সুযোগ পেলেই ঘুরে বেড়াই নদী, সাগর, পাহাড় কিংবা গহীন অরণ্যে। ছুটে চলি নৈসর্গিক সৌন্দর্যের টানে প্রকৃতির কোলে।
সরকারি গোয়েন্দা সংস্থায় কর্মরত এক বন্ধুর মাধ্যমে আগে থেকেই সেখানে স্থানীয় হোটেলে রুম বুকিং করা ছিল। তাই বাস থেকে নেমে কোনো ঝামেলা ছাড়াই সোজা রুমে।
এরপর ‘দে-ছুট’ ভ্রমণ সংঘের ফেস্টুন নিয়ে সিএনজি চালিত অটোরিকশায় চেপে রি-ছাং ঝরনার পথে ছুটে চলা।
অটোরিকশা তার ধারণক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত দু’জন যাত্রী নিয়ে সর্বোচ্চ গতিতে ভোঁ ভোঁ শব্দ তুলে পাহাড়ি পথে এগোচ্ছে। দু’পাশে নজড়কাড়া প্রকৃতি, মাঝে পিচঢালা উঁচুনিচু পথ।
কখনও মনে হয় আরেকটু সামনে এগোলেই হয়তো নীলাভ আকাশ ছুঁয়ে দেবে আমাদের। তবে আকাশের পরশ না পেলেও আলুটিলা মোড়ে মেঘের ভেলার সঙ্গে দারুণ এক সাক্ষাৎ হয়েছে। সে এক অপার্থিব অনুভূতি, অজানা শিহরণ!
শেষ বসন্তে পাহাড়ের নৈসর্গিক প্রকৃতি দেখতে দেখতে এক সময় পৌঁছে যাই রি-সং ঝরনার কাছাকাছি। অটোরিকশা আর যাবে না। অগত্যা পাহাড়ি পথে পায়ে হাঁটা শুরু। কখনও উঁচু আবার কখনও নিচু এভাবে চড়াই উৎরাই পেরিয়ে পৌঁছাতে হবে জলধারার কাছে।
আগের দিনের ভ্রমণ আর পাহাড় ট্র্যাকিংয়ের কারণে শরীর কিছুটা ক্লান্ত ছিল। তারপরও প্রকৃতির ছোঁয়া পেতে কোনো কষ্টই অনুভূত হচ্ছিল না। প্রায় চল্লিশ মিনিট উঁচু-নিচু পথ পাড়ি দিয়ে হাজির হলাম দৃষ্টিনন্দন সেই ঝরনার সামনে। বিশাল জলরাশি অবিরাম ধারায় গড়িয়ে যাচ্ছে তার নিয়মিত ছন্দে।
রি-ছাং মারমা শব্দ। রি মানে পানি আর ছাং মানে গড়িয়ে পড়া। নামের সঙ্গে ঝরনার বৈশিষ্টের কী দারুণ মিল!
পাথুরে পাহাড়ের মাঝে হৈ-হুল্লোড় করে ঝরনার পানিতে নিজেদের মেলে ধরি। প্রচণ্ড গতিতে প্রায় ৬০ ফিট উপর থেকে পানি পড়ার রিমঝিম শব্দ। দেশের অন্যসব ঝরনার চেয়ে এ ঝরনার বৈশিষ্ট সম্পূর্ণ ভিন্ন।
পর্যটকরা নিরাপদে এর জলে মনের আনন্দ জলকেলি করতে পারেন। কেউ চাইলে শৈশবের স্মৃতি হাতড়ে উপর থেকে পিছলে নিচে নামার আনন্দও নিতে পারেন।
আমরা কয়েক ঘণ্টা ধরে ঝরনার জলে আনন্দে মেতেছিলাম। ভেজার স্বাদ যেন মিটছিলোই না। সঙ্গে ছিলো অসংখ্যবার পিছলে নিচে নামার বাল্য খেলা।
শেষে দেখি থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট ছিঁড়ে হা! দীর্ঘ সময় ঝরনা জলের সান্নিধ্য শেষে এবার ‘দে-ছুট’র নতুন মিশন ঝরনার পানির উৎসের দিকে পা বাড়ানো। পিচ্ছিল পথ আর লতাগুল্ম ছাড়িয়ে এগিয়ে যাই উপরের দিকে। এক সময় উৎসের মুখে এসেও যাই, তবে সে পথ ছিল বেশ বন্ধুর আর ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু আমরা দুর্গম দুঃসাহসী ভ্রমণে পেয়েছি মহানন্দ।
পানির উৎসের মুখে গিয়ে তো আমাদের চোখ কপালে! ও-- য়া--ও! কত ঝরনারই তো উৎস দেখেছি কিন্তু এমন আর একটিও দেখিনি। যেন প্রাকৃতিকভাবে তৈরি সুইমিংপুল।
ইচ্ছে হলে সাঁতারও কাটা যাবে। চোখ বন্ধ করে একবার ভাবুন তো, সম্পূর্ণ বুনো পরিবেশে হাজার ফিট উপরে সাঁতার কাটতে কেমন লাগবে!
বুনো উদ্যম আর কৈশোরিক উন্মাদনা নিয়ে আবার সাঁতারে নামলাম। এ জনমে যতগুলো ঝরনায় দেহ-মন ভিজিয়েছি, তার মধ্যে সবচেয়ে আনন্দময় ও নিরাপদ মনে হয়েছে প্রকৃতির এই রহস্য ঘেরা ঝরনাধারা রি-ছাং।
আকাশ ছোঁয়া, পাহাড়ি বৃক্ষের ছায়া, ঘন জঙ্গলের বুনো গন্ধ, অচেনা পাখির মিষ্টি সুরে ভ্রমণ পিপাসুদের মন ছুয়ে যেতে বাধ্য।
সরকারের সংশ্লি¬ষ্ট বিভাগ যদি একটু নজর দেয় তাহলে আমাদের প্রকৃতি কন্যা রি-ছাং ঝরনা ভ্রমণ বিলাসীদের জন্য হয়ে উঠবে এক অনবদ্য বিনোদন মঞ্চ।
খাগড়াছড়ি ভ্রমণে আরও যা যা দেখতে পারেন:
আলুটিলা গুহা, দেবতার পুকুর, ডিজনি ল্যান্ড, বন বিহার, শান্তিপুর অরণ্য কুটির।
যেভাবে যাবেন:
রাজধানীর গাবতলী বা সায়েদাবাদ থেকে বিভিন্ন পরিবহনের বাস খাগড়াছড়ির উদ্দেশে রাত-দিনে ছেড়ে যায়। ভাড়া ৫৭০ টাকা।
রাতযাপনের জন্য খাগড়াছড়িতে পর্যটন করপোরেশনের মোটেল, শহরের শাপলা চত্বরে শৈল সুবর্ণা ও জিরানসহ বেশ কিছু আবাসিক হোটেল রয়েছে।
হোটেলের কক্ষ ভাড়া ১ হাজার ১০০ থেকে ৫ হাজার টাকার মধ্যে। তবে চেঙ্গীস ব্রিজের পাশে পর্যটন মোটেলে রাত কাটানোর আনন্দই আলাদা। খরচ জনপ্রতি দুই দিনের জন্য সর্ব্বোচ্চ তিন হাজার টাকা পড়বে।
প্রিয় পাঠক, ভ্রমণ যাদের নেশা, বেড়ানোর সুযোগ এলে যারা উড়িয়ে দেন সব বাধা, কাজের অংশ হিসেবে যারা ভ্রমণ করেন কিংবা যাদের কালেভদ্রে সুযোগ হয় ভ্রমণের তারা সবাই হতে পারেন ট্রাভেলার্স নোটবুক’র লেখক। আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন বাংলানিউজের পাঠকদের সঙ্গে।
আর একটা কথা লেখার সঙ্গে ছবি পাঠাতে ভুলবেনই না, সেই সঙ্গে বাতলে দিন সেখানে যাওয়ার পথঘাটের বিবরণও।
প্রিয় পাঠক, আপনার ভ্রমণ আনন্দ বিশ্বজুড়ে বাঙালির কাছে ছড়িয়ে দিতে আমাদের ই-মেইল করুন-
বাংলাদেশ সময়: ০২৫ ঘণ্টা, জুলাই ৩০, ২০১৫
আরএম/এমএ