পূর্ব প্রস্তুতি নেই। ৪ অক্টোবর হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো পার্বত্য জেো বান্দরবানে যাবে।
ভ্রমণ দলে আছেন-মোরশেদ তালুকদারের (দৈনিক আজাদী, স্টাফ রিপোর্টার), শৈবাল আযার্চ্য (দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশের স্টাফ রিপোর্টার), আজহার মাহমুদসহ (দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশের স্টাফ রিপোর্টার), আবদুল্লাহ আল মামুন (বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমের স্টাফ রিপোর্টার) এবং মোস্তফা ইউসুফের (বিডিনিউজ২৪ডটকমের স্টাফ রিপোর্টার)।
নির্দিষ্ট দিনে সবাই চলে গেলাম বহদ্দারহাট বাস টার্মিনালে। সকাল ৭টায় যাত্রা করার কথা থাকলেও গাড়ির টিকিট সংকটের কারণে যেতে হল আটটায়।
বহদ্দারহাট থেকে দুই ঘণ্টার যাত্রায় বান্দরবান শহরে পৌঁছলাম। সেখান থেকে যেতে হবে বান্দরবানের উপজেলা রুমাতে। কিন্তু রুমা যাওয়ার পথে একটি কালভার্ট নির্মাণাধীন।
ফলে ওপারের বিকল্প গাড়ি না আসা পর্যন্ত সেখানে বসে থাকতে হয়। প্রায় এক ঘণ্টা পর গাড়ি এলে আমরা ফের রওনা দেই। নির্দিষ্ট স্থানে গাড়ি থেকে নামলাম। নেমে আবার চাঁদের গাড়িতে উঠলাম।
কিন্তু যাত্রা পথে শুরু হয় অবিরাম বৃষ্টি। বন্ধ হয়ে যায় গাড়ির চাকা। বৃষ্টিতে কাঁচা সড়কের পাশের একটি ঘরে অবস্থান নিই। প্রকৃতি মনে হয় আমাদের বিপক্ষে!
ওইদিন অঝোর ধারায় কেঁদেছে আকাশ। আমরাও প্রকৃতির এ নয়নাভিরাম কান্নাকে উপভোগ করছি। শেষ পর্যন্ত প্রায় ৩০ মিনিট অপেক্ষার পর আকাশের অঝোর ধারা থামলো। আমরা উঠলাম ফের সেই চাঁদের গাড়িতে।
পড়ন্ত বিকেলে গিয়ে পৌঁছালুম রুমা বাজারে। কিন্তু খবর নিয়ে জানা গেল এখন বগালেকের দিকে রওনা দিলে যথা সময়ে পৌঁছা যাবে না। সুতারাং রাতটা থাকতেই হচ্ছে এখানে।
তবে মন্দ যায়নি। হোটেলে উঠে সবাই গা ছেড়ে দিল নিজ নিজ কক্ষের বিছানায়। সন্ধ্যায় হালকা নাস্তা করে সবাই যে যার মত করে বের হয়ে গেল। আমরা চারজন- মোরশেদ, মামুন, শৈবাল ও আমি গেলাম বাজারের পাশে থাকা সাঙ্গু নদীর ঘাটে। কী চমৎকার জলমলে চাঁদের আলো।
চারজনই খোশ মেজাজে গল্প শুরু করেছি। পরে আমি আর মামুন একটি নৌকায় গিয়ে উঠলাম। দু’জনে কিছুক্ষণ নৌকাও চালালাম। কিন্তু নদীতে বড় একটি সাপ বীর দর্পে পানির বুক চিড়ে যেতে দেখে আমরা দু’জনই আতকে উঠি। কিছুটা ভয়ে ভয়ে নৌকা ছাড়লাম। ঘাটে এসে আবার গল্প।
স্থানীয় পঞ্চাশোর্ধ একজন এসে জানালেন, বাজারে কাহিনী। ২৪ বছর ধরে যিনি এ বাজারে ব্যবসা করে আসছেন। কিন্তু দিনের সব ক্লান্তি ছাপিয়ে সবাইকে উজ্জ্বীবিত করেছে হোটেলে রাতের আড্ডা।
মোস্তফা ইউসুফের রস ভরা নানা কাহিনী জমিয়ে দিলেন আড্ডা। সোহেল মারমার (দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশের স্টাফ রিপোর্টার) অন্যরকম উদ্যমতার হাসি সবাইকে আন্দোলিত করেছে। আনন্দ দিয়েছেন আরেক সঙ্গী মোরশেদ আলম।
পরদিন সকালেই ফের চাঁদের গাড়িতে রওনা দিলাম কাঙ্ক্ষিত বগালেকের উদ্দেশে। উঁচু-নিচু ও আঁকা-বাঁকা সড়কের সবাই খুবই সতর্ক। মনে হচ্ছে এখনই গাড়ি থেকে পড়ে যাচ্ছি।
এখনই বুঝি গাড়ি উল্টে ঢালু পাহাড়ের গভীর নিচে পড়ে যাবো। কিন্তু সতর্ক ও অভিজ্ঞ চালক সামনের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছেন।
গিয়ে পৌঁছলাম ১১ মাইল নামক স্থানে। সেখান থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার উচুঁ নিচু সড়কে হাঁটতে হবে। আমরা এই পথটুকু হাঁটতেই হাপিয়ে উঠেছি। কিন্তু এর পরের অংশ-কমলা বাজার থেকে বগালেকই যে আমাদের কষ্টের মূল পথ। তা আমি অনেকেই বুঝতে পারিনি। কমলা বাজার গিয়ে সবাই লেবুর শরবত খেয়ে বিশ্রাম নিলাম। আবার শুরু করলাম পাহাড়ি পথ চলা।
এতো বেশি উচু নিচু যে উঠার সময় নিচের দিকে থাকাতেই বুকটা কেঁপে উঠে! এক কদম সামনে দিলে দ্বিতীয় কদম দেওয়ার শক্তি হারিয়ে ফেলেছি তখন। কিন্তু যেতে তো হবেই। কোনো উপায় নেই। অনেকটা হামাগুড়ি দেওয়ার মতই আস্তে আস্তে পা সামনের দিকে বাড়িয়ে দিই। একটু গিয়েই আবার বিশ্রাম। অতঃপর বিশ্রাম।
এভাবে যেতে যেতে বগালেকের আগে সেনা ক্যাম্পের কাছে গেলাম। তখন হাফ ছেড়ে বাচার মতো অবস্থা। সবুজ ঘাসের ওপর শুয়ে গেলাম আমি, মোরশেদ ও শৈবাল।
কিন্তু ততক্ষণে মামুন আমাদের অনেক পেছনে। সঙ্গে থাকা মোবাইলও তখন বন্ধ। তাই সে কোথায় আছে সে খবরও নিতে পারছি না। অগত্যা গন্তব্যহীন হয়ে অপেক্ষা করছি তার জন্য। অবশেষে এলেন মামুন। ফের সবাই মিলে বিশ্রাম।
বিশ্রাম শেষে গিয়ে উঠলাম লেকের পাড়ের কটেজে। কটেজে বেঁড়ার ওপরই শুয়ে পড়লাম আমরা। পরে লেকের পানিতে গোসল। দেড় ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে ছিলাম পানিতে। মনে হচ্ছি স্বর্গের পানিতে নেমেছি! অনেক ভালো লাগছিল। শেষমেষ দুপুরের খাবার খেলাম-আলু ভর্তা, মুরগির মাংস ও ডাল দিয়ে। বগালেকের রাতের পর্বটা ছিল অনেক উপভোগ্য।
পাহাড়ে ঘেরা প্রাকৃতিক কিছু কটেজে রাত যাপনের মজাটাই আলাদা। হাতছানি দেয় চাঁদের আলো। আবচা আলো-আঁধারি খেলায় বারবিকিউ তৈরির কথাও কী ভুলা যায়? আবার কটেজে এক সঙ্গে ১৫ জন থাকার আমেজটাও অন্যরকম। সেই সব স্মৃতি আমাকে, আমাদেরকে কেবলই সেদিনের দিকে নিয়ে যায়।
সেখানে অবস্থানের পর পরদিন ভোরেই আমরা রওনা দিলাম রুমার উদ্দেশে। কিন্তু যাওয়ার সময়ের সেই ক্লান্তি মোটেও অনুভূত হল না। গাড়িতে করে কমলা বাজারের একটু সামনে থেকে সরাসরি রুমা বাজার।
অবিশ্বাস্য রকম সত্য! অদ্ভূদ সুন্দর। পাহাড়ের টিক ২৮শ’ ফুট উপরে। প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট। আয়তন ১৫ একর। গভীরতা ১৫১ ফুট। পানি দেখতে অনেকটাই নীল। সম্পূর্ণ আবদ্ধ। আশেপাশে পানির কোনো উৎসও নেই।
পার্বত্য জেলা বান্দারবানের রুমা উপজেলার একটি পাহাড়ি অঞ্চল। জেলা শহর থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে। এ অঞ্চলে বাস করে পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র উপজাতি বম ও খুমী সম্প্রদায়।
বগালেক:
ফানেল বা চোঙা আকৃতির ছোট পাহাড়ের চূড়ায় এ লেক অবস্থিত। অদ্ভূত গঠনাকৃতির লেকটি অনেকটা আগ্নেয়াগিরির জ্বালা মুখের মতো। যে লেকের পানি প্রতি বছর এপ্রিল-মে মাসে এমনিতেই ঘোলাটে হয়ে যায়।
সমুদ্র সমতল থেকে প্রায় ১৫০০ ফুট উচুতে পাহাড়ে ১৫ একর জায়গা নিয়ে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট বগা লেক। যার পানির স্তর শীত-বর্ষায় কখনোই পরিবর্তন হয় না। এটি নিয়ে অনেক কল্পকাহিনী প্রচলিত রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন এখানে ড্রাগনের মুর্তি রয়েছে।
প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য ভর করেছে এর ওপর। দৃষ্টি জুড়ে যায় প্রকৃতির অপ্সরিতে। পৃথিবীর সব প্রাকৃতিক নৈসর্গ যেন এই লেকেই বাসা বেঁধেছে!
সরু ও আঁকা-বাঁকা পাহাড়ি মেঠো পথ। দেখলে মনে হবে যেন এখনই হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছে। বগালেকে যাওয়ার দুঃসহ স্মৃতি যারপরনাই মুখিয়ে তুলবে। কিন্তু লেক দর্শনে নিমিষেই বাতাসে মিলে যায় সব গ্লানি, বেদনা আর কষ্ট।
খানিক্ষণ পর যখন লেকের মধুর পানিতে ডুব দেবে তখন মনে হবে পৃথিবীর সব শান্তি যেন প্রকৃতির এই আঙিনায়। পানির ওপর থেকে যখন নিচে পা সুস্পষ্টভাবে দেখা যায় তখন উপভোগ্য হবে আয়নায় মুখ দেখার অনুভূতি।
পড়ন্ত বিকেলে দৃষ্টি জুড়ে পাহাড় ঘেরা সবুজ অরণ্য রাঙিয়ে তুলবে যে কাউকে। রাজ্যের তাবৎ বিষণœ ভর করা মনকেও জাগরূক করবে এই সুন্দর বিকাল। রাতে চাঁদের আলো-আধারি খেলা বিদঘুটে অন্ধকার মনকেও জাগিয়ে তুলবে মুহূর্তে।
যেভাবে যাবেন:
বগালেকে শীত মৌসুমে যাওয়াই ভালো। বান্দরবান সদর থেকে বাস বা জীপ (স্থানীয় নাম চান্দের গাড়ি) যোগে রুমা উপজেলায়। সেখান থেকে ফের জীপ করে বগালেক। তবে এসব গাড়ি সরাসরি বগা লেকে যায় না।
রুমা থেকে প্রায় ১১ কিলোমিটার পর্যন্ত জীপে যাওয়া যায়। এরপর কমলা বাজার থেকে আকা বাঁকা পাহাড়ে আরো প্রায় তিন কিলোমিটার হাঁটতে হয়। এই অংশই কষ্ট ও পরিশ্রমের। তবে উপভোগ্যও বটে।
আকা-বাঁকা পথ
রুমা থেকে বগালেক যাওয়ার সময় পড়বে অনেক আঁকা-বাঁকা পাহাড়ি পথ। হেঁটে গেলে সময় লাগতে পারে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা। চান্দের গাড়িতে গেলে লাগবে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা। মাঝে মাঝে চাঁন্দের গাড়ির ঝাঁকুনির ভয়ে অনেকের চোখ চানাবড়া হয়ে যায়!
গাড়ি এত বাঁকা হয়ে উপরে উঠতে হয়, তখন সামনে আকাশ ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। অনেক সাহসী মানুষও একটু হলেও ভয় পান! তবে এটি অত্যন্ত স্বাভাবিক!
যা উপভোগ্য:
বগালেকের অন্যতম উপভোগ্য রাতের বারবিকিউ। খোলা স্থানে চুলা তৈরি করে লাখড়ির আগুন দিয়ে তা তৈরি করার মজাই আলাদা। মনে হবে যেন, খোলা বিলের মধ্যে শীত মৌসুমের বনভোজন।
যা সবাইকে অন্যরকম আনন্দ দেবে। আর স্থানীয়ভাবে বাঁশের বেঁড়া দিয়ে তৈরি তৈরি কটেজগুলোতে রাতযাপনও উপভোগ্য।
প্রিয় পাঠক, ভ্রমণ যাদের নেশা, বেড়ানোর সুযোগ এলে যারা উড়িয়ে দেন সব বাধা, কাজের অংশ হিসেবে যারা ভ্রমণ করেন কিংবা যাদের কালেভদ্রে সুযোগ হয় ভ্রমণের তারা সবাই হতে পারেন ট্রাভেলার্স নোটবুক’র লেখক। আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন বাংলানিউজের পাঠকদের সঙ্গে।
আর একটা কথা লেখার সঙ্গে ছবি পাঠাতে ভুলবেনই না, সেই সঙ্গে বাতলে দিন সেখানে যাওয়ার পথঘাটের বিবরণও।
প্রিয় পাঠক, আপনার ভ্রমণ আনন্দ বিশ্বজুড়ে বাঙালির কাছে ছড়িয়ে দিতে আমাদের ই-মেইল করুন-
বাংলাদেশ সময়: ০০৪৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ২২, ২০১৪