জাদিপাই ঝরনার কথা আমি প্রথম শুনি বগালেকে। যিনি বলেছিলেন, তার চোখ-মুখ উত্তাল, আবেগে আপ্লুত- ‘বুঝলেন ভাই, সেই রকম ঝরনাটা, এতো পানি, আপনি দাঁড়ানোর জায়গা পাবেন না।
এখনো কোনো বাঙালি নাকি ওইখানে যায় নাই, শুনে অবাক লাগে! কোনো বাঙালি যায় নাই, এতো বড়ো কথা। আমি তখন চাকরি করি গ্রামীণফোনে। আমার নেওয়া ছুটি প্রায় শেষ। তাই বল্লাম, ভাই এতোদিন তো আমার ছুটি নাই, যে আপনাদের সাথে যাবো জাদিপাই ঝরনায়, বরঞ্চ চলেন আপনাদের জাদিপাই ঝরনার পথে কিছুটা এগিয়ে দেই। আমি কালকে কেওক্রাডং পাহাড় পর্যন্ত যাব, তারপর আপনাদের রেখে চলে আসবো। সবাই রাজি হয়, পরদিন আমাদের যাত্রা শুরু হয় বগালেক থেকে।
আমার বন্ধুদের এই দলে আমি সহ অভিযাত্রী আছেন পাঁচ জন। গল্প করতে করতে আমরা একের পর এক পাহাড় ডিঙ্গাই। বগালেক হতে রওনা হয়ে চিংড়ি ঝিরি ঝরনা হয়ে আমরা আসি দার্জিলিং পাড়া। দলের এক অংশ দার্জিলিংপাড়ায় রাত্রে থাকার ঘর খুঁজতে থাকে। কারণ আজকে ওরা এখানেই থাকবে। কালকে ওরা এখান থেকে প্রথম বারের মতো যাবার চেষ্টা করবে জাদিপাই ঝরনার দিকে। আমি যেহেতু জাদিপাই ঝরনায় এবার যাব না, ফিরে যেতে হবে ঢাকা কালকেই; তাই আমি আমার গাইড নিয়ে কেওক্রাডং পাহাড়ের দিকে রওনা হই।
পাহাড়ে বেড়ানো আমার নেশা, পেশা নয়। খুব খারাপ, ঘর ছাড়া করানো এক নেশা এটা। যার এই নেশা একবার হয় তার সব শেষ। এখন প্রতিমাসে আমার একবার পাহাড়ে যেতে হবেই। নয়তো মনে হয় কি যেন দেখা হয় নাই, করা হয় নাই। কবির ভাষায়-
‘আলো-অন্ধকারে যাই, মাথার ভিতরে/স্বপ্ন নয়, প্রেম নয় কোন এক বোধ কাজ করে/আমি তারে পারি না এড়াতে
সে আমার হাতে রাখে হাতে/জগতের সকল কাজ তুচ্ছ হয়, পন্ড মনে হয়।
চিন্তা, প্রার্থনার সকল সময়/শূন্য মনে হয়, শুধু শূন্য মনে হয়। ’
আমার গাইডের নাম লালচয়সাং বম, ওকে নিয়ে আমি কেওক্রাডাং পাহাড় হতে ফিরে আসি বগালেক, তারপর ঢাকায় এসে বিভিন্ন কাজের ব্যস্ততায় ভুলেই যাই, জাদিপাই ঝরনার কথা। হঠাৎ ফোন পাই অফিসে, বিষয়বস্তু একটা ভিডিও ক্লিপ দেখার নিমন্ত্রণ, জিনিসটা কী? জবাব পাই, একটা খুব সুন্দর ঝরনার ক্লিপ, বুঝলেন আনোয়ার ভাই, পাগল হয়ে যাবেন- প্লিজ একবার এসে দেখে যান। আমি কিছুটা বিব্রত, একটু সন্দিহান, যে আমাকে এমন কথা বলছে, তার এমন কথা বলার কথা নয়, তাহলে ঘটনাটা কী? আমন্ত্রণকারীই ব্যাপারটা খোলসা করে বলে, ঝরনাটার নাম ‘জাদিপাই’। আমি সাথে সাথে বলি অবশ্যই দেখবো ভিডিও। যথা সময়ে যাই বন্ধুর বাসায়, মনে টেনশন, কি এমন সুন্দর? এতোই সুন্দর? ভিডিও ক্লিপ চালানো হলো, আমরাও চল্লাম, দেখা শেষ হবার পর বল্লাম- আবার চালাও, তারপর আবার এবং আবার। জাদিপাইয়ের নেশা আমার পিছু ছাড়ে না, শুধুই বাড়ে, কমে না। মাথার ভিতরে কে জানি ফিসফিসিয়ে বলে, ‘চল যাই যাদিপাই ঝরনায়। ’
বন্ধুর বাসা হতে বের হয়েই আমার পাহাড়সঙ্গী বন্ধুদের ফোন করলাম। চারজনের দল প্রস্তুত হলো, সামনের সপ্তাহের ছুটির দিনগুলোতে আমার সাথে যাবে, গন্তব্যস্থল জাদিপাই ঝরনায়, সময়টা ছিল সেপ্টেম্বর-২০০৬। যখন আমি বলি, আমি পাহাড়ে যাবো, আশে-পাশের সবাই তখন গলা মিলায়, আমিও যাবো- আপনার সাথে। জবাবে আমি বিনম্র হাসি, বলি অবশ্যই যাবেন। কিন্তু আমার অবচেতন মন বলে, সাবধান নেশার পরিধি বাড়াস না পাগল। কিন্তু মন আমার পাগলা ঘোড়ার মত, কই থেইকা আমারে যে কই নিয়া যায়।
দল ঠিক করেছিলাম চারজনের, ছোট দল- হুটকরে যাবে, ঝরনাটা দেখে, ভিডিও করে চলে আসবে। সবাই কমপক্ষে, দুইবার কেওক্রাডং ওঠা লোক- জানে আমার হাঁটাহাঁটির ধরন, কিন্তু যতই ভ্রমণের দিন কাছে আসতে থাকে আমি ফোন পেতে থাকি- আনোয়ার ভাই, এবার ছুটি পাচ্ছি না। মনে হয় না যেতে পারবো- এই জাতীয় বাণী, আমার মনটাকে খারাপ করে দেয়। এদিকে আমার ছুটি নেওয়া হয়ে গেছে, ব্যাগ গুছানো শেষ বহু আগেই। আমার চার জনের অভিযাত্রী দল হয়ে গেছে দুজনের, বাকি দুজন খুব ব্যস্ত ঢাকায়, অফিস সংক্রান্ত ব্যস্ততায় তারা আমার ঝরনা অভিযান থেকে দলছুট হয়।
আমার হাতে এস আলম বাসের চারটা টিকিট আগেই বুকিং করা ছিল, এই অভিযানের জন্য। আমি সাধারণত এস আলম বাসেই সবসময় বান্দরবান যাই। বাস পাল্টাই, কেবল মাত্র টিকিট না পেলেই, কাজেই এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। যে বাসটা বান্দরবান যায় তার নাম্বার-১৩, ছাড়ে রাত ১১:০০ টায়। আমি নির্ধারিত তারিখে বাসস্টেশনে আসি রাত ৮টার সময়। উদ্দেশ্যে অতিরিক্ত টিকিট দুইটা বিক্রি করা। বাস স্টেশনে দাঁড়ানো, এমন সময় মুঠোফোন আমার শেষসঙ্গী বন্ধু জানালো, তার অপারগতার কথা, ‘ভাইয়া সন্ধ্যা থেকেই আমার লুজ মোশন হচ্ছে- প্লিজ ভাইয়া, এইবারের মতো মাফ কইরা দেন। ’ আমি মাফ করে দেই- বেচারা লুজ মোশন-এ আক্রান্ত, ইচ্ছা তো ছিলো, তবুও বেচারা আসতে পারলো না।
শেষ পর্যন্ত এই অভিযানে আমি একা, যাবো জাদিপাই ঝরনা, ভাবতে ভালো লাগে। আমি যাবই, কেউ যাক বা না যাক, দৃঢ় প্রতিজ্ঞ এই ব্যাপারে। একা একা বেড়ানোর মজা হলো, যা ইচ্ছা তা করা যায়, ইচ্ছা হলো তো ছবি তুলি, ইচ্ছা হলো তো বিশ্রাম, ইচ্ছা হলো তো ১০ মিনিট ঘুম, ইচ্ছা হলো তো দ্রুত হাঁটা বা জগিং। ভাবলাম দুইটা সিট থাক, একটায় আমার ব্যাগ বসবে, অন্যটায় আমি, ব্যাগ লাগেজে দিলে আবার আরেক টেনশন- ক্যামেরা ভেঙ্গে যায়- এই জাতীয় ব্যাপার। যেহেতু এখন ট্যুরিস্ট সিজন, বহুদল তাই এখন বান্দরবানমুখী। সবাই অভিযাত্রী, উত্তেজিত, বহুগল্প শুনি, বহু পরিচিত মুখ- অনেকে বলে, এইতো আনোয়ার ভাই। আমি হাসিমুখে বলি ‘কোথায় যাচ্ছেন, কতজনের দল, কবে ফিরবেন, ট্যুর প্ল্যান কী?’
ড্রাইভারের পাশে দেখি দুই তরুণ ছেলে, ছোট ব্যাগ বুকে চেপে দৃঢ় প্রত্যয়ে বসে আছে। যাবোই যাবো ভাব, যদি বনেটে বসতে হয়, তাও অসুবিধে নেই। আমার খুব ভালো লাগে। এটাই তো চাই! নিজের এত সুন্দর দেশটা একটু কষ্ট করে ঘুরে দেখ না, কত্তো সুন্দর শ্যামলীমা। পাহাড়, সাগরের মাতামাতি, লুকানো কত ঝরনার হাতছানি আমার দেশে।
গাড়ি ছাড়লো যথা সময়েই। গাড়িতে প্রায় সাতটা দল বড়, ছোট ও মাঝারি সাইজের। আমিই কেবলমাত্র দলহীন, একাকী অভিযাত্রী। এই গাড়ির সবাই প্রথমে যাবে বান্দরবান। তারপর কেউবা শুধু শহরেই ঘুরবে, কেউবা যাবে রুমা, বগালেক, কেউ যাবে কেওক্রাডং পাহাড় পর্যন্ত। আবার কেউ যাবে থানচি, তাজিং ডং পাহাড়ে। জাদিপাই ঝরনাতে যাবে এমন আমি একাই- তাই সবাই যখন প্রশ্ন করে কই যাবেন এইবার? আমি হাসি মুখে জবাব দেই, দেখি আল্লা কতদূর, যাইতে দেন। সেয়ানারা বলে, আনোয়ার ভাই আসলে বলতে চাচ্ছেন না উনি কই যাবেন, আমি মনে মনে বলি, মাফ করে দিও ভাই।
চলতি গাড়িতে অনেক মজার গল্প শুনি, ভুলতথ্য আদান প্রদান হয়- প্রতিবাদ করার মতো কেউই কি নাই? রুমা থেকে বগালেক হেঁটে গেলে দুই ঘণ্টা লাগে- যে বলতেছে তাকে দেখার জন্য গলা লম্বা করি। দেখি কে এই বীর পুরুষ, যে দুই ঘণ্টায় ঝিরি পার হয়। দেখি আমার পরিচিত এক ট্যুর গাইড, যে কিনা নিয়ে যাচ্ছে প্রায় ১০ জনের দল। তাকে বলি, দুই ঘণ্টা তো হয়তো তোমার ব্যক্তিগত সময়, সবারই কি দুই ঘণ্টা লাগবে? আমাদের প্রশ্নে বক্তা কিছুটা অপ্রস্তুত, মনক্ষুণ্ণ। আমারও মন খারাপ হয়, এভাবে কথাটা বলা হয়তো ঠিক হয় নাই।
আমার বিক্রি করে দেওয়া সামনের দুই সিটের একটায় একছেলে বসা আমাকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে থাকে, আমিও জবাব দেই। আমিও নানান প্রশ্ন করি, যার সারমর্ম পাই, তার বন্ধু মোরসালিন একটা দল নিয়ে যাচ্ছে কেওক্রাডং, যে কোনো কারণে তাদের দুজনের জায়গা হয়নি ওই দলে। তাই দুইজনে মনস্থির করে রওনা দিয়েছে দুই জন মিলেই যাবে কেওক্রাডং। মুরসালিনদের দলের পিছনে পিছনে হাঁটবে, ওরা যেখানে যায় সেখানেই এরা যাবে। কথা বার্তায় ছেলেটাকে ভালো লাগলো, নাম রিজওয়ান। ওর বন্ধুর নাম শাহনেওয়াজ, বেচারা সিট পায়নি বলে বনেটে সিট কিনেছে। বল্লাম আমার ব্যাগটা নামায়ে পায়ের কাছে রাখি, তোমার বন্ধু শাহনেওয়াজ কে বলো পেছনে এসে সিটে বসতে। এভাবেই এক চলন্ত বাসে রিজওয়ান ও শাহনেওয়াজের সাথে আমার পরিচয়, পরে বন্ধুত্ব। পাশাপাশি সারা রাত জেগে আমরা পাহাড় অভিযানের গল্প করি। সেই গল্প শুনে রিজওয়ান ও শাহনেওয়াজের চোখ চকচক করে; বলে ‘আমাদের আপনার সাথে নেবেন, আনোয়ার ভাই?’ আমি বলি, আগে বান্দরবানতো পৌঁছাই, তারপর দেখা যাবে।
আমরা বান্দরবনে পৌঁছাই ভোর সাতটায়। বাস কাউন্টার হতে হেঁটেই রওনা দেই রুমার চান্দের গাড়িস্ট্যান্ডের দিকে। ১৫ মিনিট হাঁটা পথ (আমার মাপে) গল্প করতে করতে পার হয়ে যায়। বাসস্ট্যান্ড হতে কাইখ্যানঝিরির টিকিট করে আমরা নাস্তা খাই, বাথরুম সারি। গাড়ি ছাড়বে সকাল সাড়ে আটটায় প্রথমটিপ। এরই ফাঁকে খাই ম্যালেরিয়া প্রতিষেধক ওষুধ। রিজওয়ান ও শাহনেওয়াজকেও বলি, তোমরাও খেয়ে ফেলো আল্লাহর নামে। ওরাও কাল বিলম্ব না করে খেয়ে ফেলে ম্যালেরিয়া প্রতিষেধক ওষুধ।
গাড়ি ছাড়ার আগেই রিজওয়ান ও শাহনেওয়াজের বন্ধু মোরসালিন এসে হাজির, ওরা ইউনিকে করে বান্দরবান আসছে। ওরাও এখন কাইখ্যানছড়ি যাবার জন্য একই গাড়ির টিকিট কাটে। ছবি তোলার জন্য আমি গাড়ির ছাদে বসি। এই দেখে বায়না ধরে রিজওয়ান ও শাহনেওয়াজ, ‘আমারও উপরে বসবো। ’ বল্লাম পারবে তো? জবাবে দুইজন এক সাথেই বললো ‘অবশ্যই পারবো’। রিজওয়ান একটা ইনসুরেন্স কোম্পানির উপ-ব্যবস্থাপক আর শাহনেওয়াজ বুয়েট হতে পাশ করা ইঞ্জিনিয়ার, ব্রাক ইউনভার্সিটির খন্ডকালীন প্রভাষক, এই আমার তিনজনের দল।
প্রথম দিনের গন্তব্য-বগালেক, আজ সন্ধ্যার মধ্যেই পৌঁছাতে হবে সেখানে। গাড়ির ছাদে বসে আশেপাশের পাহাড় ও পাহাড়ের নানান চড়াই উৎরাই-মোহনীয় সজীবতা খুব কাছ থেকে দেখা যায়। যারা ভালো ছবি তুলতে চান, তারা ছাদে না বসলে ভুল করবেন।
অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে, পাহাড়ি বাঁক এড়িয়ে, যখন আমরা কাইখ্যানছড়ি পৌঁছলাম, সূর্য তখন ঠিক মাথার উপরে তীব্র তাপ ছড়াচ্ছে। তাকে উপেক্ষা করে আমরা গাড়ি থেকে নেমে এলাম নৌকা ঘাটে। ঘাটে বড় নৌকা ও ট্রলার কোনটাই নেই, ছোট নৌকা এবং ছই নৌকা আছে, ভাড়া চাইল চারশ’ টাকা, রুমা বাজার পর্যন্ত। তখন আমি ঠিক করলাম যে, কাইখনছড়ি হতে হেঁটেই যাবো রুমা বাজার। রিজওয়ান ও শাহনেওয়াজকে বল্লাম, ‘আমি হেঁটে হেঁটে যেতে চাই রুমা বাজার, তোমরা কি বলো?’ ওদের কথা একটাই, ‘আপনি যা চাইবেন, আমরা তাই করবো। ’ বল্লাম, ৪৫ মিনিট সময় লাগবে। পারবা তো? এইবার দুইজনই একটু ক্ষুব্ধ- ‘ভাইয়া, সন্দেহ থাকলে পরীক্ষা হইয়া যাক। ’
বেচারারা এখনও বুঝে নাই পাহাড়ের রাস্তার মজা, তাই আর কথা না বাড়ায়ে হাঁটা দেই। ৪৫ মিনিটের পথ পার হতে প্রায় ১ ঘণ্টা লাগে আমাদের। ঠিক দুপুর ১টা বেজে ১০ মিনিটে আমরা রুমা বাজার পৌঁছাই।
বান্দরবান থেকে প্রায় ৪২ কিলোমিটার দূরে উপজেলা শহর রুমা। রুমা বাজারে পৌঁছে আমরা মামুন ভাইয়ের হোটেলে ঢুকলাম। উদ্দেশ্য বহুবিধ- তবে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- খাওয়া দাওয়া করা, গাইড ঠিক করা এবং কিছুক্ষণ বিশ্রাম। লাল চয়সাং বম আমার গাইড হয় সব সময়ই। তাই ওকে ফোন দিয়ে বল্লাম মামুন ভাইয়ের হোটেলে আসার জন্য। তারপর শাহনেওয়াজ ও রিজওয়ানকে বললাম, দুইটা রাস্তা আছে- গাড়িতে চড়ে বগালেক যাওয়া, আরেকটা হলো ঝিরি পথে, ট্র্যাকিং করে যাওয়া, কোন পথে যাইতে চাও তোমরা? ওরা ভাত খাইতে খাইতে ইশারায় যা বললো তার সারমর্ম হলো, ‘আপনে যেভাবে যাবেন, আমরাও সেইভাবেই যাবো- আর হাঁটাহাঁটি ব্যাপার না। ’
আমি মনে মনে বললাম, ‘তথাস্তু, বাবারা তোমরা ঘুঘু দেখছ, ঘুঘুর ফাঁদ দেখো নাই। ’ রুমা বাজারে সাপ্তাহিক হাট বসে প্রতি সোমাবার ও বৃহস্পতিবার। রুমা বাজারের থেকে রেজওয়ান ও শাহনেওয়াজের জন্য রুপালি স্যান্ডেল নামের স্ট্যাপঅলা স্যান্ডেল সু কিনে দিলাম, বল্লাম মোজা দিয়ে পড়ে নাও, বিনা প্রতিবাদে আমার আদেশ পালিত হলো। যথা সময়ে আর্মি ক্যাম্প ও পুলিশ ক্যাম্পে রিপোর্ট করে আমরা ঝিরিপথে রওনা হয়ে গেলাম।
ঝিরি পথ মানে পাহাড়ের বুক চিরে বের হওয়া ছোট বড় ঝরনার পানি এক হয়ে রুমা বাজারের কাছাকাছি সাঙ্গু নদীতে পড়ছে। সেই পথ অনেক এঁকে-বেঁকে এসেছে অনেক গভীর হতে। আমাদের চলার পথটা যেহেতু সোজা, তাই এই ঝিরিপথ আমাদের অতিক্রম করতে হবে প্রায় ৫৭ বার। যেহেতু বার বার পানিতে নামতে হবে- উঠতে হবে, আমরা থ্রি কোয়াটার প্যান্ট, স্যান্ডেল সু ইত্যাদি পড়ে নিয়েছি রুমা বাজারেই।
রুমা বাজার হতে ঝিরিপথে রওনা দিলেই প্রথমে পড়ে বিশাল এক পাহাড়। এই পাহাড় জুড়ে এক বম পাড়া আছে, যার নাম ‘লাইরুম্পিপাড়া’। এই পাড়াটা সারা পাহাড় জুড়ে প্রায় চূড়ার কাছাকাছি পর্যন্ত বিস্তৃত। এই পাহাড়ে অর্ধেক উঠেই শাহনেওয়াজ ও রিজওয়ান হাপাতে হাপাতে বললো, ১০ মিনিট বিশ্রাম চাই ভাইয়া। আমি জবাবে বল্লাম, হাঁটতে থাকেন, এখনো বিশ্রামের জায়গা আসে নাই। ওরা একে অন্যের মুখ চাওয়া চাউয়ি করে আমার পিছু নিল।
পাহাড়ের চূড়ায় উঠার পরের রাস্তা, শুধু নামা আর নামা- সোজা ঝিরির বুকে। তখন বর্ষার শেষ অবস্থা, তাও ঝিরিতে হাঁটু পানি। পরিষ্কার টলটলে ঠান্ডা বরফ পানি, মুহূর্তেই শরীর জুড়িয়ে দিল। ঘাড় মাথায় ঠান্ডা পানি দিয়ে, মুখ, হাত ভিজায়ে আবার শুরু হলো আমাদের পথ চলা। ঝিরিতে নেমে আমি আমার গামছাটা ব্যাগ থেকে বের করে তার একপাশ ভিজায়ে গলায় ঝুলিয়ে নিলাম। হাঁটতে হাঁটতে মুখ মুছা যাবে এটাই সুবিধা। হাঁটতে হাঁটতে আমরা ২.২০ মিনিটে পৌঁছালাম প্রথম বিশ্রাম স্থলে।
জায়গাটা হলো একটা টং দোকান, যেখানে কপাল ভালো হলে ফলমূল পাওয়া যায়। আমাদের কপাল ভালো, এক ডজন পাকা কলা ও একটা পাঁকা পেপে পাওয়া গেল। সব কিছু আমরা চারজন ভাগাভাগি করে খেয়ে নিলাম। এরপর সবাই গরম চা খেলাম, যা শরীরটাকে নিমিষেই চাঙ্গা ও ঝরঝরে করে তুলল। আশে-পাশে যতদূর দুচোখ যায়, বাদাম ক্ষেত করা হয়েছে, তারপর আচমকাই মাটি ফুড়ে মাথা তুলেছে ছোট-বড় টিলা, তার পিছনে আকাশ ছোঁয়া পাহাড়ের কালো অবয়ব ফুটে আছে। চোখ ধাঁধাঁনো তীব্র দুপুরের আকাশ এখন সাদাটে সোনালি। নীলচে সাদা রঙের খয়েরি ঠোঁট ওয়ালা মাছ রাঙা পাখি ক্ষ্যাপাটে হয়ে বার বার ঘাই দিচ্ছে পাশের প্রবাহমান ঝিরির পানিতে। মাঝে মাঝে তার খয়েরি ঠোঁটের মাঝে রুপালি ঝিলিক এক পলকেই মিলিয়ে যায়।
এরই মাঝে আমরা হেঁটে চলি, উঁচু নিচু পথ, খাড়া, চড়াই-উৎরাই, পানির তীব্র ঝাপটা, পাহাড়ের পাথরের পথে ক্রমাগত হাটতে থাকার ক্লান্তি যখন আমাদের দুর্বল করে দিচ্ছে ঠিক এমন সময়ই আমরা পৌঁছালাম বগামুখ পাড়ায়। আমার হাত ঘড়ির কাঁটা জানান দিচ্ছে সময় তিনটা বেজে ৪২ মিনিট। বগামুখপাড়াও একটি বমপাড়া, পাড়াটা একটু উপরে ও ভিতরে। চাইলেই এখানে রাতে থাকা যাবে, পাড়ার লোকজন যথেষ্ট অতিথি পরায়ন ও অল্প অল্প বাংলা বুঝে। আমাদের পথ যেখান দিয়ে গেছে, বগামুখ পাড়ার লোকজন তার দুপাশে বেশ কয়েকটা টং দোকানের মতো বানিয়ে রেখেছে, যাতে এই রাস্তায় যারা যায় বাঙালি, আদিবাসী ও ট্যুরিস্ট তারা যেন একটু থেমে বিশ্রাম নিতে পারে ও চা-পানি খেতে পারে। আমরাও তাই এখানে ব্যাগ নামিয়ে বিশ্রাম নিতে বসলাম।
আমার সঙ্গী দু’জন দৃঢ় প্রত্যয়ী; অত্যন্ত তীব্রভাবে প্রমাণ করার চেষ্টা করছে যে, তারা ঠিক আছে, আমিও খুশি, এমনইতো চাই। বগামুখ পাড়ায় এসে ঝিরির গর্জন সুতীব্র, কেননা পাথরে বাধা পেয়ে বিশাল জলধারা এখানে দিক পাল্টিয়েছে। আবার ১০ মিনিট বিশ্রামের পর আমাদের হাঁটা শুরু হল। হাঁটতে হাঁটতে আমরা যতই এগোলাম, বাতাস ততই ঠান্ডা হতে লাগলো। সূর্য সহসাই যেন মুখ লুকালো পাহাড়ের ছায়ায়। আমাদের হাঁটার গতি হঠাৎই যেন বেড়ে গেল। আমরা ঠিক এক ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম নারিসার ঝরনায়।
এখানে নারিসার ঝরনার বর্ণনা দিয়ে রাখি। দুইটা ঝরনা এক হয়ে মিশে সুতীব্র জল ধারা হয়ে বয়ে যাচ্ছে। এটাই এক অদ্ভুত প্রাকৃতিক সৌন্দয্যের জন্ম দিয়েছে ঝরনা-১ আমি যাকে ডাকি ‘নীল’- নামে সেটা প্রায় দশফিট উপর হতে একটা পাথরের ফোকরে পড়ছে। ক্রমাগত পানির আঘাতে প্রায় ৬ ফিট গভীর এক গর্ত আছে এখানে। এই গর্তভরে পানি উপচে পড়ে ক্রমাগত দমকে দমকে। জীবন এখানে অনেক মূল্যহীন মনে হয়- কতকিছু না দেখেই মরে যাবো আমরা। ঝরনা-২, যার নাম আমি দিয়েছি ‘কমল’ সে প্রায় ১৫ ফিট উঁচু হতে, আস্তে আস্তে নেমে এসে নীলের স্রোতের সাথে মিলে পাহাড়ের বুকে তৈরি করেছে অব্যাহত ঝিরির আলপনা। আমি বলি নীলকমলের ভালোবাসার মিলমিশের ফসল এই ঝিরিপথ। আমার কথা শুনে রিদওয়ানের চোখ উত্তেজনায় চকচক করে।
আমাকে বলে, ভাইয়া দাঁড়ান, প্লিজ- ছবি তুলি। ডিজিটাল ক্যামেরাতে- আমরা নানান ভঙ্গিতে ছবি তুলি। পায়ের তলায় নীল কমলের ফেনিল ধারা আমাদের ক্লান্ত পা গুলোকে প্রাকৃতিক তাপমাত্রায় সতেজ করে। আদিবাসীরা ও স্থানীয় জনগণ এই জলধারাকে বলে নারিসার ঝরনা। সূর্য এখনো ডুবে যায়নি, কিন্তু নারিসার চারিদিকে বেশ অন্ধকার। চারিদিকের পাহাড় এতো উঁচু যে, দিনের আলো এখানে অনেকটা নিম্প্রভ। তাই আমরা ব্যাগ হতে টচ লাইট বের করে আবার হাঁটা শুরু করি। কমলের পাশ দিয়ে পথ সোজা উপরের দিকে উঠে গেছে- পথটা খাড়া উঠেনি, কিছুটা জিগজ্যাগ ধরনের। আমরা যতই এই পথে উঠতে থাকি দিনের আলো ততই বাড়ে, এক পর্যায়ে আমরা টর্চের আলো নিভিয়ে দেই।
আমাদের পথের শেষেও, শুরুর মত প্রকান্ড এক বড় পাহাড় আছে, যেটা আমাদের টপকে যেতে হবে। বড় পাহাড়টায় উঠা শুরু হয় নারিসার ঝরনার পর থেকে। এটাই হলো এই পথের শেষ চ্যালেঞ্জ। এই পাহাড়টা এত খাড়া যে, উঠতে উঠতে রিদওয়ান ও শাহনেওয়াজ, দু’জনই প্রথমবারের হাপিয়ে উঠে। একটু পর পর বলতে থাকে, ‘আর কতটা পথ বাকি, আর কতদূর ভাই?’
বিকাল ৫টা বেজে ১০ মিনিটে আমরা শেষ বড় পাহাড়টার চূড়ায় উঠে আসলাম। এখানে একটা বিশাল গুড়ির পুরানো গাছ আছে, সেটায় হেলান দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে আমি নিচের দিকে তাকায়ে থাকি। প্রথমেই রিজওয়ান আর তার একটু পর শাহনেওয়াজও উঠে আসে। তারও পরে আসে লাল- একটুও ক্লান্ত না ছেলেটা। এই জায়গাটা আমার খুব প্রিয়, কারণ এখান থেকে দিগন্ত বিস্তৃত সবুজের উচুনিচু রেখার খেলা দেখা যায়। এইখান থেকে যতদূর চোখ যায় দিগন্ত পর্যন্ত সব আমাদের পায়ের নীচে- এতো সুন্দর এই সবুজের ব্যাপ্তি, আমাদের সারা দুনিয়া এখানে স্থবির । আমি, আমার হৃদস্পন্দন, আমার ছায়া, আমার নতুন হওয়া ক্লান্ত বন্ধু শাহনেওয়াজ ও রেজওয়া-সবই বিস্মিত বিহবল হয়ে এই চির হরিৎ সৌন্দর্য দেখতে থাকি। ডিজিটাল ক্যামেরার পর্দায়, এই অপার্থিব সৌন্দয্যের যতটুকু পারি বন্দী করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে থাকি আমি আর রিজওয়ান। কিন্তু কিভাবে এই বাতাসের ঝিরিঝিরি, পাখির ডাক, মাটির গন্ধ, ঘামের ঘ্রান, মোবাইলের নো নেটওয়ার্ক বার্তা সব কিছুকে আমার হৃদস্পন্দনের সাথে মিশিয়ে একটা ছবি বানাই?
এখান থেকে বগালেক প্রায় চল্লিশ মিনিটের পথ। বিশ মিনিটের বিশ্রাম, শেষে, আমরা আবার রওনা দেই, এখাকে একটা বড় মারমা পাড়া আছে; আমরা এটার পাশ কাটিয়ে ঠিক ছয়টা ত্রিশ মিনিটে আমরা আমাদের গন্তব্যে পৌঁছাই। আমি ওদের সাথে হাত মিলাই, বলি ‘বগালেক স্বাগতম। এক সাথে হেঁটে ভালো লাগলো। ’
বগালেকের সরকারি উচ্চতা ২ হাজার ৯ শত ফুট, যদিও আসল উচ্চতা জিপিএস যন্ত্র দ্বারা মেপে পাওয়া গেছে ১১৭৬ ফুট ± ৫০ফিট। এখানে পৌঁছানের পর গাইড সহ সবাইকে আর্মি ক্যাম্পে রিপোর্ট করা বাধ্যতামূলক, তাই আমরাও ক্যাম্পে গিয়ে রিপোর্ট করি। তারপর মালপত্র নিয়ে আমরা সবাই সিয়াম দিদির কটেজে উঠি।
আগামী পর্বে থাকছে-
যাদিপাই ঝরনার পথে-২
চিংড়িঝিরি থেকে যাদিপাই...
প্রিয় পাঠক, ভ্রমণ যাদের নেশা, বেড়ানোর সুযোগ এলে যারা উড়িয়ে দেন সব বাধা, কাজের অংশ হিসেবে যারা ভ্রমণ করেন কিংবা যাদের কালেভদ্রে সুযোগ হয় ভ্রমণের তারা সবাই হতে পারেন ট্রাভেলার্স নোটবুক’র লেখক। আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন বাংলানিউজের পাঠকদের সঙ্গে।
আর একটা কথা লেখার সঙ্গে ছবি পাঠাতে ভুলবেনই না, সেই সঙ্গে বাতলে দিন সেখানে যাওয়ার পথঘাটের বিবরণও।
প্রিয় পাঠক, আপনার ভ্রমণ আনন্দ বিশ্বজুড়ে বাঙালির কাছে ছড়িয়ে দিতে আমাদের ই-মেইল করুন[email protected] এই ঠিকানায়।
বাংলাদেশ সময়: ১১১০ ঘণ্টা, আগস্ট ১৬, ২০১৪