ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

ভারত ভ্রমণপঞ্জি-৬

দিল্লির পথে পথে

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮২৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৩, ২০১৫
দিল্লির পথে পথে ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

খুশবন্ত শিং তার ‘দিল্লি’ উপন্যাসে বলেছেন, সাধারণ আগন্তুকের কাছে দিল্লিকে মনে হতে পারে পচা ঘায়ের মতো কোনো শহর। একটি মরা নদীর কোল ঘেঁষে বেড়ে ওঠা একটি শহর।

যার চারদিকে শোরগোল, জরাজীর্ণ বস্তি ও মুখ থুবড়ে পড়া কিছু দূর্গ ও মসজিদ। তাই যদি কোনো ভিন্নতা পেতে চাই তবে দিল্লিকে নিজের করে নেওয়ার মননের চর্চা করতে হবে।

কিন্তু দিল্লিতো আমার শহর নয়। আমার শহর ঢাকা। দিল্লির মতো এখানেও রয়েছে মরা নদী। রয়েছে শোরগোল, জরাজীর্ণ বস্তি, মসজিদ, মন্দির ও দূর্গ।

তাই হয়তো দিল্লিকে নিজেরই শহর মনে হয় বারবার। একই ইতিহাস-ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার বহন করে বেড়ে উঠছে দু’টি শহর- দিল্লি আর ঢাকা। সুলতানি আমল, মুঘল আমল তারপর ব্রিটিশ আধিপত্য। একই সঙ্গে স্বাধীনতা ও বেড়ে ওঠা। পরে যদিও দুই যুগ পাকিস্তানি শাসনে ছিলো ঢাকা। তাই দিল্লির পথে পথে হাটলে বারবারই হোঁচট খাবেন ইতিহাসের একেকটি অধ্যায়ের সঙ্গে। একই জন্ম-ইতিহাস বলেই বুঝি এই নাড়ির টান।

সময় পরিবর্তনশীল। শহরও তাই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে ওঠা শহরেই মানুষ জীবন খুঁজে পায়। তাই বুঝি গালিব বয়ান করেছেন, ‘আমি আমার আত্মাকে জিজ্ঞাসা করলাম, দিল্লি কী?
সে জবাব দিলো, সমস্ত দুনিয়া হচ্ছে শরীর আর দিল্লি হচ্ছে এর প্রাণ’। তাই দিল্লি প্রাণের শহর। শুধু দিল্লিওয়ালাদের জন্য নয়, দিলওয়ালাদের জন্যও।

দিল্লির পথে পথে ঘুরে আপনি সুলতানি, মুঘল ও ব্রিটিশ জমানার দিল্লিকে খুঁজে পাবেন না। খুঁজে পাবেন পুরনোর ভেতর থেকে বেড়ে ওঠা আধুনিক এক দিল্লিকে, যে দিল্লির হৃদয়ে অতীত আর দৃষ্টিতে আগামী। যে আগামীর শুরু ইন্ডিয়া গেট থেকে আর শেষও ইন্ডিয়া গেটে। তাই আগামী ও অতীত প্রজন্ম বারবার এখানে এসে মিলিত হয়।

ইন্ডিয়া গেট ভারতের জাতীয় সৌধ, ১৯৩১ সালে এটি নির্মিত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জীবন দানকারী বীর সৈনিকের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্যই ইন্ডিয়া গেটের নির্মাণ। লাল ও সাদা বেলেপাথর ও গ্রানাইট পাথর দিয়ে তৈরি করা হয় এ সৌধটি। এর উচ্চতা ৪২ মিটার।

সব বয়সের দিল্লিবাসীর প্রাণকেন্দ্র ইন্ডিয়া গেট। শেষবার দিল্লি গিয়েছিলাম এপ্রিলে। এপ্রিল-মে দিল্লির জন্য একেবারেই উপযুক্ত নয়। তাই এবার সেপ্টেম্বর। কিন্তু তাও দাবদাহ খুব একটা কম নয়। মনে হলো, আরেকটু ঠাণ্ডা হলে ভালো হতো।

অটোওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম শীত কবে থেকে শুরু? বললেন, শীত তো চলছে...।
আমি অটোতে তখন ঘামছি! বুঝলাম, সারা বছর প্রচণ্ড গরমে সেপ্টেম্বরের একটু শীতলতাতেই তারা শীতের আমেজ অনুভব করে।

তবে, দিল্লি বা আগ্রা বেড়ানোর জন্য উপযুক্ত সময় অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর। নভেম্বর-ডিসেম্বর এখানে পিক টাইম। তাই একটু কম খরচ ও আরামের সঙ্গে ঘোরাঘুরি এবং হোটেলে থাকার জন্য সেপ্টেম্বর-অক্টোবরই ভালো। যদিও দিল্লি এমনকি ভারতের সব প্রদেশ ও ইউনিয়ন স্টেটে সারা বছরই পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকে। তবে, সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে তা সহনীয়।

বাইরে প্রচণ্ড গরম, গা পুড়ে যাওয়ার অবস্থা। তার উপর এমন আলো যে চোখ মেলে তাকানোই দায়। কিন্তু তারপরও শরীর তেমন ঘামে না। তাই অনেক হাঁটাহাটির পরও তেমন দুর্বলতা গ্রাস করে না। রোদ থেকে একটু ছায়ায় দাঁড়ালেই ক্লান্তি দূর হবে। সঙ্গে এক বোতল পানিই যথেষ্ট।

হয়তো এ বাস্তবতার জন্যই দিল্লির পথে পথে একটু পরপরই আমার চোখে পড়লো একেবারে তাজা ফলের জুসের দোকান। যেখানে রয়েছে সব মৌসুমি ফলের সম্ভার। প্রায় প্রতিটি বাসস্টপ ও জনারণ্যেই রয়েছে এমন ফলের জুসের দোকান। লেবুর শরবত তো রয়েছেই। লবণ দিয়ে লেবুর শরবত যেনো দিল্লিকে এ প্রচণ্ড দাপদাহের মধ্যে সচল রাখে। আবহাওয়া ও বাস্তবতার সঙ্গে মানানসই খাদ্যাভ্যাসই যেনো এর প্রমাণ।

সবুজ-শ্যামল বাংলা নিয়ে আমাদের গর্বের সীমা নেই। সেই সবুজ-শ্যামল বাংলাদেশের রাজধানী যে ঢাকা, দেখে তা মনে হবে না। কারণ, ঢাকা বড় হয়েছে, উঁচু হয়েছে, পরিচ্ছন্ন হয়েছে। কিন্তু সবুজ হয়নি। হয়েছে ধূসর।

কিন্তু দিল্লি বড় ও আধুনিক হচ্ছে সবুজকে ধারণ করে। একই চিত্র কলকাতায়ও। আধুনিক শহর মানেই সবুজ শহর। নিজের ও জীবনের প্রয়োজনেই সবুজের এ সমাহার, আয়োজন।

বৃক্ষরাজি ও সবুজের যে সমারোহ তা খানিকটা স্বস্তির ছোঁয়া দেয় নগরবাসীকে। সবুজের এ বিস্তার দেখলেই মনে হবে যত্রতত্র ও খামখেয়ালিপূর্ণভাবে বেড়ে ওঠেনি এ শহর। পরিকল্পনার ছাপ রয়েছে সর্বত্র।

ব্রিটিশ ভারতে রাজধানী ছিলো কলকাতা। ১৯১১ সাল থেকে দিল্লিই রাজধানী। সেই থেকেই নিরচ্ছিন্নভাবে বেড়ে ওঠা দিল্লির।  

যানজট বলতে যা বোঝা তা নেই। রাস্তায় গাড়ির আধিক্য রয়েছে, রয়েছে শৃঙ্খলাও। তাই যান থাকলেও জট নেই। ঢাকার মতো গণপরিবহনে নৈরাজ্য নেই। বিপুল সংখ্যক পাবলিক ট্রান্সপোর্ট তথা সরকারি বাস চলাচল করে। দিল্লি পরিবহন করপোরেশনে এসব বাস নির্দিষ্ট রুটে চলাচল করে। নম্বরধারী এসব বাস আসা-যাওয়া করছে সমস্ত শহর জুড়েই। নেই ভাড়া নিয়ে মারামারি বা কথা কাটাকাটি। টিকিট নিয়ে একজন বাসের নির্দিষ্ট জায়গায় বসে থাকেন। যাত্রীরাই তার কাছে গিয়ে টিকিট কাটেন। যা আমরা ঢাকায় কল্পনাও করতে পারি না। এছাড়া বাসের কাউন্টার তো রয়েছেই। ৩০ থেকে ৪০ টাকায় অটো রিকাশায় ওঠার কথা আমরা ভুলেই গেছি। দিল্লিতে ৪০ টাকায় যাবেন বহুদূর। ঢাকায় বর্তমানে সিএনজি চালিত ‍অটো রিকশায় উঠলেই ৪০ টাকা।

ভারত একটি বহুত্ববাদী সমাজ। বহুত্ববাদীতাই (Plurality and Multiplicity) ভারতের সৌন্দর্য। হাজার বছর ধরে সব ধর্ম-বর্ণ-জাতি-গোত্র নির্বিশেষে সবাই পাশাপাশি বাস করে আসছে দিল্লিতে। সেপ্টেম্বর মাসজুড়ে (যা এখনও চলছে) ভারতে গো-মাংস নিয়ে যে তুঘলকি কাণ্ড, তা ভারতের প্রতিচিত্র নয়। অসহিষ্ণুতা সব সমাজেই রয়েছে। কিন্তু তা বিচ্ছিন্ন। কখনোই তা একটি দেশ, সমাজ এমনকি শহরের সামগ্রিক চিত্রকে তুলে ধরে না। মহামান্য রাষ্ট্রপতি তার ভাষণে গো-মাংসের প্রেক্ষিতে বহুত্ববাদী ভারতকে সে কথাই মনে করিয়ে দিলেন।

রাষ্ট্রপতি ভবনের সামনে দিয়ে যখন গিয়েছি, তখন শ্রদ্ধায় অবনত হয়েছি ভারতের ঐক্যের প্রতীক মহামান্য রাষ্ট্রপতির জন্য। তিনি শুধু ভারতের রাষ্ট্রপতিই নন, বাংলাদেশের এক অকৃত্রিম বন্ধু। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে পাশে দাঁড়ানো এক অভিভাবক।

দিল্লি কেবল আধুনিক হয়ে বেড়ে ওঠা একটি শহরই নয়, মানবিক মর্যাদা, সহনশীলতা ও পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে এ শহর। কতিপয় দিল্লি ধর্ষণকাণ্ড দিয়ে সে মর্যাদাবোধের বুকে কালিমা লেপন করা যাবে না।

দিল্লির দুর্বিনীত ও উদ্ধত শাসক গিয়াস উদ্দিন তুঘলক শায়েস্তা করতে চেয়েছিলেন সুফি সাধক নিজামুদ্দিন আওলিয়াকে। সুলতান তাকে হত্যা করতে সৈন্যবাহিনী নিয়ে এগিয়ে আসছেন। শান্ত ও দৃঢ় নিজামুদ্দিন কেবল বলেছিলেন, ‘হনুজ দিল্লি দূর অস্ত’। সুলতান তুঘলক এরপর আর দিল্লি আসতে পারেননি। পথেই তার মৃত্যু হয়। তাই সব অশুভ ও অসুর মুক্ত হয়ে দিল্লি এগিয়ে যাচ্ছে তার আপন মহিমায়।

বাংলাদেশ সময়: ০৮১০ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৩, ২০১৫
এসএস

** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-৫: গালিবের সন্ধানে
** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-৪: নিজাম ডাকাত ও বিতাড়িত বাহাদুর উপাখ্যান
** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-৩: হুমায়ুনের সমাধি কি তাজমহলের অনুপ্রেরণা?
** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-২: পলাশী থেকে ভিক্টোরিয়া
** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-১: সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড, কলকাতা ইন অক্টোবর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।