দশ মিনিট লাইনে দাঁড়িয়ে কেদা ফেরি ঘাট থেকে কোয়াগামী লঞ্চে উঠি। লাঙ্কাউইয়ের ফেরিঘাটের নাম কোয়া।
কুয়ালালামপুর থেকে রিজার্ভ করা প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি হস্তান্তর (টিটিটি)-এর মাইক্রো নিয়ে চালক আহমেদ থাকলেন কেদায়। সামনের দিকের আসনে জায়গা হলো আমাদের। যাত্রীদের বিরাট একটা অংশ আমাদের মতো ভিনদেশি। আবার মালয়দের অধিকাংশই লাঙ্কাউইয়ের নয়। প্রকৃতির সান্নিধ্যে সময় কাটাতে সাপ্তাহিক ছুটিতে দেশের নানাপ্রান্ত থেকে তারা ছুটছেন লাঙ্কাউইয়ে।
যাত্রার অল্পক্ষণ পরই টিভির পর্দায় ভেসে ওঠে চাইনিজ ছবি। পাশে বসা মালয় তরুণেরা ফাইটিং নির্ভর সিনেমাটি বেশ উপভোগ করছিল। সামনের আসনে বসা যাত্রীর বছর দুয়েকের মেয়ে খুব চঞ্চল। হাত বাড়াতেই চলে আসে আমাদের কাছে। যেনো কতোদিনের পরিচিত! মেয়ের দুরন্তপনায় সলাজ হাসি মায়ের। পাশের সিটের প্রৌঢ়া একটু পরপর মোবাইলে কথা বলছেন। ষাটোর্ধ্ব মহিলা একাই যাচ্ছেন লাঙ্কাউইয়ে। হয়তো একারণেই আপনজনেরা বার বার খোঁজ নিচ্ছেন। দু’বার বেশ শব্দ করে দুলে ওঠে লঞ্চ। কিঞ্চিত ভয়ার্ত হই।
পৌনে দু’ঘণ্টা পর লঞ্চ ভিড়ে কোয়া ফেরিঘাটে। টার্মিলানের মাঝেই বহু দোকানপাট। প্রসাধনী, গহনা, শোপিস, খেলনা, মেয়েদের পোশাক, ফাস্টফুড সবকিছুই আছে। টার্মিলানের বিপরীত দিকে বিরাট মার্কেট। কেদায় গাড়ি রেখে আসায় নতুন করে গাড়ি নিতে হলো। আমীরের হাতে চাবি দিয়ে বিদায় নেয় চালক। আমীর এবার নিজেই চালক। ড্রাইভিংয়ে বেশ পটু তিনি। মিনিট পাঁচেক পর মধ্যাহ্নভোজে নিয়ে গেল আমীর। কুয়ালালামপুরের মতো এখানেও খাবার নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। যথারীতি বাঙালি খাবার। দ্রুত খাওয়া সেরে পাশের মসজিদে যোহরের নামাজ সারলাম। গাছ-গাছালি বেষ্টিত মসজিদটি নয়নাভিরাম। স্বর্ণখচিত মূল গম্বুজ। রয়েছে পিচ কালারের অসংখ্য ছোট ছোট গম্বুজ। মসজিদের মূল কক্ষের দেয়ালে খোদাই করা কোরআনের আয়াত। পরে জানলাম এটি লাঙ্কাউই দ্বীপের অন্যতম দর্শনীয় স্থাপনা মসজিদ আল হানা। মসজিদটির কাঠামো দৃষ্টি নন্দন।
খাওয়া শেষে ছুটলাম নির্ধারিত হোটেলে। কিন্তু একি! এর থেকে পুরান ঢাকার হোটেলও ভালো। সবার চোখে-মুখেই বিরক্তি। শেষ পর্যন্ত হোটেল পরিবর্তন হলো। হোটেল সুপার ওয়ানের অবস্থান চমৎকার। জানালা দিয়ে দেখা যায় কোয়া উপসাগরের অপরূপ সৌন্দর্য।
দুই ঘণ্টার বিশ্রাম শেষে আবারো ছুটে চলা। এবারকার লক্ষ্য চেচাং বিচ। চমৎকার উঁচু-নিচু রাস্তা। আমীর জানান মালয়েশিয়ার আধুনিকায়নের আরো অনেক উদ্যোগের মতো এককালের বিচ্ছিন্ন দ্বীপ লাঙ্কাউইয়ের আজকের বিশ্বজোড়া খ্যাতি মাহাথির মোহাম্মদের দূরদর্শিতার ফসল।
কোয়া শহর ছেড়ে দুই পাশে গ্রামের মধ্য দিয়ে এগুতে থাকে গাড়ি। কোনো কোনো বাড়ির সামনে কলা গাছ। কিছু কিছু বাড়িতে করা হয়েছে সবজির আবাদ। দু-একটি কাঠের দোতলা বাড়িও দেখা গেল। ত্রিশ মিনিট পর গাড়ি থামল চেচাং বিচে। বিচের দৈর্ঘ্য খুব বেশি নয়। দৃষ্টিসীমার মধ্যে পুরো সৈকত। সাগর অনেকটাই শান্ত। নেই কক্সবাজারের মতো জলরাশির গর্জন। তীর ঘেঁষা সবুজ বৃক্ষসমেত টিলা বর্ধিত করেছে সৈকতের সৌন্দর্য। এ যেন একের ভেতর দুই। একদিকে সমুদ্র অন্যদিকে পাহাড়।
দলের অন্যরা বিচে খানিক ঘোরাঘুরি শেষে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন রাস্তার ওপারের শপিংমলে। আমরা জুনিয়র গ্রুপ (জসিম স্যার, নওশের ও আমি) ছুটলাম আমাদের মতো। সমুদ্রে এসেছি অথচ পানিতে ঝাঁপ দিবো না তা কি হয়! সঙ্গে আনা সমুদ্র উপযোগী পোশাক পরে শুরু হলো আমাদের দাপাদাপি। যথারীতি এখানেও বিদেশিদের আনাগোনা বেশি। শ্বেতাঙ্গ থেকে কৃষ্ণাঙ্গ, ইউরোপিয়ান থেকে অ্যারাবিয়ান সবাই আছেন।
সমুদ্র স্নান শেষে পরিশ্রান্ত দেহে ফিরলাম বেলাভূমে। প্যারাশুট করে আকাশপানে উড়াল দিলো নওশের ও জসিম স্যার। উচ্চতা ভীতির কারণে আমি থাকলাম সমুদ্রতটে তাদের জিনিসপত্রের পাহারাদার হয়ে। ব্যবস্থাপকরা জানান ত্রিশ মিনিটেই শেষ হবে নতুন নভোচারীদের আকাশ ভ্রমণ। কিন্তু নওশেররা ফিরলো এক ঘণ্টা পর। নাই হকারের হাঁকডাক। তাই একান্তে, একাগ্রচিত্তে সন্ধ্যাকালীন সমুদ্র দর্শন ছিল বেশ উপভোগ্য।
ফিরতি পথে আমীর নিয়ে গেল কোয়ার সবচেয়ে বড় চকলেট দোকানে। ক্রেতার পদভারে মুখরিত পুরো দোকান। প্রায় অর্ধশত বিক্রয়কর্মী সদা ব্যস্ত ক্রেতার চাহিদা পূরণে। দলের সবার চকলেট ব্যাগে ভরে যায় গাড়ির পিছন দিক। নৈশভোজ সেরে ছুটলাম হোটেলের পার্শ্ববর্তী ভাসমান দোকানগুলোতে। প্লাস্টিকের বিশালাকার ছাতার নিচে টেবিলে সজ্জিত পণ্য সম্ভার। কেউ কেউ রাস্তায় মাদুর পেতে বসিয়েছেন পণ্যের পসরা। অধিকাংশই দোকানিই তরুণী। রাস্তায় হলেও আমাদের মতো জন চলাচলের পথ কিংবা ফুটপাত দখলে নিয়ে বাণিজ্য নয়। ভাসমান ব্যবসায়ীদের জন্যেই স্থানীয় প্রশাসন নির্মাণ করেছে এমন জায়গা।
রাত ঘনিয়ে আসায় ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছিল অনেকেই। ভাসমান ব্যবসায়ী হলেও আমাদের হকারদের মতো এরা বিত্তহীন নয়। কার কিংবা মাইক্রোতে সবাই তুলে নিচ্ছেন নিজেদের সামগ্রী। কথা বলে জানা গেল গাড়িগুলো তাদের নিজস্ব। গাড়ি করেই সকালে আসা ও রাতে ফেরা।
পরিচিতরা জানান, লাঙ্কাউইতে উপহার সামগ্রী তুলনামূলক সস্তা, তাই কুয়ালালামপুরে কেনাকাটায় বিরত থাকি। বাস্তবে পেলাম বিপরীত চিত্র। টুইন টাওয়ার্স খচিত যে শোপিস কুয়ালালামপুরে কিনেছি পাঁচ রিঙ্গিটে লাঙ্কাউইতে এর জন্য গুনতে হয়েছে নয় রিঙ্গিট।
পরদিন সকালে দেখা হলো কোয়া উপসাগরের তীর ঘেঁষা ঈগল স্কোয়ার। বারো মিটার উঁচু লালচে বাদামি রংয়ের ঈগল মূর্তিটি লাঙ্কাউইয়ের অন্যতম দর্শনীয় স্থাপত্য নিদর্শন।
সাগরের তীরে দাঁড়িয়ে নীলাভ জলরাশি আর দূরের পোতাশ্রয়ে পণ্যবাহী জাহাজের আনাগোনা ভরিয়ে দেয় নয়ন যুগল। সাগরের পানিতে পড়া দূর পাহাড়ের ছায়া জীবন্ত করে তুলেছে চারপাশ। এ সৌন্দর্য যেন ভাষাতীত। তীব্র সৌরোত্তাপে রোদ চশমা ছাড়া তাকানো দায়। তবু কমতি নেই দর্শনার্থীদের পদচারণার। আছেন সব বয়সের মানুষ। এমনই একজন অনুরোধ জানান দুই বন্ধুর যুগল ছবি তুলতে। ভিয়েতনামী দুই বন্ধু নিজেদের ক্যামেরায় তুললেন আমাদের ছবি। তাদের সঙ্গে ছবি তোলা হলো না আমাদের, তার আগেই দলনেতার ডাকে ফিরতে হয়।
কুয়ালালামপুর থেকে বিমান, সড়ক ও রেলপথে যাওয়া যায় লাঙ্কাউই। এয়ার এশিয়া, মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনস ও ফায়ার ফ্লিজ বিমান প্রতিদিন কুয়ালালামপুর থেকে ছুটে যায় লাঙ্কাউইয়ের পথে। ভাড়া হবে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা। লাঙ্কাউই বিমান বন্দর এখানকার প্রধান শহর কোয়া থেকে বারো কিলোমিটার দূর। বাকী পথটুকু যাওয়া যায় সার্ভিস বা প্রাইভেট গাড়ি করে।
কুয়ালালামপুর থেকে এক্সপ্রেস লাঙ্কাউই ট্রেনে ছয় ঘণ্টায় কুয়ালা কেদায় এবং সাত ঘণ্টায় কুয়ালা পারলিসে যাওয়া যায়। বাসেও প্রায় একই সময়ে কুয়ালা কেদা ও কুয়ালা পারলিসে পৌঁছা যায়। কেদার ট্রেন ভাড়া সাতশ’ থেকে দেড় হাজার টাকা, পারলিসে ভাড়া নয়শ’ থেকে এক হাজার আটশ’ টাকা। অন্যদিকে বাসে কেদায় যেতে লাগবে আটশ’ টাকা আর পারলিসে এক হাজার। সেখান থেকে ফেরি করে লাঙ্কাউই। সময় নেবে যথাক্রমে এক ঘণ্টা ৪৫ মিনিট ও এক ঘণ্টা ২০ মিনিট। ভাড়া লাগবে তিনশ’ ৬০ টাকা ও দুইশ’ ৯০ টাকা। থাকা-খাওয়ার ব্যয় কুয়ালালামপুর কিংবা জর্জ টাউন থেকে লাঙ্কাউইতের চেয়ে সামান্য বেশি। তবে অবশ্যই সাধারণের সাধ্যের মধ্যেই।
প্রিয় পাঠক, ভ্রমণ যাদের নেশা, বেড়ানোর সুযোগ এলে যারা উড়িয়ে দেন সব বাধা, কাজের অংশ হিসেবে যারা ভ্রমণ করেন কিংবা যাদের কালেভদ্রে সুযোগ হয় ভ্রমণের তারা সবাই হতে পারেন ট্রাভেলার্স নোটবুক’র লেখক। আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন বাংলানিউজের পাঠকদের সঙ্গে।
আর একটা কথা লেখার সঙ্গে ছবি পাঠাতে ভুলবেনই না, সেই সঙ্গে বাতলে দিন সেখানে যাওয়ার পথঘাটের বিবরণও।
প্রিয় পাঠক, আপনার ভ্রমণ আনন্দ বিশ্বজুড়ে বাঙালির কাছে ছড়িয়ে দিতে আমাদের ই-মেইল করুন[email protected] এই ঠিকানায়।
লেখক: মিনহাজুল ইসলাম জায়েদ, বিসিএস (ইকনমিক)
সহকারী প্রধান, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ, অর্থ মন্ত্রণালয়
বাংলাদেশ সময়: ১০০২ ঘণ্টা, আগস্ট ১১, ২০১৪