ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

রাঙ্গামাটির রাইক্ষং ঝরনার ডাকে-১

মো. জাভেদ-বিন-এ-হাকিম, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৪৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ১, ২০১৫
রাঙ্গামাটির রাইক্ষং ঝরনার ডাকে-১ ছবি : সংগৃহীত

ঢাকা: পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখার সব চাইতে মোক্ষম সময় হলো সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর- এই চার মাস। আর সেই পাহাড় যদি হয় তিন পার্বত্য জেলায় তাহলে তো কথাই নেই।



পায়ের নিচে মেঘ-বৃষ্টি আর বিদ্যুৎ চমকানোর অসাধারণ সব দৃশ্য। যে পাহাড়ের ওপর দিয়ে হাঁটছি সেখানে প্রখর রোদ অথচ পাশের পাহাড়েই ঝরছে ঝুম বৃষ্টি। মেঘ, রোদ আর বৃষ্টির অপূর্ব মিতালি।

কখনও আচমকা মেঘমালা আপনার দেহ-মনে ছড়িয়ে দেবে এক অন্যরকম ভাল লাগার দ্যুতি! সেই অপার্থিব সৌন্দর্যের ঘোর কাটতে না কাটতেই আপনার পিছু নেবে নতুন কোনো দর্শনের রোমাঞ্চকর অনুভূতি।

এ সবকিছুরই শিহরণ পাওয়া যাবে যখন সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৫শ থেকে ২৫শ ফুট ওপরে দিয়ে বন-জঙ্গল আর সুমিষ্ট পানির ছড়া দিয়ে হেঁটে বেড়াবেন মনের আনন্দে। দুর্গম ও ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে বেড়ানোর সময় হাতের লাঠি অতিরিক্ত পা হিসেবে দারুণ কাজে আসে।

আমাদের অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় দে-ছুট ভ্রমণ সংঘের এবারের গন্তব্য ছিলো বান্দরবানের উঁচু পাহাড়, খরস্রোতা খাল আর আদিবাসী পাড়া পেরিয়ে রাঙ্গামাটি জেলার গহীনে সৌন্দর্যের আধার রাইক্ষং ঝরনার প্রান্তরে।

দলে ছিলাম ছয়জন। বগালেক থেকে ভোর ৭টায় আল্লাহর নাম নিয়ে জুতসই বাঁশের লাঠি সম্বল করে হাঁটা শুরু। ঢেউ খেলানো সারি সারি পাহাড় মাড়িয়ে শুধু এগিয়ে যাচ্ছি। কখনও দুই হাজার ফুট ওপরে, কখনও আবার দেড় হাজার ফুট নিচে- এভাবেই চলছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চড়াই-উৎরাই। কোথাও যে একটু নিশ্চিন্ত মনে জিরিয়ে নেবো, শিকারি জোকের কারণে সেই সুযোগটুকুও নেই।

বেশ কয়েক ঘণ্টা হাঁটার পর নাখজং পাড়ার দেখা পেলাম, আদিবাসী মুরংদের বসতি। বেশ কিছুক্ষণ বিশ্রামের পাশাপাশি সঙ্গে নেওয়া মুড়ি-চানাচুর মেখে বেশ মজা করে খাওয়া হলো। খাওয়া শেষে আবারও হাঁটা। আজকের গন্তব্য পুকুর পাড়া। তবে ছিপছিপে শরীরের দক্ষ গাইড শাহজাহানের ভবিষ্যৎবাণী, জাভেদ ভাই যেভাবে হাঁটছেন তাতে মনে হয় না আজকে পৌঁছাতে পারবো!

ওকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, বোকা ছেলে রাইক্ষং দেখতে যাচ্ছি। ঝরণা দেখার পরই তো অভিযান শেষ, কিন্তু তার আগেও যে রয়েছে আরও অনেক কিছু দেখার। তোমাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ না থাকার ফলে ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে পাহাড়ের সৌন্দর্য যথাযথভাবে তুলে ধরতে পারো না। শুধু চোখবাধা গরুর মতো হাঁটিয়ে নিয়ে যাও। পাহাড়ে হাঁটতে হয় গুটি গুটি পায়ে, চারপাশে তাকিয়ে, কখনও নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে থমকে যেতে হবে, তবেই না পাওয়া যাবে পাহাড়ে ঘোরার চমকানো সৌন্দর্যের আনন্দ।

আমার কথা শুনে গাইড সম্মতিসূচক মাথা নাড়লো। অবাক বিস্ময়ের চাহনিতে মনের আনন্দে হেলেদুলে হাঁটছি আর ক্যামেরার শাটার টিপছি। প্রকৃতির রূপে এতোটাই আছন্ন হয়ে পড়ি, এর মধ্যে কখন যে পাহাড়ি মহিষা আর টাইগার জোঁক দেহ আলিঙ্গন করেছে টেরই পাইনি! যা হবার তাই, কাপড় ভিজে লাল।

দুপুর ২টা বিশ মিনিটে রুমা খালের দেখা পাই। খালের পানিতে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট ছোট-বড় অসংখ্য পাথরের চাঁই। স্বচ্ছ শীতল পানি চোখে-মুখে দিয়ে চিড়া-গুড় দিয়ে সেরে নেই দুপুরের আহার।

এবার পাথর আর পানি ডিঙিয়ে গন্তব্যের দিকে ছুটে চলা। এনোং পাড়া আসতেই প্রায় সন্ধ্যা, ডানে তাকিয়ে দেখি বিশাল বিশাল গাছ আর জঙ্গল ঘেরা উঁচু এক পাহাড়।

পুকুর পাড়া যেতে হলে এই পাহাড়টি ডিঙাতে হবে। এবার হয়তো ঢাকা থেকে বয়ে আনা রশির বস্তা কাজে আসবে। আমাদের রাত করে পাহাড়-জঙ্গলে হাঁটার দারুণ সব অভিজ্ঞতা রয়েছে কিন্তু গাইড কেন যেনো বেঁকে বসলো। তার জোরালো আবদার, রাতে এনোং পাড়াতেই থেকে যান। জানি না তার কোনো স্বার্থ ছিলো কিনা। তবে বিষয়টি নেতিবাচক হিসেবে না নিয়ে ইতিবাচক হিসেবেই ধরে নেই।

রুমা খালে সাফসুতরো হয়ে এনোং পাড়াতেই থেকে যাই। রাতের খাবারে অর্ডার দেওয়া হলো বাঁশ কোড়লের ভাজি, ডাল আর পাহাড়ি  মুরগির ভুনা, সঙ্গে ঢেঁকি ছাটা জুম চালের বৈঠা ভাত তো থাকছেই।

খাবার খেয়ে ঘুমাতে যাই কিন্তু ঘুম আসে না। বাইরে ভরা জোছনার আলো, খোলা জানালার ফাঁক গলে চোখে পড়ে। চারপাশের সুনসান নীরবতা ভেঙে কানে ভেসে আসে অবিরাম ধারায় বয়ে যাওয়া খালের পানির কলকল শব্দ। একরাশ হিমেল হাওয়ায় শরীর জুড়িয়ে যায়। প্রচণ্ড আকর্ষণ বোধ করি ঘরের বাইরে বের হয়ে পূর্ণিমা উপভোগ করার কিন্তু হায় ততক্ষণে সবাই বেঘোর ঘুমে। আমিও এক সময় ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যাই।

বাংলাদেশ সময় : ০৮৪৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ০১, ২০১৫
এসএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।