডেকে বসলেন ছেলেটিকে। ওমনি চোখ পড়ল ছেলেটির দিকে। কাছে আসতেরই আমর প্রশ্ন, আচ্ছা কলায় ফারমালিন আছে তো। ইসমাইলও বেশ স্মাইলিং ফেসে (হাস্যোজ্জ্বল ভাবে) জবাব দিল না, আমরা ফরমানিল দেই না।
এরই মধ্যে পাশের দাদা কলার দাম জানতে চাইলো আর দেখতে শুরু করলো তার কাছে থাকা ফল। নিজের অজানতেই আমি তখন ছোট ছেলেটির নাম জানতে চাইলাম। সে বলল, আমার নাম ইসমাইল, ইসমাইল ইসলাম। হঠাৎ করেই জানতে ইচ্ছে হল, আচ্ছা ছেলেটি কি লেখাপড়া করে? করলে কোন ক্লাসে পড়ে, কোথায় বাড়ি আরো নানান প্রশ্ন।
কিন্তু ইসমাইলের কাছে আমার এসব প্রশ্ন করার আগেই ট্রেন পৌঁছে গেছে বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব পাড় স্টেশনে। তাই দ্রুত জানতে চাইলাম ভাই তুমি কি এই স্টেশনে নামবা? ইসমাইল মাথা নেড়ে বলে হ্যাঁ। শুনেই যেন আমর ভেতরে একটু ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেল। তাই দ্রুত মামাত ভাই হৃদ্য এর কাছ থেকে ক্যামেরা নিয়ে চট জলদি কয়েকটি ছবি তুলে ফেললাম। এবার আমি পিছু নিলাম ইসমাইলের।
শুরু হলো আমার প্রশ্ন, আর ছোট্ট ইসমাইলের কৈতুহল ভরা উত্তর.....
ইসমাইল জানায়, সে টাঙ্গাইলের কালিহাতি উপজেলার ভেড়ামারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণির ছাত্র। বাবা-মা ছাড়াও পরিবারে তার তিন বোন ও দুই ভাই। ভাইদের মধ্যে বড় ইসমাইল। এক বোনের বিয়ে হয়েছে। আর বাকি দু’বোন সায়মা ও তাহমিনার একজন পড়ে ৬ষ্ঠ শেণিতে আর অন্য জন ২য় শ্রেণিতে।
অর্থিক অবস্থা ভালো না হওয়ায় পরিবারকে সাহায্য করতে এই ছোট্ট বয়সে ট্রেনে ফল বিক্রি শুরু করা ইসমাইলের সঙ্গে কথা বলতে বলতে একটা ছোট ধারণা পাই তার পুরো পরিবার সম্পর্কে। তার বাবা টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতি উপজেলার সতোন গ্রামের রবিউল ইসলাম। পেশায় একজন বাবুর্চি সহকারী। বসত বাড়ি ছাড়া নেই নিজের অন্য কোন জমিও। তাই আবাদ বা কৃষি কাজও করার সুযোগ নেই তাদের।
কথায় কথায় ইসমাইল জানায়, প্রতিদিন সন্ধা ৬টার পর থেকেই বাড়ির কাছের বঙ্গবন্ধু সেতু সংলগ্ন স্টেশনে ফল বিক্রির জন্য আসে সে। বাবা-মা তাকে যেদিন যে ফল এনে দেয় তা নিয়েই স্টেশনে আসা নানা গন্ত্যবের ট্রেনে উঠে পড়ে সে। এভাবে এক ট্রেন থেকে অন্য ট্রেনে করে কোনো দিন গভীর রাত পর্যন্ত, আবার কোনো দিন সারা রাত চলে তার এই ফল বিক্রি।
ইসমাইল জানায়, প্রায় প্রতিদিন রাতেই কোন না কোন স্টেশনে ঘুমাতে হয় তার। এর মধ্যে ট্রেন এসে পড়লে আবার তাতে উঠে শুরু হয় তার ফল বিক্রি। এর মধ্যেই ইসমাইল চালিয়ে যাচ্ছে তার লেখা পড়া।
জনতে চেয়েছিলাম প্রাইভেট পড়া হয় কি? সে বলে না। টাকা পাব কই যে প্রাইভেট পড়ব? বাড়িতে বিদ্যুৎ নেই ইসমাইলের। তাতে কি, জীবণ প্রদীপ জ্বালাতে ঠিকই নিজেকে গড়ে তুলতে চায় ইসমাইল। স্বপ্ন দেখে বড় হতে। ভাল মানুষ হতে।
ট্রেন তখন যাত্রা বিরতি শেষে আবারও খুলনার গন্তব্যে রওনা দিবে। বাজলো হুইসেল তাই ইচ্ছা থাকলেও আর কথা বলার সুযোগ হয় না ছোট্ট ইসমাইলের সঙ্গে। বিদায় নেবার আগে মুহূর্তে ছোট্ট ইসমাইলকে বুকে জড়িয়ে ধরে জানতে চাইলাম- আচ্ছা বড় হয়ে কি হতে চাও তুমি?
একটু ক্ষণ আমর মুখের দিকে চেয়ে ইসমাইল বলল, ভাইয়া, লেখা-পড়া করে বড় হয়ে আমি ট্রেনের চালক হবো। ট্রেন চালাব, সব দেশে ঘুরে বেড়াব।
বাংলাদেশ সময়: ০৪৩৪ ঘণ্টা, ১১ আগস্ট ২০১৪