শুনেছি মালয়েশিয়াকে এশিয়ার ইউরোপ বলা হয়! তাই ছোট মামা বলতেই মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য রাজি হয়ে গেলাম। সঙ্গে ছিলেন মামী ও আমার কাজিনরাও।
মামা-মামীর সঙ্গে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আমার বেশ পুরানো। তারা আমার বন্ধুর মতো! তাদের সঙ্গে ঘুরতে গেলে মনে হয় যেন বন্ধুদের সঙ্গেই ভ্রমণ করছি।
যাহোক, মামার সঙ্গে তার দুই বন্ধু স্ত্রীসহ তাদের ছেলে-মেয়ে মিলে ১২ জনের একটি দল বেরিয়ে পড়লাম এশিয়ার ‘ইউরোপে’র উদ্দেশে।
২০১৪ সালের ১৬ জানুয়ারি মালয়েশিয়া যাওয়ার মনস্থির করলাম। ওইদিন রাত ১১ টায় আমাদের ফ্লাইট। ৯টার মধ্যেই সবাই হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পোঁছালাম।
ইমিগ্রেশনের কাজ-কর্ম সেরে মহা আনন্দে উড়োজাহাজে চড়ে বসলাম সবাই।
মালয়েশিয়ায় যাচ্ছি বলে সবার মধ্যেই ভিন্ন রকম এক উত্তেজনা কাজ করছিল। টানা চারঘণ্টা আকাশে উড়ার পর আমরা মালয়েশিয়ার সীমানায় পৌঁছালাম। আমি তো প্রায় ঘুমেই ছিলাম। হঠাৎ ক্রু’দের ঘোষণায় ঘুম ভাঙলো।
মালয়েশিয়ার সীমানায় এসেছি শুনেই জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। তখন মালয়েশিয়ার স্থানীয় সময় ভোর ৪টা।
আকাশ থেকে নিচে তাকিয়ে দেখিয়ে পুরো কুয়ালালামপুর শহরে ফুল ফুটে আছে। মানে এতো সুন্দর করে পুরো শহরটা আলোক সজ্জায় সজ্জিত ছিল, দেখে মনে হচ্ছিল একটা বড় পদ্মফুল ফুটে আছে!
এর মধ্যে প্লেন কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে অবতরণের অপেক্ষায় ছিল। তাই চটজলদি সিট বেল্ট বেঁধে নিলাম। কিন্তু আমার চোখ যেন সেই অপরূপ সৌন্দর্য দেখে জানালার বাইরে থেকে কোনো মতেই সরছিল না।
এরইমধ্যে প্লেন অবতরণ করেছে। এবার আমরা যার যার ব্যাগ নিয়ে ট্রলিতে উঠলাম। ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করে ঘড়িতে চোখ যেতেই দেখি ভোর ৫টা বাজে।
ছোটমামা ট্যাক্সি খুঁজতে গেলেন। কিছুক্ষণ পর এসে জানালেন ট্যাক্সি রেডি ঠিক ছয়টায় ছাড়বে। ট্যাক্সি ভাড়া ২০০ রিংগিত।
এয়ারপোর্ট থেকে শহরে ২০ মিনিটের রাস্তা যেতে হবে। ট্যাক্সি চলছিল, হঠাৎ আমার চোখে পড়ে ঝলমলে আলোকোজ্জ্বল টুইন টাওয়ার। যা কিনা মালয়েশিয়ার অহংকার।
উফ! একটি কথা বলতেই ভুলে গেছি- মালয়েশিয়াতে এই সময়টায় সূর্য ওঠে সকাল ৭টার দিকে। তাই ৬টার সময় রাস্তাঘাট এবং প্রকৃতি ভোর বেলার আধো আলো-আধো অন্ধকারে ছিল।
আধো অন্ধকারে টাওয়ারটি দেখে মনে হচ্ছিল কুয়ালালামপুরের নিজস্ব গাম্ভীর্য নিয়ে টুইন টাওয়ার দাঁড়িয়ে আছে। এমন দৃশ্য ক্যামরা বন্দি করতে কী কেউ ভুল করবে? আমিও ক্যামেরা বের করেই ক্লিক..ক্লিক... কিছু ছবি তুলে ফেললাম।
ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে আমরা আমাদের নির্ধারিত হোটেলেও পৌঁছে গেছি।
আবাসিক হোটেল আগে থেকেই বুকিং দেওয়া ছিল চায়না টাউন এ agoda.com থেকে।
হোটেলে আসার পর অভ্যর্থনা কক্ষ থেকে আমাদের জানানো হলো-এই মুহূর্তে আমরা রুমে ঢুকতে পারবো না। কারণ রুম এখনও প্রস্তুত হয়নি। সকাল ৮ টায় প্রবেশ করতে পারবো সেখানে।
যেহেতু সবার ওপর দিয়ে ভ্রমণের ধকল গেল! তাই বেশ ক্লান্ত এবং ক্ষুধার্ত ছিলাম আমরা। পাশেই এক হোটেল থেকে সকালের নাস্তা শেষে ৮টায় রুমে ঢোকার সুযোগ পাই।
ফ্রেশ হয়ে যার যার মতো বিশ্রাম নিচ্ছিলাম এমন সময় ছোট মামা আমাকে জানালেন, লাংকাউই যাওয়ার জন্য টিকিট কাটতে যাচ্ছেন তারা। আমি যাবো কিনা? আমি দেরি না করে ব্যাগটা নিয়ে চট করে তাদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ি।
বাস স্ট্যান্ড ছিল আমাদের হোটেলের পাশেই চায়না টাউন এলাকায়। তাই হোটেল থেকে হেঁটেই গেলাম সেখানে।
অনেকের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, কুয়ালালামপুর থেকে লাংকাউই-এর সরাসরি কোনো বাস নেই। কারণ লাংকাউই হচ্ছে একটা দ্বীপ। যেখানে যেতে হলে ক্রুস নামের বিশেষ একটি যানে যেতে হবে।
লাংকাউই-এর বিস্তারিত তথ্য নিয়ে ফের হোটেলে ফিরলাম। এরমধ্যে দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গেল। তাই আমরা একটি হোটেল খুঁজছিলাম, বাংলাদেশি একজন আমাদের বাঙালি খাবারের একটি রেস্তোরাঁর সন্ধান দিলেন। সেখানে গিয়ে পেটপুরে খাই।
বিদেশের মাটিতে দেশি খাবার খেয়ে বেশ তৃপ্ত ছিলাম আমরা। ছিল বিদেশি খাবারও। তবে রেস্তোরাঁয় গিয়ে অবাক হওয়ার মতো বিষয়! এখানে সবাই বাংলাদেশি। যেন একটা মিনি বাংলাদেশ।
রেস্তোরাঁ থেকে ফেরার পথে চায়না টাউনের ভেতর দিয়ে হোটেলে ফিরছিলাম আমরা। দোকানগুলোতে হরেক রকমের জিনিসপত্র দেখে পুরাই মাথা নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। মন চাইছে একটু শপিং করি। এরমধ্যে মামী বললেন-হাতে সময় আছে, চলো মার্কেট ঘুরে দেখি।
আমিও রাজি হয়ে গেলাম। ঘুরতে ঘুরতে কিছু কেনাকাটাও করেছি।
হোটেলে ফিরে সবাই লাংকাউই যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। মামা বললেন-যেহেতু আমরা দুইদিন পর ফিরে এই হোটেলেই থাকবো। তাই লাগেজগুলো এখানেই রেখে যাওয়া উচিৎ।
যেই কথা সেই কাজ। গোছানো শেষে রাতে গিয়ে বাসে চড়ে বসলাম। ঠিক ১১টায় বাস ছড়লো, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত দো’তলা বাস। বাসের চাকচিক্যতা দেখে বেশ ভালোই লাগলো কিন্তু নিরাশ হতে হয়-যখন দেখলাম কোনো কম্বল দেওয়া হয়নি। এজন্য পুরো রাস্তা জুড়েই শীতে বেশ ভোগান্তি হচ্ছিল। তবে সেই ভোগান্তি উবে গেছে রাতের মালয়েশিয়া দেখে। রাতের মালয়েশিয়া যে এত সুন্দর তা না দেখলে বুঝা মুশকিল।
ভোর চারটায় পৌঁছালাম কুয়ালা পার্লিসে। বাস থেকে নেমে স্থানীয়দের সহায়তায় গেলাম জেটি লেফট সাইডে। সেখানে অনেক হোটেল এবং রেস্তোরাঁ আছে। রেস্তোরাঁয় কিছু খাওয়ার সময়ই কানে ভেসে এলো আজানের ধ্বনি।
মসজিদ কোথায়? রেস্তোরাঁর লোকজন জানালেন- সমুদ্রের ওপর ভাসমান বেশ বিখ্যাত মসজিদ। দেখে অবাক হয়ে গেলাম, না দেখলে বিশ্বাসই হতো না। অপূর্ব ‘হুসাইন মসজিদে’ ফজরের নামাজ পড়তে মেয়েরাও এসেছেন। আমিও তাদের সঙ্গে নামাজ আদায় করে নিলাম। ততক্ষণে ভোরের আলো ফুটেছে।
আমরা সকালের নির্মল আলোতে মোহনীয় দৃশ্যের বেশ কিছু ছবি তুলে ক্রুসের টিকিট কেটে নিলাম। টিকিট পেলাম সকাল ৮ টায়। এরপর সারিবদ্ধভাবে ক্রুসে উঠে গিয়ে বসলাম। এবার ক্রুস ছাড়ার অপেক্ষা।
লাংকাউই ভ্রমণের কথা বলছি পরের পর্বে...
প্রিয় পাঠক, ভ্রমণ যাদের নেশা, বেড়ানোর সুযোগ এলে যারা উড়িয়ে দেন সব বাধা, কাজের অংশ হিসেবে যারা ভ্রমণ করেন কিংবা যাদের কালেভদ্রে সুযোগ হয় ভ্রমণের তারা সবাই হতে পারেন ট্রাভেলার্স নোটবুক’র লেখক। আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন বাংলানিউজের পাঠকদের সঙ্গে।
আর একটা কথা লেখার সঙ্গে ছবি পাঠাতে ভুলবেনই না, সেই সঙ্গে বাতলে দিন সেখানে যাওয়ার পথঘাটের বিবরণও।
প্রিয় পাঠক, আপনার ভ্রমণ আনন্দ বিশ্বজুড়ে বাঙালির কাছে ছড়িয়ে দিতে আমাদের ই-মেইল করুন-
বাংলাদেশ সময়: ১২০০ ঘণ্টা, মে ১৫, ২০১৫
টিআই/এমএ