প্যারিস, ফ্রান্স থেকে: ভোজন রসিকদের কাছে খুবই মজার ও আকর্ষণীয় এক খাবার শুটকি। দেশের গণ্ডী পেরিয়ে বিদেশেও বিপুলসংখ্যক মানুষের কাছে জনপ্রিয় খাবার শুটকি।
আগে দামে সস্তা থাকায় শুটকিকে গরীবের খাবার হিসেবে তাচ্ছিল্য করা হতো। কিন্তু এখন শুটকির দামের বৃদ্ধির পাশাপাশি বদলেছে অবস্থানও। এখন শুটকি দেশের ধনীদের অন্যতম নিয়মিত একটি খাবার মেন্যু। এমনকি দেশের বিভিন্ন নামী-দামি রেস্টুরেন্ট সহ বিলাসবহুল হোটেলেও শুটকির উপস্থিতি দেখা যায়।
ফলে এক সময়ের গরীরের শুটকি এখন চড়া দামের কারণে মধ্যবিত্ত ও গরীবের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে।
বাংলাদেশে উৎপাদিত শুটকির একটি বড় অংশ উৎপাদন হয় কক্সবাজারে। আগে কক্সবাজারে বেশ কয়েকটি শুটকির গ্রাম ছিল। কিছু দরিদ্র মানুষ শুটকি তৈরি ও বিপণনের সঙ্গে জড়িত ছিল। এখন শুটকি উৎপাদন হয় বাণিজ্যিকভাবে, বিশাল কলেবরে।
শুটকি বিক্রির জন্য একসময় কক্সবাজারের টেকপাড়া, রুমালিরছড়া, কানাইয়ার বাজার ও বিমানবন্দর সড়কের মুখে ফুটপাতে বেশকিছু দোকান ছিল। এখন এর পাশাপাশি বিক্রিতে এসেছে আভিজাত্য। পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ বার্মিজ মার্কেটের অভিজাত দোকান, হোটেল-মোটেল জোন, লাবণী বিচ মার্কেট, কলাতলীসহ বিভিন্ন পয়েন্টে দেখা যায় সুদৃশ্য শুটকির দোকান। দেশি-বিদেশি পর্যটকরা এসব দোকান থেকে শুটকি সংগ্রহ করেন।
২০১০ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বন্ধু টিপুকে নিয়ে গিয়েছিলাম টেকনাফে। উদ্দেশ্য টেকনাফ পৌরশহরের কুড়ালপাড়ার বন্ধু আমান উল্লাহর বিয়েতে আতিথ্যি গ্রহণ করা। গায়ে হলুদ, বিয়ে, বৌভাত সহ সব আয়োজন শেষে ফিরে আসার সময় ভাবলাম একটি দিন কক্সবাজারে ঢু মেরে যাই।
কক্সবাজারের বাসিন্দা বন্ধু আমজাদকে জানালাম আমরা আসছি। ও আমাদের সবকিছু বুকিং করে রাখলো। কক্সবাজারের ঐতিহ্য বাংলাদেশের বৃহৎ শুটকির আড়ৎ দেখার ইচ্ছা অনেকদিনের।
ভাবলাম এবার তা দেখে আসা যাক। কক্সবাজার সদর উপজেলার ভেতরে একটু দূরে নাজিরারটেক। টিপুকে বলতেই যেতে রাজি হলো। ভাড়া রিকশায় করে সকাল ১০টায় রওয়ানা দিলাম। নাজিরার টেকে পৌঁছাতে বেলা ১১টা।
এরপর বিশাল সমুদ্র উপকূলে যে কয়েকশত একর জায়গা নিয়ে অবস্থিত এ রকম একটা শুটকিপল্লী হতে পারে, তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। সেখানে আমরা পাক্কা ৩ ঘণ্টা কাটিয়ে দেখলাম শুটকির আদি-অন্তের সব রহস্য।
দেখলাম নারীরা কিভাবে একের পর এক শুটকি বেছে বেছে তা রোদে শুকানোর উপযোগী করছে। পুরো এলাকার বাতাসে শুটকির ঘ্রাণ। আমাদের সঙ্গে থাকা ক্যামেরা বার বার জ্বলে উঠছে কিছুক্ষণ পরপর।
কথা হলো ওই এলাকার কয়েকজন শুটকি ব্যবসায়ী ও স্থানীয় লোকের সঙ্গে। তারা জানালেন শুটকি সম্পর্কে অনেক তথ্য।
কক্সবাজার জেলার উপকূলীয় এলাকা মহেশখালীর সোনাদিয়া, গোরকঘাটা, তাজিয়াকাটা, কুতুবজোম, কুতুবদিয়া উপজেলার বড়ঘোপ, খুদিয়ারটেক, আলী আকবর ডেইল, অংজাখালী, পশ্চিম ধুরুং, টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, সেন্টমার্টিন, জালিয়াপাড়া, সদর উপজেলার নাজিবারটেক, খুরুশকুল, সমিতিপাড়া, চৌফলদণ্ডিসহ বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকায় বিপুল পরিমাণ শুটকি তৈরি হয়।
এসব শুটকির মধ্যে সামুদ্রিক রূপচাঁদা, ছুরি লাক্কা, কোরাল, সুরমা, লইট্যা, চিংড়ি এবং মিঠাপানির মাছের মধ্যে শোল, কাচকি, কুচো চিংড়ি, মলা, গইন্যা, বাইলা, ফাইস্যাসহ প্রায় ২০ প্রজাতির মাছের শুঁটকি হয়।
কক্সবাজারে শুটকি শুকানোর সবচেয়ে বড় মহাল কক্সবাজার শহর সংলগ্ন পশ্চিম সাগরের তীরে নাজিরারটেক। এটি নতুন চরএলাকা। বছরজুড়ে এখানে চলে শুটকি মাছের উৎপাদন। প্রায় শত একরের বিশাল এলাকাজুড়ে শত শত বাঁশের মাচায় নানা জাতের মাছ শুকানো হয়। কিন্তু এখানে শুটকি মাছ সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে নষ্ট হয় অনেক মাছ।
যদিও মাছি ও পোকামাকড় থেকে রক্ষা করার জন্য নানা শুটকিতে নানা ধরনের বিষাক্ত কীটনাশক, অতিরিক্ত লবণ ব্যবহার করা হয়। ফলে শুঁটকির গুণগত মান নষ্ট হয়।
উৎপাদনকারী ব্যবসায়ীরা জানান, আগে কীটনাশক ব্যবহার করা হলেও এখন তারা মাছ ভালোভাবে শুকিয়ে পলিথিনের প্যাকেটে সংরক্ষণ করেন। ফলে শুটকির মান ভালো থাকে এবং নষ্ট হয় না।
ঘুরে দেখা গেলো, শুটকি তৈরির শুকাতে দেওয়া মাছে মাছি ভন ভন করছে। মাছিগুলো এসব মাছে ডিম পাড়ছে। এসব ডিম থেকে বের হওয়া বাচ্চা শুটকি খেয়ে নষ্ট করে দেয়।
তবে শুকানোর সময় মাছি না বসার পদ্ধতি প্রয়োগ করা গেলে শুটকির মান অনেক উন্নত হবে বলে স্থানীয়রা জানান।
শুঁটকিতে বর্ষা মৌসুমে ব্যবহৃত কীটনাশকের মধ্যে রয়েছে নগস, মেলাথিয়ন, ডায়াজিনন, সুবিক্রন এবং পাউডার জাতীয় কীটনাশক ডেসিফ। এসব শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। শীত মৌসুমে বাতাস যখন উত্তর থেকে প্রবাহিত হয়, তখন মাছি বসলেও ডিম হয় না। এ সময় ব্যবসায়ীরাও কীটনাশক ব্যবহার করেন না।
নাজিরাটেক ঘুরে দেখা গেছে, কেজিপ্রতি লাক্ক্যা শুটকি বিক্রি হচ্ছে ১২শ টাকায়। এক একেকটি লাক্ক্যা শুটকির ওজন হয় ৫/৬ কেজি। এছাড়া রূপচাঁদা বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ১২৫০ টাকা, কালো চান্দা ৬০০ টাকা কেজি দরে।
লইট্যা শুটকি প্রতি কেজি ২৫০-৩০০, ছুরি মাছের শুটকি ৪০০ টাকা কেজি, কোরাল কেজিপ্রতি ৮০০ টাকা, পোয়া ২০০ টাকা কেজি, শোল ৭০০ টাকা কেজি, সুরমার কেজি ৪৫০ টাকা, গইন্যা শুটকি ৩০০ টাকা, ইলিশ শুটকি ৩০০, কামিলা ২৮০ টাকা, ইছা (চিংড়ি) ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা, ফাইস্যা শুটকি ১৫০, অলুয়া শুটকি ১২০ টাকা, মইল্যা শুটকি ১৪০ টাকা, কাঁচকি শুটকি ২২০-২৫০ টাকা ও পাঁচমিশালী ১০০-১৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপে জানা গেল, শুটকি রপ্তানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার পর ৭২-৭৩ সালে শুটকি রপ্তানি থেকে যেখানে সরকারের আয় হতো ১৭ হাজার ৯০০ টাকা, সেখানে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে শুটকি রপ্তানি করে আয় হয়েছে ৩০ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। তবে বর্তমানে এর পরিমাণ অর্ধশত কোটি টাকারও বেশি।
আমরা যারা ভ্রমণপিপাসু কক্সবাজারে যাই, একটু কষ্ট হলেও ওই শুটকি পল্লী দেখে আসা উচিত। দেশের মধ্যে কি এক যজ্ঞ হচ্ছে তা না দেখলে অনেক মজা ও শেখা অপূর্ণ থেকে যাবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৯১৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৫, ২০১৪