ভারত থেকে ফিরে: নটার ট্রেন বারোটায় বোধহয় কেবল বাংলাদেশেই সম্ভব! হাওড়া স্টেশনের ২১ নম্বর প্লাটফর্ম। আমাদের বাংলাদেশের ট্রেন ভাবনা উড়িয়ে দিয়ে ঘড়িতে সকাল ৮টা বাজতেই ১২২৬২ নম্বর ট্রেনটি দাঁড়ালো সামনে এসে।
বগির ভিতরে ঢোকার মুখেই রয়েছে এই বগিতে যাদের আসন বরাদ্দ তাদের সবার নাম। ভিতরে ঢুকে দেখলাম দুটি সিট পড়েছে নিচে, একটি মাঝে, একটি আপার টপ। অপর দুটি সিটের একটিতে দুষ্টু মিষ্টি মেয়ে অনুশ্রী ও তার মায়ের। আরেকটি এক তরুণ ব্যবসায়ীর। প্রথম থেকেই শুরু হলো অনুশ্রীর সঙ্গে খুনসুঁটি। কিছুতেই সে আমাদের জানালার পাশে বসতে দেবে না। আর ২৬ ঘণ্টায় তার মুখ থেকে কোনো ‘হ্যাঁ’ শোনা গেলো না। সবকিছুতেই ‘না’ তার। মা-ও মহাবিরক্ত। একটু ঘুমও নেই বছর চারেকের এই পুঁচকের! আর ছবি তুলতে গেলেই ভাব যেন বেড়ে যায় আরও কয়েকগুণ।
যাইহোক ৮টা ২০ বাজতেই হুইসেল বাজিয়ে ছেড়ে দিলো ট্রেন। অপেক্ষায় ছিলাম দুরন্তের দুরন্ত গতি দেখার। কারণ দিল্লির রাজধানী এক্সপ্রেসের পর মুম্বাই দুরন্তই সবচেয়ে দ্রুতগতির ও ভালো সার্ভিসের ট্রেন হিসেবে খ্যাত। পাড়ি দিতে হবে ১৯৬২ কিলোমিটার রাস্তা। পৌঁছানোর সময় বেঁধে দেওয়া সকাল সাড়ে ১০টা। দুরন্তের সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ১১৫ কিমি। আর গড় ৭৫। রাজধানীর গড় গতি ৮৪। ভিতরে শব্দ কম। সম্পূর্ণ এসি ট্রেন হওয়ায় বাইরের প্রচণ্ড তাপ গায়ে লাগে না। তবে বিহার, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ডের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় ট্রেনের ঝাপসা কাচের জানালা দিয়ে প্রকৃতির রুক্ষতা দেখে কিছুটা অনুভব করা যায়।
ট্রেন ছাড়তে না ছাড়তেই ক্যাটারিংয়ের লোকজন হাজির। ভেজ না নন-ভেজ খাবার জানতে চাইলো। আমরা ভেজকেই নিরাপদ মনে করে জানিয়ে দিলাম। পুরো যাত্রায় চারজনের জন্য ৮ লিটার পানি বরাদ্দ। এর বেশি লাগলে কিনতে হবে। প্রথমে চার লিটার দিয়ে গেলো। এবার নাস্তার পালা। ট্রে হাতে হাজির ক্যাটারিংয়ের লোকজন। খাবারগুলো ফয়েল পেপারে মোড়ানো। সাজানো খাবার দেখে প্রথমেই ভালো লাগলো। খুলে দেখি একে একে রয়েছে বাটার, পাউরুটি, জ্যাম, ডিম, ফ্রেন্সফ্রাই, মটরশুটি ও অরেঞ্জ জুস। পরে চা অথবা কফি। দুরন্ত টিকিট কাটার সময়ই খাবারের টাকা কেটে নেয়। বুঝলাম ২৮৫০ রুপি দিয়ে তৎকাল টিকিট কেটেও খুব লস বোধহয় হবে না। খাওয়া-দাওয়া সেরে মন দিলাম প্রকৃতির দিকে। বৈচিত্র্যে ভরা ভারতের বিভিন্ন রাজ্য দেখতে দেখতে যাব ভেবেই ভালো লাগছিলো। অসুস্থ খালাও যেন অনেকটা সুস্থবোধ করছিলেন। এর মধ্যে কিন্তু সেই দুষ্টু মেয়েটি মোটেই আমাদের স্বস্তি দেয়নি। তবে তার সঙ্গে সময়টা আমাদের কেটে যাচ্ছিলো খুব দ্রুত।
হুগলি পেরিয়ে পূর্ব মেদিনীপুর পর্যন্ত বড় বড় পাহাড়। তবে প্রকৃতি খুবই রুক্ষ। ফসলি জমি দেখা গেলা কম। মাঝে মধ্যে দেখা মেলে লাল মাটির শালবন। এসব জায়গার প্রকৃতি অনেকটা আমাদের ভাওয়াল অঞ্চলের মতো। প্রকৃতিতে মগ্ন লোক কমই দেখা গেলো। সবাই ব্যস্ত ল্যাপটপ, মোবাইল নিয়ে। কেউ গান শুনেছন, সিনেমা দেখছেন, কেউ বলছেন কথা। টু সিট আপারে সুন্দরী তরুণী তনুশ্রীকে দেখা গেলো দুটোতেই মজে থাকতে। মাঝে মধ্যে আমাদের এদিকেও এসে বসছিলো। কথা শুনে বোঝা যাচ্ছিলো স্বামীর সঙ্গে অনেকটা ঝগড়া করেই মুম্বাই যাচ্ছেন তিনি। ট্রেনে ল্যাপটপ, মোবাইল চার্জ করার জন্য রয়েছে পর্যাপ্ত পয়েন্ট। প্রতি বগির সঙ্গে ওয়াশরুম দুটি। একটি ইংলিশ অর্থাৎ, হাই কমোড একটি বাংলা।
নাস্তার রেশ না কাটতে কাটতেই চলে এলো গরম গরম স্যুপ। সিটে শরীর এলিয়ে দেওয়া যেন সহ্য হলো না! এসেই ডাকাডাকি। স্যুপ খেয়ে একটু চাঙা হওয়া গেলা বটে। এবার এলো দৈনিক সংবাদপত্র নিয়ে। বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি সবই আছে। যে যেটা পড়তে চায় ফ্রি-তে নিতে পারবে। আমরা একটি বাংলা পত্রিকা নিলাম। তবু বাংলাদেশের খবর না পড়লে কি মন ভরে! মোবাইল থেকে বাংলানিউজ খুলে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। এখানে এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে ঢোকা মাত্রই মোবাইলে মেসেজ চলে আসে। শুরু হয় রোমিং। তখন ইনকামিং কলেও টাকা কাটে। ইন্টারনেট ব্যহারের ক্ষেত্রেও। তবে একদিনের জন্য পাঁচ টাকা ব্যয় করে রোমিং ফ্রিও করে নেওয়া যায়। আর যদি অন্য রাজ্য থেকে বাংলাদেশে ২ টাকা মিনিটে কথা বলতে চান তাহলে কলকাতার সিম কিনে রাজ্য অনুযায়ী বিভিন্ন অংকের টাকার পাওয়ার রিজার্জ করে নেওয়া বুদ্ধির কাজ হবে।
দেখতে দেখতেই দুপুর গড়িয়ে এলো। চলে এলো দুপুরের খাবার। খাবার নিয়ে আমাদের একটু এক্সাইটমেন্ট ছিলো। নতুন এলাকার খাবার না জানি কেমন হয়! ট্রেতে সাজানো ভাত, রুটি, ডাল, পনিরের ঝোল তরকারি, দই আর আইসক্রিম। কেউ রুটি না খেতে চাইলে ভাতও নিতে পারেন। অতিরিক্ত ভাতও চাইলে দেবে। শুধু যাওয়ার আগে ২০/৫০ টাকা টিপস দিলেই খুশি!
খেয়ে দেয়ে আবার নজর দিলাম প্রকৃতিতে। যতেই এগোতো থাকলাম প্রকৃতি যেন রুক্ষ হতে থাকলো। পাহাড়ি আবহাওয়া প্রায় পুরোটা জুড়ে। মুম্বাই যেতে পেরুতে হয় প্রায় ২৯৩টি স্টেশন। এর মধ্যে শুধু ৫টি স্টেশনে ১০ মিনিট করে যাত্রাবিরতি। সেটাও আবার পানি, খাবার নেওয়ার জন্য। এগুলো হলো- ঝাড়খন্ডের জামশেদপুরের টাটানগর, ছত্তিশগড়ের বিলাসপুর, মহারাষ্ট্রের নাগপুর, ভূশাওয়াল এবং মহারাষ্ট্রের নাসিক জেলার পাহাড়ি স্টেশন ইগাতপুরি। এই স্টেশন থেকে সামনে এগুতো দুটি ইঞ্জিন যুক্ত করতে হয়। কারণ পুরো রাস্তাটি পাহাড় কেটে করা, উঠতে হয় উপরের দিকে। পাড়ি দিতে হয় কয়েকটি টানেল।
সময় যেন কেটে যাচ্ছে দ্রুত গতিতে। ঠিক মুম্বাই দুরন্তের মতো। দুপুরের খাবার হজম হওয়ার আগেই আবার বিকেলের চা কফি চলে এলো। ভাবনায় ছিলাম রাতে কীভাবে সময় পার করবো। সন্ধ্যা হতেই আবার নাস্তা। এবার হালকা খাবারের সঙ্গে টাটকা আপেল। সেই দুষ্টু মেয়েটি কিন্তু এরইমধ্যে ঘুম দিয়েছে। অন্ধকার হতেই আমাদের শরীরটাও এলিয়ে এলো। ৮টা বাজতেই খাবার। খেয়েদেয়ে এবার ঘুমানোর পালা। আপা ও খালা নিচে। আমি মাঝে। আর ছোট ভাইটি আপার টপে। চিন্তায় ছিলাম কীভাবে ঘুমাবো ট্রেনের শব্দে! কিন্তু কম্বল, সাদা পরিচ্ছন্ন বেড কাভার আর চাদর মুড়ি দিয়ে শুতেই ঘুমিয়ে গেলাম।
ভোরে ঘুম ভাঙলো আপার কণ্ঠে ‘দূরে ওইগুলো কীসের বাগান মাইলের পর মাইল’ বাক্য শুনে। পাশ থেকে অনুশ্রীর মা জানালেন এগুলো আঙুর বাগান। তড়িঘড়ি করে উঠে বসলাম দেখার জন্য। সত্যি মাইলের পর মাইল। তখন আমরা নাসিকের কাছাকাছি। ঢুকে গেছি মহারাষ্ট্রে। মনে মনে ভাবলাম মুম্বাই পৌঁছে আঙুর ভালোই খাওয়া যাবে সস্তায়।
ইগাতপুরিতে এসে ট্রেন থামলো সকাল ৮টার দিকে। এখান থেকে যুক্ত হলো ডাবল ইঞ্জিন। প্রকৃতিও বদলে গেলো। ঝাড়খন্ড, ছত্তিশগড়ের স্টেশনগুলোতে দেখা তামাটে শরীরের মানুষগুলো যেন বদলে যেতে লাগলো। বড় বড় শিলাখণ্ড। তার মধ্যে কোথাও কোথাও একটি ঘর অথবা বাড়ি। ঠিক সিনেমায় নায়ক-নায়িকা পালিয়ে গিয়ে যেমন জায়গায় আশ্রয় নেয় তেমন জায়গা। পাথরগুলো সব কালচে। বোঝা যায় বেশ বয়সী। পাথর কেটে কেটে ট্রেন লাইন বানানো। কোথাও সেতু কোথাও পাড়ি দিলাম টানেল। একগাদা চা নাস্তা খেতে খেতে ঘণ্টা দুই পরেই এসে গেলাম মুম্বাইয়ের ছত্রপতি শিবাজি টার্মিনাসে।
ছাত্রপতি শিবাজির একচ্ছত্র আধিপত্য চোখে পড়বে মুম্বাইয়ে। তিনি ছিলেন বীর যোদ্ধা। পুরো নাম। শিবাজি শাহজী ভোসলে। ছত্রপতি তার অর্জিত উপাধি। মারাঠা সাম্রাজ্যের প্রবর্তক তিনি। মুম্বাইয়ের বিমানবন্দরটিও তার নামে।
যাইহোক যাত্রা সময় ২৬ ঘণ্টা ১০ মিনিটি হলেও আমরা পৌঁছে গেলাম ১০ মিনিট আগেই। বুঝলাম ভারতের মানুষ কেন এত ট্রেন পছন্দ করে। এমন সার্ভিস হলে কেউ অন্য বাহনে উঠবে কেন?
আগামী পর্বে জানাবো ভারতের বাণিজ্যিক রাজধানী, বলিউড তারকাদের আবাস মুম্বাই দর্শনের কথা।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৪০ ঘণ্টা, মে ৩০, ২০১৫
এএ/এমজেএফ
** সোনার হরিণ ট্রেন টিকিট, অতঃপর হাওড়া স্টেশন
** ৫৫২ টাকায় ঢাকা থেকে কলকাতা