বান্দরবান থেকে ফিরে: ঘুটঘুটে অন্ধকার। ভৌতিক পরিবেশ।
গন্তব্য আলীর গুহা। গুহায় প্রবেশের পথে বাদ পড়াদের খোঁজ আর নেয়া হয়নি। কারণ গন্তব্যে যেতে হলে পেছনে তাকানোর সময় নেই। একা হলে সব ভয় এসে জয় করে নেবে। আর জানা হবে না আলীর গুহার ভেতরের গল্পটা।
সুড়ঙ্গে ততক্ষণে বেশ ঢুকে পড়েছি। পিচ্ছিল পথ, ছিপ ছিপ শব্দে গড়িয়ে পড়ছে পানি। দু’পাশে সুউচচ পাহাড় সারি, মধ্যভাগের সুড়ঙ্গ ধরে অর্ধকিলোমিটার পথটা হেঁটে যেতে হলো। মাঝে মাঝে পিচ্ছিল পথটা আরো পিচ্ছিল শুধু নয়, রীতিমত কোমরপানিতে গড়ালো।
পানির পরিমাণটা একটু ধারণা করেই এগুতে হচ্ছে এবার। মনে হচ্ছে দু’পাশের পাহাড় সারি এই চাপা দেবে। পাহাড়টা মাটির নয়, পাথরের। সেই পাথর গলিয়েও পানি পড়ছে টপাটপ।
যতটা ভেতরে যাচ্ছি ততটা ভয়ংকর দৃশ্যের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। বলা যায়, এই যাত্রা কিছুটা ভয়ের, কিছুটা বিস্ময়ের, কিছুটা আতঙ্কের। এমন অবস্থায় মনে হতেই পারে, যারা শুরুতে সুড়ঙ্গে না ঢুকে ফিরে গেছে তারা ভালোই করেছে। কিন্তু সামনে কেউ একজন সাহস বাড়িয়ে দিয়ে বলে, আর বেশি নয় মাত্র সামনেই…
তবে ভয় নিয়েই খেলা করেন এমন মানুষও আছেন এই দলে। এবার তার আওয়াজ.. নিচের পানি আর পাশের পাথরের ঝোপে সাপসহ বন্য প্রাণী থাকতে পারে…
তখন ভয়ে সেই সামনের স্বল্প জায়গাটাও অনেক দীর্ঘ মনে হচেছ..আর সামনে এগোনো যাচ্ছে না।
সুড়ঙ্গে প্রবেশের আগে ধারণা নিতে যখন স্থানীয় ক্ষুদ্র নৃতাত্বিক জনগোষ্ঠীর একজনের সঙ্গে কথা হচিছলো, তখন তিনি জানিয়েছিলেন সুড়ঙ্গের দৈর্ঘ্য ৭০০ মিটারের মতো হবে। এ পর্যন্ত অনেকেই ২০০ মিটার পর্যন্ত গিয়েছিলেন, বাকিটা যেতে পারেননি…
সেই ৭০০ মিটারের সুড়ঙ্গ আরও সামনে। এবার কোমর পানি থেকে হাঁটু পানিতে, আবার হাঁটা শুরু। হঠাৎ দূর থেকে দেখা গেলো লোহার সিঁড়ি। গিরিপথের শেষে তাহলে এটাই সুড়ঙ্গ… তা জানতে হলে একেবারে কাছে যাওয়া চাই…
তারপর যখন কাছে যাওয়া হলো তখন অনেক বড় একটি গর্তে পড়ে গেলেন একজন। লম্বা কেউ যখন হাঁটু পানি থেকে কোমরপানিতে তলিয়ে যায় তখন তার সঙ্গী কম উচ্চতার মানুষদের কি হবে…
তাহলে কি শুধু সিঁড়ি দেখেই শেষ করতে হবে সুড়ঙ্গ দেখার অ্যাডভেঞ্চার…
সুড়ঙ্গে প্রথম একজন ঢুকেই বের হয়ে এলেন। এতো দ্রুত বের হওয়া দেখে পেছনে সবার প্রশ্ন, কি ওখানে?
কিছুই নেই, শুধু একটি মোববাতি জ্বলছে। আর ভেতরটা স্যাঁতস্যাঁতে, সরু, এই সন্ধ্যায় ভেতরে ঢোকা ঠিক হবে না- এই টিমের প্রথম আরোহীর এমন বক্তব্যে আপাতত নিরাশ হতে হলো। এবার বাকিদের পালা…
বাকিরাও সুড়ঙ্গে মাথা ঢুকিয়ে দু’পাশে তাকিয়ে প্রথমজনের মত আর বেশি কিছু দেখলেন না। তবে যে ছোট আকারের সুড়ঙ্গ দেখা গেলো সেটা কতোটা ভেতরে এভাবে গেছে সে হিসেবটাও জানা যাচ্ছে না।
অ্যাডভেঞ্চারের তাহলে এখানেই সমাপ্তি! যেহেতু কেউই ২০০ মিটারের বেশি যায়নি, তাই আলীর গুহার বাকি ৫০০ মিটারের গল্পটা রহস্যঘেরা এখনও। তবে রিমোট কন্ট্রোল খেলনা গাড়ি এ জাতীয় কোন ডিভাইস দিয়ে ক্যামেরা প্রবেশ করে দেয়া গেলে হয়তো সেই অজানা ৫০০ মিটারের গল্পটা জেনে আসা যেত।
তবে দুর্গম পাহাড়ে আলীর সুড়ঙ্গটি কীভাবে তৈরি হলো? কে তৈরি করলেন? কেন করলেন—এই ইতিহাসের কোন তথ্য নেই। আছে সুড়ঙ্গ নিয়ে নানা কিংবদন্তি আর জনশ্রুতি। কেউ বলেন, আরকানি এক শাসক আলী খান এই গুহায় ধ্যান করতেন। কেউ বলেন, আলী নামের কোন আউলিয়া এখানে থাকতেন, আবার কেউ বলেন আলী নামে কেউ এখানে আত্মরক্ষার্থে আশ্রয় নিয়ে আর বের হননি।
সেগুলোর কোনটিই এ যুগের কারও কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা একটু কঠিন। তবু এখানে বিশ্বাসের তাড়নায় প্রতি সন্ধ্যায় দুর্গম প্রতিকূলতা মাড়িয়ে কেউ একজন এসে মোম জ্বালিয়ে দিয়ে যান। আলীর গুহায় ভেতরে এর চেয়ে বেশি কিছু চোখে পড়েনি।
পাহাড়, নদী, ঝরনা আর অরণ্য যাদের পছন্দ তারাই নিতে পারেন এই অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ। অজানা কোন গিরিপথের খালে হাঁটু পানি থেকে গলা পানিতে ডুবে গিয়ে ভেসে উঠবেন সাহস নিয়ে এমন কেউ ওখানে যেতে পারেন। তবে শিশুদের সেখানে নেয়া যাবে না।
যেভাবে যাবেন
চট্টগ্রাম অথবা কক্সবাজার থেকে সড়কপথে আলীকদম। তারপর সেনাজোন থেকে নৌকায় আলীর সুড়ঙ্গে। সকালে গিয়ে বিকেলে ফিরে আসা যায়। সুড়ঙ্গে ঢুকতে হলে স্থানীয় আদিবাসীদের গাইড হিসেবে নিতে হবে।
এছাড়া আলীকদম সড়ক থেকে গাড়ি নিয়েও যাওয়া যায়। আলীকদম সড়ক থেকে ভেতরে ৩ কিলোমিটার গাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবে। এরপর আদিবাসী একটি গ্রামেই গাড়ি রেখে হেঁটে আরও এক কিলোমিটার গেলেই খাল। সেই খালের পরেই এই অ্যাডভেঞ্চার।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৫৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ৬, ২০১৫
এসএ/জেডএম