ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

বেড়িয়ে যান সুন্দরবনের রাসমেলায়

মাহবুবুর রহমান মুন্না, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭২৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৮, ২০১৫
বেড়িয়ে যান সুন্দরবনের রাসমেলায় ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

খুলনা: বঙ্গোপসাগরের কোলে ছোট্ট একটি দ্বীপ দুবলার চর। কুঙ্গা ও মরা পশুর নদীর মোহনায় জেগে ওঠা এ দ্বীপেই বসে সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় উৎসব রাসমেলা।

প্রতি বছর কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে পালিত হয় এ মেলা।

এ বছরও তিনদিনের রাসমেলায় হাজার হাজার হিন্দু পুণ্যার্থী আর পর্যটকের পদচারণায় মুখরিত হবে দুবলার চর।

আগামী ২৪ থেকে ২৬ নভেম্বর চন্দ্রিমার আলোতে শোভিত নীরব চরাঞ্চল সরব হয়ে উঠবে পুণ্যার্থীদের প্রার্থনায়। বাঙালি হিন্দুদের অন্যতম প্রধান পার্বণ এ রাস উৎসব সাড়া ফেলে দুবলার চরসহ সারা দেশে। সাগর-প্রকৃতির অপূর্ব সৌন্দর্যের মাঝে পুণ্য অর্জন ও আনন্দ যজ্ঞ যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।

এ আয়োজনকে সামনে রেখে আগে থেকেই যাত্রার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন দেশি-বিদেশি তীর্থযাত্রী ও দর্শণার্থীরা। এ মেলায় সময় করে বেড়িয়ে আসতে পারেন আপনিও। সমুদ্র কোলে পাঁচ মাইল প্রশস্ত বালুকাবেলায় পদব্রজে ভ্রমণ করে ক্যামেরায় বন্দি করতে পারেন আশ্চর্য সুন্দর সব চিত্র।
 
রাসমেলার ইতিহাস
দুবলার চরের রাসমেলার প্রাচীন ইতিহাস নিয়ে নানা মত প্রচলিত আছে। জানা গেছে, ঠাকুর হরিচাঁদের অনুসারী হরি ভজন নামে এক হিন্দু সাধু এ মেলার শুরু করেছিলেন ১৯২৩ সালে। এই সাধু চব্বিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে সুন্দরবনে গাছের ফল-মূল খেয়ে জীবন ধারণ করেছেন।

আবার কারো কারো মতে, শারদীয় দুর্গোৎসবের পর পূর্ণিমার রাতে বৃন্দাবনবাসী গোপীদের সঙ্গে রাসনৃত্যে মেতেছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অবতার শ্রীকৃষ্ণ। এটিকে স্মরণ করেই দুবলায় পালিত হয়ে আসছে রাস উৎসব। অনেকে এটাও মনে করেন, শ্রীকৃষ্ণ কোনো এক পূর্ণিমা তিথিতে পাপমোচন ও পুণ্যলাভে গঙ্গাস্নানের স্বপ্নাদেশ পান। তার স্বপ্নাদেশকে সম্মান জানাতে বসে রাসমেলা।

কী হয় রাস মেলায়
দুবলার রাসমেলায় দেশের বিভিন্ন জায়গা ছাড়াও বিদেশ থেকে প্রচুর পুণ্যার্থী ও পর্যটকের সমাগম ঘটে। প্রায় অর্ধলক্ষ মানুষ প্রতি বছর এ উৎসবে যোগ দেন।

রাসমেলায় প্রদীপ জ্বালিয়ে প্রার্থনায় বসেন পুণ্যার্থীরা। তারা সাগরকে সামনে নিয়ে নির্জনে কৃষ্ণপূজার সঙ্গে দেবতা নীলকমল আর গঙ্গাদেবীর আরাধনায় মগ্ন হন। পাপমোচন করেন সমুদ্রস্নানে। সূর্যোদয়ে পানিতে ভাসিয়ে দেন ফল-ফুল। এরপর ঢাক-ঢোলক-কাসা-মন্দিরা বাজিয়ে ভজন-কীর্তন নিনাদিত করেন চারপাশ। পূজা-অর্চনার ফাঁকে সূর্যাস্তের পর সাগরকে সাক্ষী রেখে আকাশের বুকে উড়িয়ে দেওয়া হয় ফানুস।

সন্তানহীন ধর্মনুরাগী হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা দুবলার মেলায় মানত করেন এবং মেলায় এসে মানতকারীরা আনুষঙ্গিক অনুষ্ঠানাদি সম্পন্ন করে থাকেন। মেলায় বাদ্য, নৃত্য, গীত ও বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে। কুটির শিল্পের দোকান ছাড়াও পসার সাজিয়ে বসে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য, ফল-ফলাদি, মিস্টান্ন, মনোহারী সামগ্রীর দোকান।

এ মেলায় বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা ছাড়াও আসেন ভারত, আমেরিকা, মিয়ানমারসহ আশপাশ বিভিন্ন দেশের পর্যটক।

যেভাবে যাবেন রাসমেলায়
ঢাকার মতিঝিল, আরামবাগ, শ্যামলী, কল্যাণপুর, গাবতলী থেকে গ্রিনলাইন, সোহাগ, হানিফ, ঈগল, এ কে ট্রাভেলসসহ বিভিন্ন এসি/ননএসি বাস খুলনার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত। খুলনা নেমে লোকাল বাসে মংলা যাওয়া যাবে।

এছাড়া সায়েদাবাদ থেকে সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত সুন্দরবন, পর্যটক, বনফুলসহ বিভিন্ন বাস খুলনা, বাগেরহাট ও মংলার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়।

খুলনায় ট্রেনে এবং যশোর পর্যন্ত বিমানেও আসা যাবে। পাশাপাশি নৌ-পথেও আসা যায়। তবে রাসমেলায় যাওয়ার সবচেয়ে ভালো মাধ্যম হলো খুলনার বিআইডব্লিউটিএ’র লঞ্চঘাট থেকে। কেননা, এ লঞ্চঘাট থেকে বিভিন্ন ভ্রমণ সংস্থা রাসমেলা উপলক্ষে বিশেষ আয়োজন করে থাকে।

বন বিভাগের ৮টি রুট
রাস পূর্ণিমায় নিরাপদে যাতায়াতের জন্য তীর্থযাত্রীদের সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগ আটটি পথ নির্ধারণ করেছে। এ সকল পথে বন বিভাগ, পুলিশ, বিএসএফ ও কোস্টগার্ড বাহিনী তীর্থযাত্রী ও দর্শণার্থীদের জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবে।

আটটি রুট হলো বুড়িগোয়ালিনী, কোবাদক থেকে বাটুলানদী-বলনদী-পাটকোষ্টা হয়ে হংসরাজ নদী হয়ে দুবলারচর। কদমতলী থেকে ইছামতি নদী, দোবেকী হয়ে আড়পাঙ্গাসিয়া-কাগাদোবেকী হয়ে দুবলার চর। কৈখালী স্টেশন হয়ে মাদারগাং, খোপড়াখালী ভাড়ানী, দোবেকী হয়ে আড়পাঙ্গাসিয়া-কাড়াদোবেকী হয়ে দুবলার চর। কয়রা, কাশিয়াবাদ, খাসিটানা, বজবজা হয়ে আড়ুয়া শিবসা-শিবসা নদী-মরজাত হয়ে দুবলার চর। নলিয়ান স্টেশন হয়ে শিবসা-মরজাত নদী হয়ে দুবলার চর। ঢাংমারী চাঁদপাই স্টেশন হয়ে পশুর নদী দিয়ে দুবলারচর, বগী-বলেশ্বর-সুপতি স্টেশন-কচিখালী-শেলার চর হয়ে দুবলার চর। শরণখোলা স্টেশন-সুপতি স্টেশন-কচিখালী- শেলার চর হয়ে দুবলার চর।

যেখানে থাকবেন ও খাবেন
খুলনায় থাকা-খাওয়ার জন্য হোটেল সিটি ইন (০৪১-২৮৩৪০৬৭), হোটেল রয়্যাল (০৪১-৭৩০৭১৪), হোটেল ক্যাসল সালাম (০৪১-৭৩০৩৪১), হোটেল অ্যাম্বাসেডর (০৪১-৭২২৩৭০), হোটেল টাইগার গার্ডেনসহ (০৪১-৭২২২৪৬), বেশ কয়েকটি ভালো মানের হোটেল রয়েছে।

বাগেরহাটে থাকতে চাইলে বাগেরহাট সদরে আছে বেশকিছু হোটেল। মংলায় আছে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের মোটেল পশুর (০১৭৭৩-০৪৪৪৭০) এছাড়া আমিন ইন্টারন্যাশনাল লি. (০১৭২৫-৮১৯৪৫৩)।

ভ্রমণে যাদের সাহায্য নিতে পারেন
ভ্রমণ পরিকল্পনা অনুযায়ী সুন্দরবন ঘুরিয়ে দেখাতে রয়েছে বিভিন্ন বেসরকারি ভ্রমণ সংস্থা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- দি ম্যানগ্রোফ ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস (৮৮-০১৯১৭৭২১২৩৬, ৮৮-০১৭১৬২৭৯৪০৪), সাওদার্ন ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস (০১৭১২-৭৭৩৩৬১),এক্সপ্লোর ট্যুরিজম কর্পোরেশন লি.(০১৭১১-১৭৬৫৯৩), দি গাইড ট্যুরস লি.(০১৭১১-৫৪০৪৩১), ভিশন ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস লি. (০১৭১১-০০০০৩৮), দি বেঙ্গল ট্যুরস লি, ইকো ট্রাভেলার্স (০১৭১ ৪৪ ৪৪ ৩৩০)।

ভ্রমণের খরচ
স্থান ও যাতায়াতের বাহন ভেদে খরচেরও ভিন্নতা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে খুলনার দি ম্যানগ্রোভ ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রেজাউল করীম রেজা বাংলানিউজকে বলেন, প্রতি বছরের মতো এবারো সুন্দরবনে রাসমেলা দেখার ভ্রমণ প্যাকেজ আয়োজন করেছে দি ম্যানগ্রোভ ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেল। ২৪ নভেম্বর সকালে খুলনার বিআইডব্লিউটিএ এর লঞ্চ ঘাট থেকে শুরু হবে এ ভ্রমণ। ২৬ নভেম্বর পূণ্যস্নান বা গঙ্গাস্নান শেষে রাসমেলা থেকে খুলনার উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়া হবে। ভ্রমণ খরচ জনপ্রতি স্ট্যান্ডার্ড প্যাকেজ ৬-৮ হাজার টাকা। আর প্রবাসীদের জন্য ১৩-১৫ হাজার টাকা।

খুলনা থেকে লঞ্চে সুন্দরবন যাতায়াতে সবার জন্য থাকছে এসি/ননএসি কেবিন ব্যবস্থা এবং একই মানের খাবার।

দুবলার চরে রাসমেলা দেখা ছাড়াও এ প্যাকেজে থাকছে হিরণপয়েন্ট, আলোরকোল, কটকা, জামতলা, টাইগারপয়েন্ট ও কচিখালী ভ্রমণের সুযোগ। এছাড়া থাকবে বনের ভেতর ট্র্যাকিং, বিচভলিবল, ফানুস ওড়ানো ও সাংস্কৃতিক আয়োজন।

এছাড়া সুন্দরবনে রাসমেলা দেখার ভ্রমণ প্যাকেজ আয়োজন করেছে ইকো ট্রাভেলার্স। ২৪ নভেম্বর রাতে ঢাকা থেকে বাসে শুরু হবে এ ভ্রমণ। শেষ হবে ২৮ নভেম্বর সকালে ঢাকায় এসে। ভ্রমণ খরচ জনপ্রতি স্ট্যান্ডার্ড প্যাকেজ ১০ হাজার টাকা ও লাক্সারি প্যাকেজ ১২ হাজার টাকা। খুলনা থেকে লঞ্চে সুন্দরবন যাতায়াতে সবার জন্য থাকছে কেবিন ব্যবস্থা এবং একই মানের খাবার।

প্রবেশাধিকার সংক্রান্ত তথ্য
সুন্দরবনে প্রবেশাধিকার অবারিত নয়। সংরক্ষিত বনাঞ্চল বলে বন বিভাগের অনুমতি গ্রহণ বাধ্যতামূলক। বিনা অনুমতিতে সুন্দরবনে ঢোকা ম্যানগ্রোভ আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সুন্দরবনে ভ্রমণ করতে হলে ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসার বাগেরহাট বা ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসার খুলনা বরাবরে দরখাস্ত করে অনুমতি নিতে হয় এবং প্রয়োজনীয় ফি প্রদান করতে হয়।

প্রয়োজনীয় ফোন নম্বর
সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (০৪১-৭২০৬৬৫), সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (০৪৬৮-৬৩১৯৭), মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ-৭৬১৮৩০, ৭৬১০৫৬, বিমান বুকিং অফিস খুলনা (০৪১-৭৩১০২০), খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ (০৪১ ৭২০৪৪৪) সদর হাসপাতাল (০৪১-৭২৩৪৩৩)।

সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা জহির উদ্দিন আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, এবারের রাসমেলায় হরিণ নিধন বন্ধে ও তীর্থ ভ্রমণ যাত্রীদের নিরাপত্তায় বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কোস্টগার্ড, পুলিশ ও বন বিভাগ যৌথভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যে ৮টি রুট দিয়ে ভ্রমণকারীরা যাতায়াত করবেন সেসব রুটে পাহারা জোরদার করা হবে।

তিনি আরও জানান, দর্শণার্থী ও তীর্থযাত্রীরা ২৪ থেকে ২৬ নভেম্বর তিনদিনের জন্য অনুমতি পাবেন এবং প্রবেশের সময় এন্ট্রি পথে নির্দিষ্ট ফি প্রদান করতে হবে। পরিবেশ দূষণ করে এমন বস্তু, মাইক বাজানো, পটকা ফোটানো, বিস্ফোরক দ্রব্য ও আগ্নেয়াস্ত্র বহন থেকে যাত্রীদের বিরত থাকতে হবে বলেও জানান তিনি।

রাসমেলা উদযাপন কমিটির চেয়ারম্যান মেজর (অব.) জিয়াউদ্দিন বাংলানিউজকে জানান, প্রতি বছরের মতো এবারও তিনদিনের রাসমেলায় জমকালো ও বর্ণাঢ্য আয়োজন করা হয়েছে। তীর্থযাত্রী ও ভ্রমণকারীরা যাতে নৌকা-লঞ্চ-ট্রলারে রান্না ও আহার এবং বালুচরে নিরাপদে ঘুরে বেড়াতে পারেন সেজন্য আয়োজক কমিটি সার্বিক সহযোগিতার ব্যবস্থা করবে।

জিয়াউদ্দিন আরো জানান, ইতোমধ্যে আয়োজক কমিটি মেলা উদযাপনের প্রস্তুতিমূলক কাজ শুরু করেছে।

বাংলাদেশ সময়: ০৭২৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৮, ২০১৫
এমআরএম/আরএম/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।