বান্দরবান থেকে ফিরে: তৌহিদের সঙ্গে এসে দাঁড়ালাম নাইক্ষ্যংয়ের একেবারে মুখে। কিন্তু নীচের অবস্থা দেখে বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো।
কি অদ্ভুত কাণ্ড! পানিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভয় কেটে গেলো। আরে আমি ভেসে আছি ভালোভাবেই। হাত পাও ছুড়তে হচ্ছে না। স্রোতের টানে একাই ভেসে যাচ্ছি। মাথার উপর আকাশ দেখা যাচ্ছে না। সাত ভাই খুমের দুই পাশের দুই বিশাল পাহাড় ঢেকে দিয়েছে চরাচর। দূরে দোতংয়ের গ্রানাইড শরীরে সূর্যের আভা চিকচিক করছে। আহা জীবন কত সুন্দর!
দেখলাম জলে ঝাঁপ দেওয়ার আগে গত কয়েক দিনের সঙ্গী যে লাঠিটিকে ফেলে দিয়েছিলাম সেও আমার সঙ্গে ভেসে চলেছে। তাকেও মনে হলো বড় আপনজন। আর তৌহিদও ভাসতে থাকা এক মোটা বাঁশ জোগাড় করে নিয়েছে। তা চড়ে সে দিব্যি ভেসে চলেছে। অনেক দূর যাওয়ার পর বানানো সেই ভেলাটি দেখা গেলো। এবার কোনো চিন্তা নেই। ভেলাতে পলিথিনে মোড়ানো ব্যাগপ্যাকগুলো তুলে দিয়ে এগোতে লাগলাম।
অবশেষে পাড়ে পৌঁছাতে পারলাম। আমিয়া খুমের গর্জন শোনা যাচ্ছিলো। কিন্তু বড় বড় পাথর বাধা হয়ে দাঁড়ানোয় আরও কিছুটা অপেক্ষা করতে হবে সুন্দরীতমাকে দর্শনের জন্য। ব্যাগ খুলে দেখা গেল কিছুই ভেজেনি। হাফ ছাড়লাম। পলিথিন বেশ কাজে দিয়েছে। তা কাঁধে নিয়ে পাথরগুলো পেরিয়ে আসতেই দেখা পেলাম আমিয়াখুমের।
প্রকৃতির অসামান্যতা বুঝতে হলে এক আমিয়াখুমই উদাহরণ হিসেবে যথেষ্ট। কবিতার চেয়েও সুন্দর সে। কবি আমিয়াখুমের সৌন্দর্যের বর্ণনা দিতে দিতেই মহাকাব্য লিখে ফেলতে পারেন। একবারে ভরা যৌবন যাকে বলে।
চারপাশের নিস্তব্ধতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে কুটি কুটি করছে এর গর্জন। পেছনে দোতং পাহাড়ে শেষ বিকেলের রোদের ছটা এসে লেগেছে। সামনে আমরা দুজন থ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। ছবি তোলার কথা ভুলে গিয়েছিলাম। আমাদের হাতে বেশি সময় নেই। আর আমিয়াখুমের বর্ণনা দেওয়ারও বোধহয় কিছুই নেই। একটা ছবিই নাকি হাজার শব্দের গল্প বলে।
দুপুরে কিছু খাইনি। ব্যাগে থাকা শেষ চানাচুরের প্যাকেট থেকে কিছুটা খেয়ে আমাদের উঠতে হলো। আজকের গন্তব্য থুইসা পাড়া। কিন্তু ভয় ধরালো আমিয়াখুমের পরের পাহাড়ি ট্রেইল। রাস্তা বলতে কিছুই নেই। একেবারে ৭০, ৮০ ডিগ্রি খাঁড়া। গয়ালের চলাফেরায় মাটি ঝুরঝুরে হয়ে গিয়েছে। তার উপর জোঁকের উপদ্রপ। সেই পথটুকু পেরিয়ে পাহাড়ের মাথায় উঠে এলাম। এবার নেমে ঝোঁপঝাড় কেটে এগোতে হলো।
সামনেই অতিরাম পাড়া। সেখানে যেতে হলেও বিশাল এক খাঁড়া পাহাড় পার হতে হবে। তৌহিদ বললো এটি পার হতে পারলেই নিশ্চিন্ত। শেষমেষ অতিরাম পাড়ায় পৌঁছাতে পারলাম। কিন্তু ততক্ষণে কাটা ঝোপের কবলে পড়ে শরীরের বিভিন্ন জায়গা কেটে গিয়েছে। কয়েকবার পা পিছলে ট্রেইল থেকেও ছিঁটকে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। অতিরাম পাড়ায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আবার থুইসা পাড়ার পথে পা বাড়ালাম। এবার পথ অনেকটা সহজ অন্তত সারাদিনের ফেলে আসা পথের তুলনায়।
আজ বেশ কয়েক জায়গায় মনে হয়েছে আর পারবো না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে পথ যেন আরেকটু বড় হয়। আগামীকাল পূর্ণিমা। আজ চাঁদটা তার একটা পরীক্ষমূলক মঞ্চায়ন সেরে নিচ্ছে। অনেক দূরে দেখা গেলো থুইসা পাড়ার আলো। আরেকটা দিন আমাদের শেষ হচ্ছে। সম্ভবত ট্রেকের সবচেয়ে ঘটনাবহুল দিন। থুইসা পাড়ায় কি হলো জানতে একটু অপেক্ষা করতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ০০০৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ২০, ২০১৫
এএ
** লাইফ জ্যাকেট পরে ঝাঁপ দিলাম ভয়ংকর রেমাক্রির বুকে
** মেঘেঢাকা অপার্থিব সৌন্দর্যের নেফিউ
** দেশের সর্বোচ্চ চূড়ায় শ্রেষ্ঠ ঈদ উদযাপন
** জোঁকে রক্তাক্ত হয়ে আমার দেখা সুন্দরতম পাড়ায়
** বর্ণনাতীত কষ্ট, তবু স্বপ্ন ছোঁয়ার আশায় পাড়ি
** বাংলাদেশের সর্বোচ্চ চূড়ায়-১: পাহাড়জয়ের স্বপ্নপথে যাত্রী আমি একা
** বাংলাদেশের সর্বোচ্চ চূড়ায়-২: মেঘ চেপে ধরলো চারপাশ থেকে, পথ দেখা দায়