নেত্রকোনা: মানুষ মাত্রই ইতিহাসের প্রতি আগ্রহী। আর তা যদি হয় নিজ দেশের রাজা-জমিদারদের ইতিহাস।
তেমনিই এক ইতিহাস রয়েছে প্রায় ৮০০ বছর আগের সুসং নগর বা সুসং রাজ্যের। বর্তমানে যা নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর নামে পরিচিত।
সুসং রাজ্যের রাজধানী দুর্গাপুরের রাজবাড়ীগুলোর একটি ছিল দু’আনি বাড়ি। জেনে নেওয়া যাক প্রথম জীবনে সন্ন্যাসী থাকা সোমেশ্বর পাঠকের গোড়াপত্তন করা সুসং রাজ্যের দু’আনি বাড়ির সাত-পাঁচ।
নেত্রকোনা জেলার ভারত সীমান্তবর্তী পাহাড়ঘেরা জনপদ দুর্গাপুর। তবে ১৩ শতকের শেষদিকে এ অঞ্চলে জনবসতি ছিল কম। তৎকালীন রাজার অত্যাচারে অতিষ্ঠদের অনুরোধে যুবক সন্ন্যাসী সোমেশ্বর পাঠক দুর্গাপুরে আসেন ১২৮০ সালের দিকে। এরপর তার হাতে গোড়াপত্তন ঘটে সুসং রাজ্যের। এর রাজধানী হয় দুর্গাপুর।
১৩ শতকের শেষ থেকে শুরু করে জমিদারি প্রধা বিলুপ্ত পর্যন্ত টিকে ছিল সুসং রাজত্ব। সময়ের হিসেবে প্রায় ৬৬৭ বছর।
তবে রাজত্বের শেষ দিকে এসে রাজপরিবারের অভ্যন্তরীণ সংকটে ৪ ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় সুসং রাজ্য। তৈরি হয় ৪টি রাজবাড়ী। এরই একটি দু’আনি বাড়ি।
এদিকে, ১৯৫৪ সালে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ হলে সুসং রাজবংশের সদস্যরা সবাই ভারতে চলে যান। তবে এখনো কালের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে রাজবাড়ীগুলো।
দু’আনি বাড়ি
রাজবাড়ী বলতে আমাদের মানসপটে যে বিশালাকার ইমারত বা সুউচ্চ দালান ভেসে ওঠে সুসং রাজবাড়ীগুলো আদতে তেমন নয়। কি আকার, কি শৈলী সবদিকেই সুসং রাজ্যের সর্বকনিষ্ঠ এ রাজবাড়ী দু’আনি বাড়ি ব্যতিক্রম। ১ একর ৮ শতাংশ জমি নিয়ে বাড়িটি।
দু’আনি বাড়ির প্রবেশ পথেই ২ পাশে মাটির কলস বসানো প্রধান ফটক। ফটক গলে ভেতরে ঢুকতেই ফটক বরাবর চোখে পড়বে কাঠের তৈরি নিপুণ কারুকার্যের নজরকাড়া বিশালাকৃতির ঘর।
ঘরের সামনে টবে রাখা বাহারি রঙ-গন্ধের ফুলের বাগান। এখানেই একসময় রাজপরিবারের সদস্যদের ব্যবহারের জন্য ইঁদারা ছিল।
রাজবাড়ীর বাম দিকে রয়েছে ৩টি পূজামণ্ডপ। কাঠের কারুকার্যে ও রংয়ের অপূর্ব মনোরম মিশেলে তৈরি মণ্ডপগুলো চোখে এনে দেয় প্রশান্তি।
প্রথম মণ্ডপুটি দেবী দুর্গার, দ্বিতীয়টি দেবী লক্ষ্মী ও কালীর এবং শেষটি কৃষ্ণের। এসব মণ্ডপে এখনো আশ্বিন মাসে বিশালাকারে দুর্গা পূজা হয়। বছরের অন্যান্য সময়েও এখানে পূজা-পার্বন লেগেই থাকে।
দু’আনি বাড়ির অনেক স্মৃতিচিহ্ন এখনও অনেকটা আগের মতোই রয়েছে। বর্তমানে ওই বাড়িতে বাস করছেন গোপাল দাস নামে এক ব্যক্তি। তিনি এই রাজবাড়ীর সর্বশেষ রাজা ভূপেন্দ্র চন্দ্র সিংহ শর্মার সাবেক কর্মচারী সাধুচরণ দাসের নাতি।
বাড়িটি গোপাল দাস স্থানীয় প্রশাসনের কাছ থেকে ৯৯ বছরের জন্য লিজ নিয়েছেন বলে উপজেলা পরিষদ সূত্র জানিয়েছে। আগে বাড়িটির রঙ অন্যরকম থাকলেও আসন্ন দুর্গা পূজা উপলক্ষে নতুন করে লাল-সবুজে রাঙানো হয়েছে।
তবে ঐহিত্যবাহী ও দৃষ্টিনন্দন এ বাড়ি সম্পর্কে জানতে চেয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করেও গোপাল দাসকে পাওয়া যায়নি। তিনি গণমাধ্যমকে এড়িয়ে চলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
স্থানীয় মানুষ ও পর্যটকদের দাবি, সুসং রাজ্যের এ নিদর্শন উদ্ধার করে তা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হোক। এর মাধ্যমে নেত্রকোনার পর্যটন সমৃদ্ধ হয়ে ওঠার পাশাপাশি রক্ষিত হবে সুসং রাজ্যের স্মৃতিচিহ্ন ও ইতিহাস।
যাতায়াত ব্যবস্থা
দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে নেত্রকোনা বা দুর্গাপুর আসতে হবে। রাজধানী ঢাকা থেকে আসতে চাইলে ঢাকার মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে নেত্রকোনা ও দুর্গাপুরগামী বাসে সরাসরি দুর্গাপুর বা বিরিশিরি আসতে পারেন। ভাড়া লাগবে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা।
এছাড়া প্রথমে ময়মনসিংহ এসে সেখানে থেকেও বাসে করে আসা যায় দুর্গাপুর। দুর্গাপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে হাঁটা দূরত্বে ৫/৭ মিনিটের পথ দু’আনি বাড়ি।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৩৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৬, ২০১৫
এসআর