ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

মুম্বাই-কলকাতার কড়চা-৬

সাগরকোলে হাজি আলী দরগা

আসিফ আজিজ, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭২৪ ঘণ্টা, জুলাই ৮, ২০১৫
সাগরকোলে হাজি আলী দরগা ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

মুম্বাই থেকে ফিরে: মুম্বাইয়ে দ্বিতীয় দিন। সকাল সাতটায় খালার পেটসিটি টেস্ট করাতে বেরিয়ে পড়লাম।

হোটেলে ফিরলাম ৯টার পর। ডাক্তার জানালো রোগীর ধারে-কাছে থাকা যাবে অন্তত ৬-৭ ঘণ্টা। কারণ এই টেস্ট করার পর রোগীর শরীর থেকে যে রেডিয়েশন ও ঘাম বের হবে সেটি সুস্থ মানুষের জন্য ক্ষতিকর।

তাই খালাকে হোটেলরুমে রেখে, খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করে আমরা তিনজন বেরিয়ে পড়লাম। এবারের গন্তব্য মুম্বাইয়ের বিখ্যাত হাজি আলী দরগা। ধর্মীয় ভাব-গাম্ভীর্যের পাশাপাশি এর অন্য একটি বিশেষত্ব রয়েছে। সাগরে যখন জোয়ার থাকে তখন মনে হয় এটি সাগরের মধ্যের ভাসমান একটি স্থাপনা। তখন এর রূপও পাল্টে যায়।   আমাদের হাজি আলী যাওয়ার উদ্দেশ্য রূপদর্শন।

ভিল পারলের সান্তাক্রুজ থেকে ট্যাক্সিতে প্রায় ১৭ কিলোমিটার দূরত্বে হাজি আলী। ট্যাক্সিতে উঠে জানলাম আমরা সি-লিংক দিয়ে যাবো। এটি মুম্বাইয়ের আরেকটি দর্শনীয় স্থান। সুযোগ থাকলে সবারই দেখা উচিত। বান্দ্রা থেকে ওয়ারলিকে যুক্ত করা এই সি-লিংককের নাম রাজীব গান্ধী সি-লিংক। এটি যুক্ত করেছে পশ্চিম ও দক্ষিণ মুম্বাইকে। ৫.৬ কিলোমিটার দীর্ঘ ব্রিজটি যাত্রাপথ কমিয়ে দেবে অনেকটাই। টোল ৫৫ টাকা। কিন্তু ভুলেও ক্যামেরা বের করবেন না। এখানে ছবি তোলা নিষেধ। রয়েছে সিসি ক্যামেরার নজরদারি।

এই সি-লিংকের রূপ-দর্শন না বললেই নয়। অনেকটা ধনুকের মতো বাঁকা। উত্তরে ধনুকের মতো বাঁকা মাহিম বিচ। বিচ ও ব্রিজের মাঝের সাগরজল মাহিম বে নামে পরিচিত। অত্যাধুনিক স্থাপত্য ও শিল্পশৈলীতে তৈরি এ ব্রিজ থেকে সাগর দর্শনে অনুভূতি সত্যি অন্যরকম। তবে ট্যাক্সিতে পথটুকু পেরুতে ৫ মিনিটের বেশি লাগলো না।

পার হয়ে ঢুকলাম ওয়ারলিতে। ওয়ারলি থেকে হাজি আলী যাওয়ার রাস্তাটুকুও সুন্দর। আমরা যখন যাচ্ছি তখন বাইরে গা পোড়ানো রোদ। তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি। তবে আর্দ্রতা কম থাকায় ঘাম কম হয় এখানে। এরমধ্যেও সাগরকিনারজুড়ে বাঁধানো রাস্তা, বসার বেঞ্চ, মধ্যে মধ্যে গাছ আর পরিচ্ছন্নতা টানলো ট্যাক্সি থেকে নেমে যেতে। সময় কম তাই সম্ভব হলো না। সত্যি ছবির মতো সুন্দর!

মিনিট কয়েকের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম হাজি আলী। ভাড়া দিলাম ২৩৬ রুপি। নেমেই পাশে থাকা লেবুর শরবত খেলাম দুই গ্লাস করে। মুম্বাই শহরের এই জিনিসটি খুবই মজার ও সস্তা। মাত্র ৫ রুপি। স্বাদ দারুণ। এছাড়া আঙুর, বেদানা, মুসম্বি, মালটা প্রভৃতি জুসেরও নাম আছে। শরবতে প্রাণ ঠান্ডা করে আন্ডারপাস দিয়ে নেমে ধরলাম হাজি আলীর পথ। এই আন্ডারপাসটি মোটামুটি বিকিকিনির ছোট একটি মার্কেট। কম দামে দেখেশুনে ভালো জিনিস কেনা যায় এখানে।

আন্ডারপাস থেকে উপরে উঠে মিনিট দশেকের হাঁটা রাস্তা। রাস্তাটি চলে গেছে সোজা আরব সাগরের বুকে ৫শ মিটার দূরে। এটি মূলত দক্ষিণ ওয়ারলির উপকূলীয় অঞ্চল। দু’পাশে জায়নামাজ, তজবি, আতরসহ নানা উপকরণ বিক্রির দোকান। যাত্রাপথে খুব জ্বালাবে দোকনিরা। তবে ঘর সাজানোর নানান শোপিস ও মেয়েদের চুড়ি গহনাও মিলবে এখানে।

কড়া রোদে মিনিট ‍আটেক হেঁটে পৌঁছালাম দরগা গেটে। এই পথটুকু অনেকটা পাথুরে। দুপাশে বড় বড় কালো পাথরের দেখাও মিলবে। তাছাড়া এখানে দাঁড়িয়ে সাগরকোলের শহর মুম্বাইয়ের স্থাপনাগুলো দারুণ দেখা যায়।

যার সমাধি কেন্দ্র করে এখানে দরগা প্রতিষ্ঠিত সেই হাজি আলী সম্পর্কে একটু জেনে নেওয়া যাক। সৈয়দ পির হাজি আলী শাহ বুখারি ছিলেন ধনী মুসলিম বণিক। ইসলাম প্রচারে তিনি দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াতেন। এভাবেই পনেরো শতকের মাঝামাঝি সময়ে তিনি ভারতের মুম্বাইয়ে এসে আবাস গড়েন। তার মৃত্যুর আগে ও পরের রয়েছে নানান কিংবদন্তি। মৃত্যুর আগে তিনি তার অনুসারীদের বলেন, মৃত্যুর পর তার মরদেহ যেন কফিনে ভরে আরব সাগরে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।

মক্কা যাওয়ার পথে তিনি মারা যান। তার মরদেহ কারুকার্য খচিত একটি কফিনে করে সাগরে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে কফিনটি আরব সাগরের এই উপকূলে ফিরে আসে। পরে তাকে সেখানেই সমাহিত করে দরগা প্রতিষ্ঠিত করা হয়।

দরগার এখনকার বর্তমান অবকাঠামো উনিশ শতকের। সুদৃশ্য গেট দিয়ে ঢুকেই দেখা গেলো মানুষের ভিড়। সোজা যেদিকে চোখ যায় সেখানে দরগা। ডানে মসজিদ ও বিশ্রাম নেওয়ার জায়গা। বাঁয়ে আলী ট্রাস্টের অফিস। অন্যসব দরগার মতোই মানুষ তাদের মনোবাসনা পূরণের নানান অভিপ্রায় নিয়ে হাজির সেখানে। তবে দর্শনার্থীও নিতান্ত কম নয়। সব ধর্মের মানুষের আনাগোনা এখানে। রয়েছে মসজিদ, ধর্মীয় বক্তব্য শোনার জায়গা। সমাধিসৌধের ভিতরে ঢুকে কাউকে কাউকে দেখা গেলো মানত পূর্ণ করতে। তবে ইন্দো-ইসলামিক স্থাপত্যশৈলী সত্যি মনোমুগ্ধকর। ভিতরে বাইরে ধর্মব্যবসায়ীরাও চোখ এড়াবে না কারও।

জানা যায়, প্রতিদিন এখানে আট থেকে ১০ হাজার লোকের সমাগম হয়। ছুটির দিনে এ সংখ্যা ছাড়ায় ২০-২৫ হাজার।

স্থাপনার চারপাশে রয়েছে কালো বহু প্রাচীন পাথরখণ্ড। সাগরের ঢেউ আছড়ে পড়ে সেখানে। বহু দর্শনার্থী নেমে সাগরজলের ছোঁয়া নেন সেখান থেকে। জায়গাটি অনেকটা দ্বীপের মতো। আমরা যখন গেলাম তখন ভাটা ছিলো। পূর্ণ জোয়ারেও কখনও হাজি আলী ডোবে না। ক্ষতি করতে পারে না কোনো বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগও। আর জোয়ারের সময় দূর থেকে মনে হয় সাগরের মাঝে জলের উপর ভাসছে হাজি ‍আলী।

পূর্ণ যৌবন রূপ দেখতে পেলাম না। রওয়ানা হলাম গেটওয়ে ইন্ডিয়া, তাজ হোটেল দর্শনে। সেখান থেকে ফেরার পথে শেষ গোধূলিতে ক্ষণিকের জন্য দেখা পেলাম হাজি আলীর যৌবনরূপ। তখন পূর্ণ জোয়ার। আমাদের হাজি আলী যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিলো সৌন্দর্যদর্শন। সে আশা পূরণ হলো কিছুটা। আগামী পর্বে জানাবো গেটওয়ে ইন্ডিয়া, তাজ হোটেল, মেরিন ড্রাইভের রূপ।

বাংলাদেশ সময়: ০৭২৬ ঘণ্টা, জুলাই ০৮, ২০১৫
এএ

** বলিউড তারকাদের বেহাল জুহু বিচ!
** প্রথম দর্শনেই মুম্বাইপ্রেম, চিকিৎসায় মন ভালো
** মনভোলানো খানাপিনায় ২৬ ঘণ্টায় মুম্বাই
** সোনার হরিণ ট্রেন টিকিট, অতঃপর হাওড়া স্টেশন
** ৫৫২ টাকায় ঢাকা থেকে কলকাতা

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।