ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

ভারত ভ্রমণপঞ্জি-৮

আগ্রা দুর্গ: অন্তরে তাজ অন্দরে কারাবাস!

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯১০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৮, ২০১৫
আগ্রা দুর্গ: অন্তরে তাজ অন্দরে কারাবাস! ছবি: লেখক

আগ্রা থেকে ফিরে: মুঘলদের পদভারে উৎকর্ষের শীর্ষে পৌঁছায় আগ্রা। বাবর থেকে শুরু করে বাহাদুর শাহ- সবাই বসবাস করেছেন এ আগ্রায়।

মুঘল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন পর্যায়ে রাজধানীও ছিল আগ্রা।


আগ্রাকে ধন্য করেছে তাজমহল। কিন্তু তাজমহলই আগ্রার সর্বস্ব নয়। তাজমহল যদি আগ্রার হৃদয় হয়, আগ্রা ফোর্ট তার হৃদস্পন্দন, সিকান্দ্রা তার নিঃশ্বাস আর কালো তাজ তার স্বপ্ন। অব্যক্ত এ স্বপ্ন নিয়েই আগ্রার বেঁচে থাকা। ইতিহাস, প্রেম ও স্বপ্নকে বুকে ধারণ করেই আগ্রার দিনযাপন।  

সৃষ্টির উৎস প্রেম। প্রেম থেকেই সবকিছুর সৃষ্টি। এই জগৎ, সংসার, ধর্ম, সাম্রাজ্য, তাজমহল এমনকি মানুষ- সবকিছু সৃষ্টির পেছনে যে মহাশক্তির অস্তিত্ব সেই তো প্রেম।


আগ্রার পাহাড়ের ভাজে, নদীর বাঁকে, সিকান্দ্রার বাগানে, ইতমৎউদ্দৌলার সমাধি অথবা চিনিকা রৌজায় খুঁজে পাই সেই অব্যক্ত প্রেমকে।

প্রেম যেখানে সর্বস্ব সময় সেখানে স্থির। আগ্রায় এসে যেনো সময় ফিরে গেছে অতীতে অথবা অতীতই এসে হাজির হয়েছে আজকের দ্বারে।


যে আগ্রার শিরে শোভা পেতো কোহিনুর, আজ তার বুকে কেবলই বিরহের হাহাকার। বিরহ বিহনে প্রেমের পূর্ণতা কোথায়? তাই হয়তো আগ্রার এ বিরহশোভা।  

মমতাজ-বিরহে সিক্ত হয়েই তো প্রেমিক শাহজাহানের উত্থান। তাজমহল? সেতো বিরহেরই অশ্রুমালা।


কিন্তু প্রেমেরও তো আছে রকমফের। নর-নারীর প্রেমই তো সর্বস্ব প্রেম নয়। আছে প্রকৃতির প্রেম, মানবপ্রেম, ক্ষমতার প্রেম আরো কতো কি!

মুঘল সাম্রাজ্য তো নর-নারীর প্রেম আর ক্ষমতা প্রেমেরই এক উপাখ্যান। হয়তো সব সাম্রাজ্যের জীবনেই এরকম কাহিনী থাকে।

রাজা-যুবরাজের জীবনে প্রেম আসে। সে প্রেমের জন্য রাজ্যও হারিয়েছেন কত যুবরাজ, হয়েছেন নি:স্ব। আবার প্রেমের জন্য যুদ্ধও হয়েছে, হয়েছে রাজ্য জয়।

যেমন প্যারিসের জীবনে এসেছেন হেলেন, মজনুর জীবনে লাইলী, রোমিওর জীবনে জুলিয়েট। মুঘল প্রেমের অমর কাহিনীও আছে অনেক। জাহাঙ্গীর বা সেলিমের জীবনে যেমন এসেছেন নূরজাহান, শাহজাহানের জীবনেও এসেছিলেন মমতাজ।


আর আনারকলিকে তো জীবনের বিনিময়েই রক্ষা করতে হয়েছিল মুঘল শান-শওকত। নিজের জীবনের বিনিময়ে সেদিন রক্ষা করেছিলেন শাহজাদা সেলিমের জীবনও।

অব্যক্ত (ব্যর্থ নয়) প্রেমের এ রকম সমাধি তো মুঘল সাম্রাজ্যে কম নয়। বাগানের সব ফুল তো আর দেবতার পায়ে শোভা পায় না। তেমনি সব সমাধির ওপরও তাজমহল গড়ে ওঠে না। কোনো কোনো সমাধি হয়তো সবুজ ঘাসে ছেয়ে যায় সময়ের আবর্তনে।


এতো গেলো রাজা-যুবরাজের প্রেম কাহিনী। কিন্তু সাম্রাজ্য বিস্তার ও ক্ষমতার মসনদ যার স্বপ্ন তার কাছে প্রেমের রং ভিন্ন। ক্ষমতাই তার ধ্যান-জ্ঞান। সিংহাসনই তার লক্ষ্য। মুঘল ইতিহাসে নারীর প্রেম যেমন আছে, তেমনি আছে ক্ষমতার প্রেমও।  


ক্ষমতার এ দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছেন বাবরের সব উত্তরাধিকারীরাই। হুমায়ুন থেকে শুরু করে এ ধারাবাহিকতা বজায় ছিল বাহাদুর শাহ পর্যন্ত। পিতার বিরুদ্ধে পুত্র, পুত্রের বিরুদ্ধে পিতা, ভাইয়ের বিরুদ্ধে ভাই- ক্ষমতা দখলের এ ফয়সালা রণাঙ্গনেও গড়িয়েছে কম না।


সেলিমকে হারাতে হয়েছে আনারকলিকে। সেলিম আর নূরজাহান নিয়েও আছে অনেক কাহিনী। নূরজাহান মুঘল সাম্রাজ্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী নারী। তিনি সুশিক্ষিত ছিলেন। তাই মুঘল সাম্রাজ্যের অন্দরে ও বাইরে ছিল তার সমান প্রভাব। তিনি সাম্রাজ্য পরিচালনায়ও অনেক সিদ্ধান্ত নিতেন। তিনিই একমাত্র মুঘল নারী যার নামে মুদ্রাও বের হয়েছিল।  

ইতিহাস বলে, আনারকলিকে জীবন্ত কবর দেওয়া হয়েছিল। আনারকলি তার জীবন দিয়ে প্রমাণ করলেন প্রেম অমর।


শাহজাহান তাজমহল গড়েও তা ছুঁয়ে দেখতে পারেননি। স্পর্শ করতে পারেননি প্রিয়তমা স্ত্রী মমতাজমহলের সমাধি। দূর থেকে তাকিয়ে থাকতে হয়েছে অশ্রুসিক্ত হৃদয়ে।

আজকের জেসমিন প্রাসাদ বা মুসম্মন বুরুজে দাঁড়িয়ে সেদিনের শাহজাহানের বিরহ-বেদনা অনুভব করা যাবে না। যে প্রাসাদে দাঁড়িয়ে জীবনের শেষ দিনগুলো একপলকে তাকিয়ে দেখেছেন শাহজাহান, সে প্রাসাদ থেকে তাজমহল আজও দৃশ্যমান।
এ প্রাসাদের নান্দনিক সৌন্দর্য ও ঐশ্বর্যে বিশ্ব আজও হতবাক। পাথরের এমন কারুকাজ বিশ্বে বিরল। বিস্ময় সৃষ্টি করে এর মসজিদ, প্রাসাদ, বাগান, ঝরনা।


এখানেই তার ক্ষমতালিপ্সু পুত্র আওরঙ্গজেব তাকে বন্দি করে রেখেছিলেন। বের হতে দেননি পিতাকে। নিজের প্রিয় তাজমহল স্পর্শও করে দেখতে পারেননি শাহজাহান।   

মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত (১৬৫৮ সাল থেকে ১৬৬৬ সাল পর্যন্ত)  জীবনের ৮টি বছর এখানেই বন্দি অবস্থায় কারাবাস করেন শাহজাহান। পুত্রের শিকলে বন্দি শাহজাহান হয়তো তার ফেলে আসা অতীতেরই মুখোমুখি হয়েছেন জীবনের শেষ প্রান্তে (তিনিও যে তার ভাই ও পিতার বিরুদ্ধে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছেন একইভাবে)। মৃত্যুর পর মমতাজের পাশেই সমাহিত করা হয় বৃদ্ধ প্রেমিক শাহজাহানকে।


শাহজাহানের তৈরি দেওয়ান-ই-আম দরবার কক্ষটিতে দাঁড়িয়ে অনুভব করতে চেয়েছি প্রেম ও বিরহের এ মহাকবিকে।

শাহজাহান-মমতাজের খাসমহলের (বেডরুম) পাশে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করেছি, মমতাজকে কতোটা ভালোবেসেছিলেন শাহজাহান? উত্তর পাইনি। প্রেমিক-প্রেমিকার ভালোবাসা হয়তো অব্যক্তই থেকে যায় চিরদিন।

সূর্য তখন হেলে পড়ছিল। যমুনায় দুর্গের ছায়া। ঈশান কোণে ধূসর বরণ তাজমহল। গোধুলি বেলায় তাজের এ রূপ যেনো ভালোবাসারই কোনো রং। নাকি শাহজাহানের হৃদয়ের বিরহ সুর?


অন্তরে তাজ নিয়ে বৃদ্ধ প্রেমিকের কারাবাস ‘ভালোবাসা চির জাগরুক’ সে কথাই মনে করিয়ে দেয়। যেন কবির ভাষায়: ‘সর্বান্তঃকরণ প্রেম সমস্ত ধ্বংসের পরও পৃথিবীতে ঠিক রয়ে যায় ঠিক মতো গাঁথা হলে ভালোবাসা-স্থির শিল্পকলা’।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৪০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৮, ২০১৫
এএসআর


** আগ্রা ফোর্ট: অন্দর মহলে মুঘল ইতিহাস

** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-৬: দিল্লির পথে পথে

** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-৫: গালিবের সন্ধানে
** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-৪: নিজাম ডাকাত ও বিতাড়িত বাহাদুর উপাখ্যান
** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-৩: হুমায়ুনের সমাধি কি তাজমহলের অনুপ্রেরণা?
** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-২: পলাশী থেকে ভিক্টোরিয়া
** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-১: সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড, কলকাতা ইন অক্টোবর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।