বান্দরবান থেকে ফিরে: এখন আমাদের হাঁটতে হচ্ছে একেবারে পাথুরে পিচ্ছিল পথে। যে কোনো সময় পা হড়কানোর ভয়।
তৌহিদ পাথরের দেয়াল ধরে কোনো রকমে পার হয়ে গেলো। এখন আমার উপায় কি? হাতের বাঁশ এখানে অকেজো। পার হতে হলে এভাবেই পার হতে হবে। কি আর করা। মৃত্যুকে এক হাতের মুঠোয় রেখে আরেক হাতের সাহায্যে পার হলাম।
এরপর সাত ভাই পাথর এলাকা। বিশাল বিশাল সব পাথর রেমাক্রির গতিরোধ করার পাঁয়তারা করছে। এর মাঝে দিয়েই সে নিজের রাস্তা ঠিকই বের করে নিয়েছে। সাতটা বিশাল পাথর জড়াজড়ি করে আছে সহোদরের মতো যুগ যুগান্তর ধরে। তাই এ এলাকার নাম সাত ভাই পাথর।
এখানেও পিচ্ছিল পাথুরে পথ। কয়েক জায়গায় আছাড় খেতে গিয়েও খেলাম না। এখানে বেশ বড় কয়েকটি পাথর রীতিমতো টপকাতে হলো। এভাবে কখন নাইক্ষ্যং মুখে এসে পড়েছি টের পাইনি। সামনে আমিয়াখুম, কিন্তু সেখানে যেতে হলে সাহায্য লাগবে ভেলার। পেরুতে হবে সাতভাই খুম। সে এখানে অপেক্ষা করতে বলে দা আর লাইফ জ্যাকেট নিয়ে উধাও হয়ে গেলো।
একা একা বসে দেখছি নাইক্ষ্যংয়ের রূপ। পানির তোড়ে পুরো এলাকায় যেন যুদ্ধের দামামা বাজছে। উপরে দেখা যাচ্ছে দোতং পাহাড়ের কিছু অংশ। নাইক্ষ্যং হচ্ছে দোতং আর রেমাক্রির মিলনস্থল। এই দুই বেসিনের পানি এসে পড়েছে সাতভাই খুমে। তার থেকে একটু এগিয়ে গেলেই আমিয়া খুম।
সময় আর কাটে না। তৌহিদ সেই যে গেলো আর আসার খবর নেই। একা একা গা ছমছম করতে লাগলো। গোটা এলাকায় আমি ছাড়া আর কেউ নেই। তৌহিদ ভেলা বানাতে কই গিয়েছে কে জানে। এখানে কেবল আমি আর নাইক্ষ্যংয়ের ভয়ংকর সুন্দর। প্রায় দুই ঘণ্টা পার হওয়ার পর অধৈর্য হয়ে যখন একটু এগিয়ে গেছি অনেক দূরে দেখা গেলো সাতভাই খুমের উল্টো স্রোত উপেক্ষা করে কেউ যেন এগিয়ে আসছে।
শুধু লাইফ জ্যাকেটের লাল রং বোঝা যাচ্ছে। অনেক্ষণ পর তৌহিদ খারাপ খবর নিয়ে এলো। সে ভেলা বানাতে পেরেছে ঠিকই কিন্তু তা নিয়ে এ অবধি নিয়ে আসা সম্ভব না। খুমে স্রোতের ব্যাপক তাণ্ডব। মাথায় বাজ পড়লো। এখন সামনে এগোবো কি করে? একে তো এই ভয়ংকর স্রোতে সাঁতার দেওয়ার কথা চিন্তা করেই ভয় করছে তার উপর তো সাঁতারই জানি না।
লাইফ জ্যাকেট আছে কিন্তু তার ভরসা কতটুকু। এছাড়া আরও বিপদ আছে। সাথের ব্যাগপ্যাকের কি হবে। ক্যামেরা, মোবাইলসহ অনেক জিনিস ভেতরে। ভিজে গেলে কিছুই আর ফেরত পাওয়া যাবে না। ফিরতি পথ ধরার চিন্তাও উঁকি দিয়ে গেলো। তৌহিদ অভয় দিলো। বললো লাইফ জ্যাকেট পরে নিতে। রুমা বাজার থেকে দু’টি বড় পলিথিন কেনা হয়েছিলো। সিদ্ধান্ত হলো পলিথিনে ব্যাগপ্যাক মোড়ানোর পর তা কাঁধে নিয়ে প্রথমে ঝাঁপ দেবে সে। আর আমি তার পেছন পেছন।
সত্যিই তখন মৃত্যু চিন্তা ভালো ভাবেই ভয় দেখাচ্ছিলো। কিন্তু আমরা নিরুপায়, সামনে এগিয়ে যেতে হলে স্রেফ ঝাঁপ দিতে হবে রেমাক্রিতে। আর ফেরারও উপায় শেষ হয়ে আসছে। আর ঘণ্টাখানেক পর আলো অনেক কমে যাবে। যে পথ পেরিয়ে এসেছি সে পথে তখন আর ফেরা সম্ভব না। নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলাম।
** মেঘেঢাকা অপার্থিব সৌন্দর্যের নেফিউ
** দেশের সর্বোচ্চ চূড়ায় শ্রেষ্ঠ ঈদ উদযাপন
** জোঁকে রক্তাক্ত হয়ে আমার দেখা সুন্দরতম পাড়ায়
** বর্ণনাতীত কষ্ট, তবু স্বপ্ন ছোঁয়ার আশায় পাড়ি
** বাংলাদেশের সর্বোচ্চ চূড়ায়-১: পাহাড়জয়ের স্বপ্নপথে যাত্রী আমি একা
** বাংলাদেশের সর্বোচ্চ চূড়ায়-২: মেঘ চেপে ধরলো চারপাশ থেকে, পথ দেখা দায়
বাংলাদেশ সময়: ০০০৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৯, ২০১৫
এএ