‘বিদেশ ভ্রমণ’-শব্দটির মধ্যেই বেশ রোমান্টিকতা আর রোমাঞ্চ লুকিয়ে থাকলেও বাস্তবে তেমনটা সবসময় নাও হতে পারে। তবুও দিন শেষে অম্ল-মধুর সব অভিজ্ঞতায় হয়ে উঠে সুখ-স্মৃতির খোরাক।
মে মাসের ভ্যাপসা, তীব্র গরমের মধ্যে ভারত ভ্রমণ যে খুব একটা সুখকর হবে না, সে বিষয়ে আত্মীয়-স্বজন-বন্ধুরা সর্তক করেছিলেন আগেই। চিন্তা-ভাবনা শেষে বেছে বেছে বেড়ানোর জন্য ঠাণ্ডা জায়গাই নির্বাচন করলাম।
আমাদের গন্তব্য ছিল ভারতের হিমাচল প্রদেশের ছোট্ট শহর মানালিতে। সেখান থেকে সিমলা ও চন্ডীগড়। দেশে থেকেই অনলাইনে ভারতের একটি নামকরা ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে আমরা সাতদিনের একটি প্যাকেজ বুক করে রেখেছিলাম।
সে হিসেবে ২১ মে চট্টগ্রাম থেকে ফ্লাইটে আমরা কলকাতায় গিয়ে পৌঁছাই। বন্দরনগর চট্টগ্রামের যে গরম আবহাওয়া কলকাতায় তা অনেক বেশি। তার ওপর সেখানে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গার দূরত্ব এতই বেশি যে ‘যাইতে যাইতেই বেলা চলিয়া যাইবে’!
ভারতীয় সময় রাত ১১টায় কলকাতার নেতাজী সুভাষ চন্দ্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছি আমরা। রাতটা পার করেই পরের দিন সকালে আবার চলে এলাম একই বিমানবন্দরে।
এবারের গন্তব্য দিল্লি। দুপুরে ঠিক সময় মতো আমরা আকাশে উড়লাম। এরপর মেঘের মাঝে দুর্নিবার গতিতে আকাশ যানের ছুটে চলা। বাইরের এত সুন্দর দৃশ্য, নীল আকাশ, মেঘের ফাঁকে দেখা যাচ্ছে অতিক্ষুদ্র ভূ-খণ্ডাবশেষ! পাক্কা দুই ঘণ্টার জার্নি শেষে দিল্লি এয়ারপোর্টে অবতরণ করে আমাদের প্লেন।
এর আগে প্লেনের পাইলটের মাধ্যমে জেনেছি- দিল্লির সেদিনের তাপমাত্রা ৪৭ ডিগ্রি সেলসিলাস। যেখানে কলকাতার ৩৬ ডিগ্রি তেই আমার যায় যায় অবস্থা, সেখানে দিল্লিতে কী হবে সেটা ভেবেই আরও মুষড়ে পড়লাম।
তবে আমাদের ভাগ্য বেশ ভালো, গরমে দিল্লিতে খুব বেশিক্ষণ আমাদের থাকতে হয়নি। আমরা পৌঁছানোর আগেই এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করছিল আমাদের ড্রাইভার কাম গাইড গান্ধী রাম।
দিল্লিতে নেমেই মুঠোফোনে তার সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। ফলে বাইরে গিয়ে তাকে খুঁজে বের করতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। এয়ারপোর্ট থেকেই দুপুরে খাবার কিনে রওয়ানা হলাম মানালির উদ্দেশে।
দিল্লি থেকে সড়কপথে মানালির দূরত্ব ৫৫০ কিলোমিটার। যেতে সময় লাগে ১৪ থেকে ১৫ ঘণ্টা।
শুরু হল আমাদের মানালি যাত্রা। যাত্রা পথে পড়লো পাঞ্জাব, হরিয়ানা, অমৃতসরসহ বেশ কিছু জায়গা। দিল্লি ও হাইওয়েগুলোতে কিন্তু দেখলাম রাস্তার দু’পাশে ধাবা নামের পাঞ্জাবি খাবারের দোকান। যেগুলো সারা রাত অবধিই খোলা থাকে।
সন্ধ্যায় আমরা এমনই একটি ধাবা’য় হালকা খাবার খেয়ে নিলাম। কথায় কথায় ড্রাইভার গান্ধীজীর কাছ থেকে জেনে নিলাম মানালির প্রকৃতি সর্ম্পকে।
গান্ধীজী কিন্তু হিমাচল প্রদেশেরই মানুষ। তাই এ বিষয়ে তিনি বেশ সাহায্য করেছিলেন আমাদের।
বিরতি শেষে আবারও ছুটে চলা, আমরা দুজনকে নিয়ে ছোট্ট গাড়িটা ছুটছিল পাহাড়কন্যা মানালির দিকে।
তবে এখানে ভাষাগত কিছুটা সমস্যায় পড়তে হয়! তবে আমার ভাগ্য ভালো, আমার সহযাত্রী বেশ ভালোই হিন্দি বলতে পারেন, যার দরুণ যাত্রাপথে আমাদের তেমন কোন সমস্যাই হয়নি।
রাতের খাবারের জন্য গান্ধীজী আমাদের নামালেন একটি অভিজাত পাঞ্জাবি রেস্তোরাঁয়। ‘হাভেলি’ নামের সেই রেস্তোরাঁয় ঢুকেই তো অবাক। এখানে ইন্টেরিয়র থেকে শুরু করে বেয়ারার পোশাক পর্যন্ত সবকিছুতেই পাঞ্জাবি পাঞ্জাবি ছাপ।
জানিয়ে রাখা ভালো- যারা মাছ-মাংস খেতে পছন্দ করেন তাদের জন্য কিন্তু এ ধরনের রেস্তোরাঁ একেবারেই পোষাবে না। কারণ এখানের সব আইটেমই নিরামিষ। মটর পনির, ডাল মাখানি, আচার, রাইতা, পাঁপড় এসবই এখানকার মূল খাবার। যা বাঙালিদের একেবারেই পোষাবে না। ভেতো বাঙালির খিদে কী আর ডাল-রুটিতে মেটে!
তাই কোনমতে খাওয়া সেরেই আবারও যাত্রা শুরু করলাম। এ সময় গান্ধীজী জানালেন- মানালি যাওয়ার রাস্তাটা পাহাড়ে ঘেরা, আর কিছুটা বিপদসংকুলও বটে। পরে অবশ্য এ কথা হারে হারে টের পেয়েছি।
পুরোটা রাতই চললো আমাদের মানালি যাত্রা। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গেই সঙ্গেই আমরা চলে এলাম পাহাড়ি এলাকায়। চারপাশে এত খাদ আর রাস্তা এত সরু যে গাড়ির জানালা দিয়ে উঁকি দিতেও ভয় পাচ্ছিলাম। তখন মনে হচ্ছিল বেড়াতে এসে নাকি সলিল সমাধিই হয় এখানে!
তবে সব ভয় কাটিয়ে বেশ দক্ষতার সঙ্গেই গাড়ি চালালেন গান্ধীজী। সকাল সাতটার দিকে আমরা মন্ডিতে পৌঁছে যাই। পাহাড়-নদীতে ঘেরা ছোট্ট ছিমছাম শহর মন্ডি।
কুল্লু-তে পৌঁছে তো আরও অবাক হয়ে গেলাম। এই জায়গাটি ঘিরে বয়ে যাচ্ছে স্রোতস্বিনী নদী বিয়াস। বড় বড় পাথরের চাইয়ে আছড়ে পড়া বিয়াসের স্রোত, পাহাড় আর ঠাণ্ডা বাতাস।
সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল যেন স্বর্গে প্রবেশ করতে যাচ্ছি! এখানে কিন্তু সারা বছরই ঠাণ্ডা থাকে। আর শীতকালে তো তুষারপাতে সাদা হয়ে যায় পুরো এলাকা। আমাদের রিসোর্টটা ছিল কুল্লু-তেই, সেখান থেকে মানালি মাত্র ৫ কিলোমিটার দূরে।
রিসোর্টের কক্ষ থেকে বাইরে তাকালেই দেখা যাচ্ছিল মানালির অপার সৌন্দর্য, সবুজ পাহাড়ের সারি তারপরে শ্বেতশুভ্র বরফে ঢাকা পাহাড়। এজন্য বোধ হয় মানালিকে ভারতের ‘সুইজারল্যান্ড’ বলা হয়ে থাকে।
রিসোর্টে পৌঁছে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার পর দুপুরে এখানকার রেস্তোরাঁতেই খেলাম। ভাত-মুরগির মাংস দিয়ে দুপুরের খাবার সেরে বাইরে বেরুতেই লাগলো ঠাণ্ডা হাওয়ার পরশ।
স্থানীয়রা জানালেন, এখানে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত যা একটু রোদ থাকে। এরপর রোদের তেজ কমে আসে। তবে সূর্যাস্ত হয় কিন্তু বেশ দেরিতে। সব মিলিয়ে চমৎকার আবহাওয়া।
এই তো চাই....! এভাবেই শুরু হলো আমাদের মানালি দর্শন। বাকিটা পরের পর্বে...
প্রিয় পাঠক, ভ্রমণ যাদের নেশা, বেড়ানোর সুযোগ এলে যারা উড়িয়ে দেন সব বাধা, কাজের অংশ হিসেবে যারা ভ্রমণ করেন কিংবা যাদের কালেভদ্রে সুযোগ হয় ভ্রমণের তারা সবাই হতে পারেন ট্রাভেলার্স নোটবুক’র লেখক। আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন বাংলানিউজের পাঠকদের সঙ্গে।
আর একটা কথা লেখার সঙ্গে ছবি পাঠাতে ভুলবেনই না, সেই সঙ্গে বাতলে দিন সেখানে যাওয়ার পথঘাটের বিবরণও।
প্রিয় পাঠক, আপনার ভ্রমণ আনন্দ বিশ্বজুড়ে বাঙালির কাছে ছড়িয়ে দিতে আমাদের ই-মেইল করুন-
বাংলাদেশ সময়: ০১৪৪ ঘণ্টা, জুন ১০, ২০১৫
এমএ