...পরদিন চিতাওয়ানের সকালে বেশ ঠাণ্ডা অনুভব করলাম, ঘুম থেকে উঠে আমরা তৈরি হয়ে রেস্টুরেন্টে সকালের ব্রেকফাস্ট সেরে নিলাম দুধ এবং সিরিয়াল, ডিম এবং পাউরুটি দিয়ে। আমার বোনের চা এর অভ্যাস নাই কিন্তু আমার অবশ্যই চাই ব্ল্যাক টি।
চাঙ্গা হয়ে রিসোর্টের গাড়ি দিয়ে চলে আসলাম বুড়ো রাপ্তি নদীর ধারে, দেখলাম কয়েকটি ক্যানু তীড়ে বাঁধা। ক্যানু হলো হালকা ওজনের সরু নৌকা বিশেষ, যার মাঝখান চওড়া, সেখানে পিড়ির মতো আসনে হাঁটু গেড়ে বসতে হয়। চিতাওয়ানে যে ক্যানুগুলো দেখলাম সেগুলোকে ‘ডুগআউট ক্যানু’ বলা হয়। সর্বপ্রথম ক্যানুর প্রচলন হয় ৮২০০ থেকে ৭৬০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে নেদারল্যান্ডস এ।
ক্যানু দেখে খানিকা শঙ্কিত হলাম। একো সরু আর পাতলা নৌকা ৭-৮ জনের ভার বইতে পারবে? চাইনিজ় ও নেপালিসহ আমরা প্রায় ৭ জন উঠে বসলাম ‘ডুগআউটে’ এ। আমাদের সাথে ব্রাহ্ম দাদাও রওনা হলেন। গতকাল পাখি দেখলাম যেই রাপ্তি নদীর ধারে আর এই রাপ্তি নদী এক নয়, এটার নাম বুড়ি রাপ্তি নদী। ক্যানুর মাঝি ধীরে ধীরে বৈঠা বাইতে লাগলো আর ক্যানু ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগোতে লাগলো।
কুয়াশাচ্ছন্ন সকালের সূর্য তখনো পুরোপুরি কুয়াশার চাদর ভেদ করতে পারেনি, মৃদু নরম আলো আর দুই পাশের বন-বনানী এক রোমাঞ্চকর অনুভূতির জন্ম দিলো মনে। আমরা খুব দ্রুতই ক্যানুর পাশ দিয়ে একটা মাঝারি আকৃতির ঘড়িয়াল দেখলাম সাঁতড়ে যাচ্ছে। ঘড়িয়াল প্রায় বিলুপ্ত প্রজাতির চিতাওয়ানে। মিঠা পানির এই লম্বা চঞ্ছুওয়ালা কুমিরের বংশ রক্ষার জন্য চিতাওয়ান সরকাল বিশেষ পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে।
আরো কিছু দূর যেতেই দেখতে পেলাম সারিবদ্ধ ভাবে হাতির দল পিঠে ট্যুরিস্ট নিয়ে নদী পাড় হচ্ছে, এর নাম এলিফেন্ট ব্যাক সাফারি। ইন্টারনেটে ছবি দেখেছি এতদিন আজ সামনা সামনি দেখে অভিভূত হলাম। কি সুশৃঙ্খল ভাবে হাতিগুলা নদী পাড় হচ্ছে, খানিকটা বসে তারপর আবার উঠে তারা পাড়ে যাচ্ছে, কোথাও কোনো তাড়া নেই। আমি ভয় পেয়ে আমার ভ্রমণ তালিকায় এই অংশটা বাদ দেই।
নদীর যে পাশে একটু গাছপালা কম, সেখান বানর, নিচু গাছের ডালে মাছরাঙ্গা দেখতে পেলাম। সেই নঙ্গে গ্রিন হেরন, আরো নাম না জানা বিভিন্ন প্রজাতির পাখি দেখতে দেখতে চোখে পড়ল কুমিরের গুহা যেখানে কুমির চোখ বন্ধ করে মাথা বের করে আছে। ফেব্রুয়ারির এ সময়ে মাগার মার্শ, যেগুলা খুবই হিংস্র প্রকৃতির তা ঘুমন্ত অবস্থায় থাকে, শীতের দিনে তারা রোদ পোহানোর জন্য প্রায় নির্জীবের মত শুয়ে বা ভেসে থাকে।
ক্যানু যাত্রা একমুখী, কারণ আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ছিল এলিফ্যান্ট ব্রিডিং সেন্টার যেখানে রাম-লক্ষণ নামে দুই যমজ হাতি ভাই আছে, যারা এই সেন্টারে জন্ম গ্রহণ করেছে। এলিফ্যান্ট ব্রিডিং সেন্টারে গিয়ে দেখলাম একটা পোস্টার টানানো যে, ‘ ফাস্ট হ্যাপি বার্থডে অব রাম লক্ষণ’।
২০০৮ সালের ৮ নভেম্বর, সাওরাহা এলিফ্যান্ট ব্রিডিং সেন্টারে ৪০ বছর বয়সী মা হাতি দেবী কালি এবং ৪৫ বছর বয়সী বাবা হাতী রোমিও এর ঘরে জন্ম নেয় দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম যমজ বাচ্চা হাতি, যাদের নাম রাখা হয় রাম ও লক্ষণ। তার এক বছর পরে এখানে জাকঁজমক করেই জন্মদিন পালন করা হয়।
ব্রিডিং সেন্টারের হাতিদের লালন পালনে আরো যত্নশীল হওয়ার লক্ষ্যে এই প্রয়াস ছিল।
১৯৮৬ সালে নেপাল সরকার ভারত থেকে ১৬টি হাতি নিয়ে আসে আর বিনিময়ে ভারতকে দেওয়া হয় চিতাওয়ানের ৪টি এক শিং অলা গণ্ডার।
এখানে বড় বড় হাতিগুলোকে দেখে মায়া হল আমার, পা বেঁধে রাখা হয়েছে ভারী শিকল দিয়ে। আর বাচ্চা হাতিগুলো ছাড়া অবস্থা ঘুড়ে বেড়াচ্ছে ট্যুরিস্ট দের খেলা দেখাচ্ছে, দুস্টামি করছে, ট্যুরিস্টরাও আদর করে গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
রাম-লক্ষণের বয়স এখন ৬ বছর, দু’জনকে এক সাথেই দেখলাম। রাম-লক্ষণের সাথে ফটোসেশন হয়ে গেল। এলিফ্যান্ট ব্রিডিং সেন্টার থেকে বাঁশের একটা সাঁকো পাড় হয়ে আমাদের গাড়ির কাছে পৌঁছাতে হবে, তো ফটোসেশন চলছেই, বাঁশের সাঁকোর উপরে দাঁড়িয়ে দুই বোন ফটোসেশন করলাম। গাড়ি আসতে আসতে আমি সাঁকোর পাশে ফেরি করছে এরকম একজনের কাছ থেকে কিছু সুভ্যনির কিনলাম।
রিসোর্টে নেমে আমাদের গাইড আমাদের দিক নির্দেশনা দিলেন যে ১টার দিকে আমরা আবার রাপ্তি নদীর পাড়ে যাব, জঙ্গল সাফারির উদ্দেশে। প্রায় ৪ ঘন্টার জার্নি, সাথে গরম কাপড় ও পানি নিয়ে যেতে বললেন। সাড়ে ১২টার ভিতর দুপুরের খাবার সেরে ফেললাম আমরা। আমাদের দু বোনেরই সময়জ্ঞান খুবই ভালো, মানে পাংচুয়াল যাকে বলে আর কি। চিতাওয়ানের খাবার খেয়ে বেশ শান্তি পেয়েছি। চিতাওয়ান অ্যাডভেঞ্চার রিসোর্টের স্টাফরাও খুবই আন্তরিক, ওদের ম্যানেজার আশিষ দা এর মতোই।
জিপ সাফারি একটু ব্যয়বহুল, আবার যারা একটু নিরাপদে জঙ্গল সাফারি করতে চান, তারা জিপ সাফারি করেন। জিপের কাছাকাছি যাওয়ার জন্য আগে ক্যানুতে চড়ে রাপ্তি নদীর ওই পাড়ে গেলাম, ভালো লাগলো যে সকালে দেখা হওয়া চাইনিজ কাপলকে এখানেও সফরসঙ্গী হিসেবে পেলাম।
খানিকটা হেঁটে গিয়ে দেখলাম যে অনেকগুলো জলপাই রঙের খোলা জিপ। জিপে একজন গাইড থাকে, আরেকজন ড্রাইভার। ৮ জন যাত্রী পেছনে বসতে পারে। চিতাওয়ান ন্যাশনাল পার্কে যে কোনো প্রকার অস্ত্র নিয়ে ঢোকা নিষেধ।
সার্কভুক্ত দেশের জন্য প্রবেশ ফি ৭০০ নেপালি রুপি। অচেনা জায়গায় ভিন দেশে দুইবোন জঙ্গলে ঘুরতে এসে এক ফোঁটাও ভয় পাচ্ছিলাম না, সবাই কে বড্ড কাছের মনে হচ্ছিলো।
গণ্ডার দেখার উত্তেজনা নিয়ে সবাই যাত্রা শুরু করলাম, শুধু আমার বোন মনে প্রাণে চাইছিল যেন কোনো ভাবেই গণ্ডার দর্শন সফল না হয়। অসাধারণ রোমাঞ্চকর অনুভূতি ফিরে ফিরে আসছিল যখন বনের ভিতর প্রবেশ করছিলাম। দুপাশে এলিফ্যান্ট গ্রাস আর গাছপালা, আরো দূরে গভীর বন, ইটের রাস্তা মাঝে। আমারের চোখে বন্যপ্রাণীদের মাঝে প্রথমেই ধরা পড়ল খুবই সুন্দর নীলাভ সবুজ় পেখমসহ ময়ূর, বুঝলাম ওটা পুরুষ ময়ূর, দুঃখজনক হলেও সত্যি যে পুরুষ ময়ূর দেখেই মুগ্ধ হই আমরা।
জিপের শব্দ শুনে আর ময়ূরকে দেখে যেভাবে সবার ক্যামেরা ঘুরে গেল ক্লিক ক্লিক, তাতে ময়ূর ভয় পেয়ে ঘন ঝোপের ভিতর ঢুকে গেল।
আমাদের গাইড এবং জিপের ড্রাইভারের চোখ জোড়া খুব তীক্ষ্ণ...। ড্রাইভার হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে বলতে লাগলো পাইথন! পাইথন !!...আমরা তখনো দেখতে পাইনি...সবার সাথে গাড়ি থেকে নেমে গেলাম...। খুব সুন্দর এক হ্রদের সামনে আবছাভাবে দেখতে পেলাম মোটাসোটা এক পাইথনের হলুদ দেহ। একটু ভয় পাচ্ছিলাম, আমাদের ড্রাইভার আমার হাত থেকে ক্যামেরা নিয়ে পাইথনের ছবি তুলে দিল। উত্তেজনার রেশ থাকতে থাকতেই জিপে ফিরে গেলাম, আবার যাত্রা শুরু হল।
আবহাওয়াটা ছিল চমৎকার, ফেব্রুয়ারির বিকেলের মিষ্টি রোদে জিপ সফর আমরা দু’বোনই দারুন উপভোগ করছিলাম...শীতকালে বন খানিকটা রুক্ষ, হলদেটে...এলিফ্যান্ট গ্রাসগুলো শুকনো খটখটে হয়ে আপনা আপনিই ঝলসে গিয়েছে এবং স্থানে স্থানে সেই ঝলসানো পোড়া দাগ...বানর দেখলাম...রাস্তার দুপাশে যে এলিফ্যান্ট গ্রাস, সেটা ছাড়িয়ে খানিকটা দূরের বনে অনেকগুলো চিত্রা হরিণ দেখতে পেলাম, ঘাস খাচ্ছে...সবার ক্যামেরা থেকেই ক্লিক শব্দ বের হলো।
আমরা উঁচু গাছের মাথায় দেখলাম ঈগল আর লম্বা ঘাড়ওয়ালা সরু সূচালো ঠোঁটের পাখি। একটু এগোতেই বনের ধারে লেকের পাশে সারি সারি কুমির শীত নিদ্রায় ব্যস্ত, সবগুলোই মাগার মার্শ, এদের যতই শান্ত দেখা যাক না কেন, বর্ষাকালে দারুণ হিংস্র। জঙ্গল সাফারির অংশ হিসেবে বনের মাঝে ‘কুমিরের খামার’ দর্শন ছিল। টিকেট জনপ্রতি ২০০ নেপালি রুপি। মিঠা পানির বিলুপ্তপ্রায় ঘড়িয়াল জাতীয় কুমিরের বংশ বাঁচাতে নেপাল সরকারের বিশেষ প্রচেষ্টা।
জঙ্গল সফরের প্রায় আরো ২ ঘণ্টা বাকি, আমরা নেমেই ফ্রেশ হলাম, প্রাকৃতিক কাজ শেষে খামার ঘুরে বেড়ালাম। বিভিন্ন বয়সী ঘড়িয়াল আছে এখানে, প্রত্যেকেই স্থির হয়ে শীত নিদ্রায় ব্যস্ত। হঠাৎ দেখে মনে হয়, কেউ যাদুমন্ত্র করে সজীব প্রাণ স্থির করে দিয়েছে আর জাদু উঠিয়ে দিলেই আবার সচল হবে।
প্রাগৈতিহাসিক যুগের ডাইনোসরের কথা তো আমরা সবাই জানি, ধারণা করা হয় কোটি কোটি বছর আগে এক উল্কা পিণ্ড পৃথিবী ফুঁড়ে বের হয়ে আসে এবং প্রাগৈতহাসিক যুগের অবসান ঘটায়। কিন্তু টিকে থাকলো কুমির এবং সেই কুমির টিকে আছে।
নেপালে দুই ধরনের কুমিরের বসবাস। এক প্রজাতি হলো মাগার মার্শ এদের বলা হয় ‘ক্রোকোডাইল অব দ্য মার্শ’। ভারতীয় উপমহাদেশে এদের বিচরণ সর্বাধিক। এরা খুবই হিংস্র প্রজাতির শিকারী কুমির।
আরেক প্রজাতি হচ্ছে মিঠা পানির ঘড়িয়াল। এ ঘড়িয়াল ফিশ ইটিং ক্রোকোডাইল হিসেবে পরিচিত। নদীর সংকোচন, মাছ ধরার জালে আটকা পড়ে, আজ ঘড়িয়াল আশঙ্কাজনক হারে কমে গিয়েছে। ১৯৮১ সালে নেপালে ‘ ঘরিয়াল কনজারভেশন প্রোজেক্ট’ হাতে নেওয়া হয়, এ প্রজেক্ট দু’টো আন্তর্জাতিক সংস্থার সমন্বয়ে কাজ করে যাচ্ছে।
সবকিছু দেখলে মনটা বিষন্ন হয়ে যায়। বাংলাদেশের পদ্মা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র নদী ও এর শাখা নদীগুলোতে ঘড়িয়াল দেখা যেতো, আশি সালের মাঝামাঝি বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের ঘড়িয়ালের সংখ্যা হ্রাস পেতে থাকে। জুরাসিক যুগ থেকে এদের কাঠামোতন্ত্র একই রকম রয়ে গিয়েছে। এ রকম অনন্য বৈশিষ্ট্যের কুমির প্রজাতির বংশ সংরক্ষণে বাংলাদেশে সরকারি কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি আমার এখনো।
কুমিরের খামার থেকে বের হয়ে সবাই একটু পানি, কোল্ড ড্রিংকস খেল, সাথে কেউ নিল বিস্কুট ও চকোলেট। আমিও পানি ও আর একটা চকোলেট নিলাম। খোলা জিপ আবার চলতে শুরু করল। এদিকে সূর্যের তেজ় কমে গিয়ে এক রহস্যময় পরিবেশ যেন জিম করবেটের বইয়ের ভিতর থেকে সৃষ্টি হয়েছে।
পর্যটকদের মনে (আমার বোন ছাড়া) একটাই আফসোস, এখন পর্যন্ত চিতাওয়ানের আইকনিক এক শিং ওয়ালা একটা গণ্ডার চোখে পড়ল না!
আমাদের সারির সামনের ভারতীয় দম্পতি ততক্ষণে বুঝে গিয়েছে, আমার বোন যে ভয় পাচ্ছে। এই গা কেমন করা পরিবেশে জিপ গাড়ি মূল রাস্তা দিয়ে না বের হয়ে আবার কোন সরু পথে ঢুকলো, আমি খুব ভালোভাবে বুঝতে পারলাম যে ড্রাইভার কিছুটা মরিয়া গণ্ডারের সন্ধানে।
আমার কেমন জানি শীত শীত লাগছে। না আবহাওয়াজনিত ঠাণ্ডা না, কেমন জানি হিমশীতল পরিবেশ, শুকনো পাতার মড়মড় শব্দ প্রায় কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছিল, কিন্তু কোনোভাবেই বোনকে বুঝতে দিচ্ছিলাম না নিজের দুর্বলতার কথা ।
আমাদের জিপ সাফারির বরাদ্দকৃত ৪ ঘণ্টা হয়ে গেল কিন্তু গাড়িটা বেশ ঘুরছে মনে হলো। সন্ধ্যার অন্ধকার নামার আগে যেন বন পেরুতে পারি সেই প্রার্থনা করছি। রাইনো দেখার আশা যখন ছেড়েই দিলাম, তখন আমাদের দক্ষ ড্রাইভার আচমকা ব্রেক চাপলো। সবার মুখে ফিসফিসানি, ভয় আর বিস্ময়ের এক চাপা শব্দ, রেইনো! রেইনো! (গণ্ডার! গণ্ডার!)। ইয়েস, আমরা রাস্তার মাঝখানে আর আমাদের থেকে কয়েক হাত দূরে, এক শিং ওয়ালা গণ্ডার গাছের আড়ালে, আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছে স্থির দৃষ্টিতে। আমার বোন ভয় পেয়ে আর্তচিৎকার দিল, যেন গাড়ি ছেড়ে দেয়, কিন্তু কিসের কি? ড্রাইভার বরং গাড়ি ঘুরিয়ে ওটার কাছাকাছি চলে এলো প্রায়। গাইড লাঠি হাতে গাড়ি থেকে নামলো, পিছু পিছু সবাই নামলাম আমরা। আমার মাথায় একই সাথে আনন্দ, উত্তেজনা ও ভয়, যদি তেড়ে আসে? যদি গুঁতো দেয়?
ক্যামেরায় কোনোমতে ছবি তুললাম, গণ্ডার দর্শন শেষে গাড়িতে উঠলাম, আবার বোনকে দেখলাম বেশ শান্ত ও পরিতৃপ্ত। চিতাওয়ান বনের বিখ্যাত এক শিং ওয়ালা গণ্ডার দেখলাম, বাংলাদেশ থেকে দুইবোন নেপালে এসে যেন নেপাল জয় করলাম। সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানালাম মনে মনে। জিপ সামনে এগুতেই আমি পিছন ফিরে দেখলাম গণ্ডারটি ধীরে ধীরে রাস্তা পার হয়ে ওই পাশের জঙ্গলে মিলিয়ে গেল।
এইবার বন থেকে বেরুবার প্রস্তুতি, অন্য একটা জিপ আমাদের অতিক্রম করে গেল, আমরা হৈ হৈ করে জানালাম আমাদের বিজয়ের কথা…
পথটা চেনা চেনা লাগছে, যেই পথ দিয়ে ঢুকেছিলাম, সেই পথ দিয়েই বের হচ্ছি, সূর্যটা আস্তে আস্তে নরম হয়ে হেলে পড়েছে। ম্রিয়ময়াণ কমলা আলোয় এলিফ্যান্ট গ্রাসগুলোকে মোহনীয় দেখাচ্ছে। অদ্ভূত মায়াবী পরিবেশ আচ্ছন্ন করে রাখলো আমায়, চিতাওয়ান মনে স্থায়ী আসন গেড়ে নিল।
বনের ভিতর চারপাশে দেখে রোবার্ট ফরেস্টের কথা মনে হল – ‘Woods are lovely dark & deep...miles to go before I sleep...’
পেছনে পড়ে রইল চিতাওয়ান-আর আমার মনে পড়ে গেল কয়েক জোড়া লাইন, যেন শীতের বিষন্ন বাতাসের হাহাকারের হুহু ধ্বনি বুকের ভিতর।
বিদ্র: যে চিতাওয়ান এর একটা জায়গাতেও যাবে না বলে আমার বোন পণ করেছিল, সেই বোন রিসোর্টে ফিরে বলল, নাগরকোট , ভক্তপুর দরবার স্কয়ার আর চিতাওয়ান তার স্মৃতিতে চির অম্লান হয়ে থাকবে।
পরদিন সকালে বিদায় পর্ব। রেস্টুরেন্টে গেলাম শেষবারের মতো ব্রেকফাস্ট করতে, আমাদের বিদায় জানাতে গাইড ব্রাহ্ম দা, ম্যানেজার আশিষ দা সকাল সকাল রিসোর্টে উপস্থিত। কি আশ্চর্য! রেস্টুরেন্টের ভিতর গান বাজছে ‘লম্বি জুদাই...’ ( মানে দীর্ঘ বিচ্ছেদ)
চোখ দিয়ে পানি চলে আসছে ততঃক্ষণে। তাড়াতাড়ি আবেগ সংবরণ করলাম। কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে চিতাওয়ানকে বিদায় জানিয়ে গাড়িতে উঠলাম কাঠমান্ডুর উদ্দেশে।
প্রিয় পাঠক, ভ্রমণ যাদের নেশা, বেড়ানোর সুযোগ এলে যারা উড়িয়ে দেন সব বাধা, কাজের অংশ হিসেবে যারা ভ্রমণ করেন কিংবা যাদের কালেভদ্রে সুযোগ হয় ভ্রমণের তারা সবাই হতে পারেন ট্রাভেলার্স নোটবুক’র লেখক। আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন বাংলানিউজের পাঠকদের সঙ্গে।
আর একটা কথা লেখার সঙ্গে ছবি পাঠাতে ভুলবেনই না, সেই সঙ্গে বাতলে দিন সেখানে যাওয়ার পথঘাটের বিবরণও।
প্রিয় পাঠক, আপনার ভ্রমণ আনন্দ বিশ্বজুড়ে বাঙালির কাছে ছড়িয়ে দিতে আমাদের ই-মেইল করুন-
বাংলাদেশ সময়: ১২৫৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৯, ২০১৪
** রোমাঞ্চকর চিতাওয়ান বন- পর্ব এক