আগ্রা থেকে ফিরেঃ মুঘল সাম্রাজের সবচেয়ে আলোচিত নাম বা শব্দটি কি? তাজমহল, শাহজাহান-মমতাজ, নাকি আকবর? এ নিয়ে মতবিরোধ থাকলেও সম্রাট আকবরই যে মুঘল সাম্রাজ্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী চরিত্র বা সম্রাট তা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই।
প্রায় সাড়ে তিনশ’ বছরের মুঘল সাম্রাজ্যে আকবরই শাসন করেছেন অর্ধ শতাব্দীরও বেশি (৫৩ বছর)।
৬৩ বছর বয়সে ১৬০৫ সালের ১৫ অক্টোবর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি মুঘল শাসক ছিলেন।
আগ্রা মুঘলদের রাজধানী। আগ্রার পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে মুঘল ইতিহাসের একেকটি অধ্যায়।
আগ্রার অদূরে সিকান্দ্রায় আকবরের সমাধি। হৃদয়ে অসাধারণ এক শিহরণ বোধ করলাম আগ্রায় গিয়ে। শৈশব থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যে ইতিহাস বার বার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে আজ সেই ইতিহাসের মুখোমুখি হতে যাচ্ছি সিকান্দ্রায়, আগ্রায়।
আগ্রায় গিয়ে যারা শুধু তাজমহল দেখে বাড়ি ফেরেন, তারা মুঘল ইতিহাসের মধ্যাহ্ন উপভোগ করেছেন। মুঘল ইতিহাসের সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সৌন্দর্য ও মহিমাকে উপলব্ধি করতে যেতে হবে সিকান্দ্রা, ফতেহপুর, আজমীর, নিজামুদ্দিন, রেডফোর্টে।
সিকান্দ্রা যেন একখণ্ড মুঘল ইতিহাস। মুঘল পূর্বপুরুষেরা চেয়েছিলেন আজীবন ঐক্য ও সংহতি থাকুক তাদের উত্তরাধিকারীদের মধ্যে। সুগঠিত ও বিস্তৃত হোক এর সাম্রাজ্য। তারা চেয়েছিলেন তাদের মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকুক মুঘল সাম্রাজ্য। মুঘল পুরুষদের মৃত্যু যেন সাম্রাজ্যে কোনো ছায়া না ফেলে।
নিজের উত্তরাধিকার সম্পর্কে এরকম চাওয়া কেবল মুঘলদেরই না। অমরত্ব মানুষের চিরদিনের আশা। কিন্তু অমরত্ব তো মানুষের নিয়তি নয়। মৃত্যুই মানুষের শেষ পরিণতি।
মৃত্যুতেই যদি জীবনের পরিসমাপ্তি হয়, তবে কেন এই জীবনযজ্ঞ, বৃথা এ সাম্রাজ্য বিস্তার?
মানুষের শেষ মৃত্যুতে। আর মহামানুষের লক্ষ্য জীবনের ওপারেও বেঁচে থাকা। মৃত্যুঞ্জয়ের বাসনা নিয়ে বেঁচে থাকাই জীবনের লক্ষ্য।
কিন্তু আমাদের মতো আম-আদমিরা মৃত্যুর আগেই মরে যাই। জীবনে কোনো কর্ম নাই, নাই কোনো অভিলাস। শরীরকে মৃত্যু পর্যন্ত বয়ে নিয়ে যাওয়াই যেন সার।
সাম্রাজ্যের সূর্য অস্তমিত। নেমে গেছে পতাকা। তারপর আরো কতো যুগ, কতো কাল গত হয়েছে। উঠেছে নতুন পতাকা, নতুন সূর্য। ব্রিটিশ শাসন সেও তো শেষ হয়েছে অর্ধশত বছর। কিন্তু আজও ফিরে ফিরে আসে সেই মুঘল ইতিহাস। আকবর, শাহজাহান, হুমায়ুন আরো কতো নাম। যতোবার মুঘল ইতিহাসের বয়ান, ততোবারই ফিরে আসেন আকবর।
সিকান্দ্রায় সমাহিত আকবর। জীবদ্দশাতেই বেছে নিয়েছেন মরনের পরের জায়গা। শুধু নিজের জন্য নয়, নিজের সব উত্তরাধিকারীদের জন্যও।
মুঘলদের মাঝে নিজের সমাধিক্ষেত্র বেছে নেওয়ার রেওয়াজ ছিল। তাই আকবর বেঁচে থাকতেই কাজে হাত দেন সমাধিক্ষেত্রের। কিন্ত শেষ করতে পারেননি সে কাজ। দেখে যেতে পারেননি আজকের সিকান্দ্রাকে।
পুত্র সেলিমকেই শেষ করতে হয়েছে পিতার সমাধিক্ষেত্রের কাজ। ১১৯ একর জায়গায় তিনি নির্মাণ করেন এই সমাধিক্ষেত্র। ১৬০৫ সালে শুরু হয়ে ১৬১৩ সালে শেষ হয় এর কাজ।
আকবর চেয়েছিলেন, তার সব উত্তরাধিকারীদের সমাধি হবে এ সিকান্দ্রায়। এটি হবে মুঘল পরিবারের সমাধিক্ষেত্র। কিন্তু মানুষের সব ইচ্ছা কি পূরণ হয়? বিধাতা আকবরের সে ইচ্ছা পুরণ করেননি। আকবরের কোনো পুত্র বা পরবর্তী কোনো সম্রাটের সমাধি হয়নি সিকান্দ্রায়। মৃত্যুর পর সিকান্দ্রায় বড় নি:সঙ্গ আকবর!
পিতার ইচ্ছা পূরণে জাহাঙ্গীর এখানে আরো অনেক কবর রচনা করেছিলেন। আকবরের সমাধিকে কেন্দ্র করে এসব সমাধি এখন শূন্যই পড়ে আছে। গাইড চমনের ভাষ্য মতে, এখানে চল্লিশটি সমাধি আছে। যার মধ্যে শুধু চারটির মধ্যে মৃতদের সমাহিত করা হয়। এখানে আকবর ছাড়াও সমাহিত রয়েছেন সম্ভবত আকবরের এক বোন এবং শাহজাহানের এক ছেলে ও এক মেয়ে।
বাকি সব সমাধিই শূন্য পরে আছে চারশ’ বছরেরও বেশি সময় ধরে।
পুত্র জাহাঙ্গীর শুয়ে আছেন লাহোরে, শাহজাহান তাজমহলে, আওরঙ্গজেব আওরঙ্গাবাদে, বাহাদুর শাহ রেঙ্গুনে, বাবর আফগানিস্তানে। অনেকের সমাধিতেই অযত্ন-অবহেলার ছাপ স্পষ্ট। একই চিত্র আকবরের সমাধিতেও।
ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণের দিক দিয়ে হয়তো পুরো উপমহাদেশের একই চরিত্র। তার নমুনা দেখা যায় সব মুঘল স্থাপত্যেই। ঐতিহ্য সংরক্ষণে অবহেলা যেন আমাদের জাতীয় চরিত্র।
আকবর দীন-ই-এলাহি’র সূচনা করেন। তার সমাধির মূল গেটে আছে সব ধর্মেরই বাণী বা পরিচয়বাহী চিহ্ন।
অন্যান্য সব মুঘল স্থাপত্যের মতো এখানেও আছে বাগান, ফোয়ারা, একাধিক গেট ইত্যাদি। আর স্থাপত্যশৈলীতো আছেই।
শ্বেতপাথর, লালপাথর ও জেডপাথর দিয়ে তৈরি এর সবগুলো ভবন।
চারদিকে চারটি গেট থাকলেও আজ শুধু একটি গেটই উন্মুক্ত। প্রধান গেট দিয়ে ঢুকে বেশ খানিকটা হেঁটে সমাধি প্রাঙ্গনে যেতে হয়।
প্রতিটি গেটেই রয়েছে অসাধারণ সুন্দর নকশা যা লাল-নীল বা সোনালী রঙের পাথর দিয়ে তৈরি। কালের বিবর্তনে অনেক নকশাই নষ্ট হয়ে গেছে। ভবনের জায়গায় জায়গায় বয়সের ছাপ স্পষ্ট। কোথাও কোথাও ক্ষয়ে গেছে পাথর ও কারুকাজ।
সমাধির ওপর আছে দৃষ্টিনন্দন মিনার যা এ সমাধিকে পৌঁছে দিয়েছে এক অন্যরকম উচ্চতায়।
সমাধির এ জায়গাটি এক সময় ছিল ঘন জঙ্গল। সম্রাট এখানে শিকারে আসতেন। তারা বিশ্রাম নিতেন এখানে। জাহাঙ্গীরের বিশ্রাম করার ঘরটি এখনও আছে। নাম তার কাচমহল। কালের বিবর্তনে ক্ষয়ে গেছে এর অনেক সৌন্দর্যই। এই কাচমহল যে পাথর দিয়ে তৈরি তার থেকে রাতে আলো বের হতো। হয়তো ছিল কাচের কারুকাজও। সময়ের গর্ভে হারিয়ে গেছে অনেক কিছু।
চারদিকে বিস্তীর্ণ ও সবুজ চত্বর দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। সবুজের বুকে বিচরণ করছে কয়েকটি হরিণ। বাগানে পাখির কিচির-মিচির, সবুজে হরিণের বিচরণ ও সমাধির একাকিত্ব হৃদয়ে জাগায় এক অলৌকিক অনুভূতি। যা দর্শনার্থীদের নিয়ে যাবে পাচশ’ বছর আগের সিকান্দ্রায়। হয়তো অনুভব করবেন আকবরের বিচরণ। হয়তো শাহজাদা সেলিম এসেছেন পিতার সমাধি চুম্বনে। হয়তো মনে হতে পারে মমতাজের হাত ধরে বাগানের আশপাশেই কোথাও আছে শাহজাহান।
মূল সমাধি ভবনটি একটি ছোট কক্ষে আবদ্ধ। এখানে একজন লোক দর্শনার্থীদের আযান দিয়ে শোনান। সে আযান থেকে এক অসাধারণ প্রতিধ্বনি আসে। যা না শুনলে বোঝা যাবে না। ভাষায়ও বর্ণনা করা যায় না।
অসাধারণ এক জ্যামিতিক কৌশল অনুসরণ করা হয়েছে এ সমাধি নির্মাণে। মূল সমাধিতে অনেকগুলো গেট পার হয়ে যেতে হয়। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই সমাধির প্রকৃত অবস্থান। কিন্তু মূল সমাধিকে সামনে রেখে দাঁড়ালে চোখে পড়বে বহুদূরে অবস্থিত প্রথম সেই ছোট গেটটি। মনে হবে যেনো অনেক দূর থেকে আলো এসে পড়ছে সমাধির ওপরে।
এরকম আরো অনেক প্রযুক্তিগত ও জ্যামিতিক-গাণিতিক কৌশলে নির্মিত আকবরের সমাধি প্রাঙ্গন। যা পুরোপুরি অনুধাবন করা কেবল এ বিষয়ে গবেষকদের পক্ষেই সম্ভব। সাধারণ দর্শনার্থীদের পক্ষে এই নিখুঁত সৌন্দর্য উপলব্ধি করা কঠিন।
আজ আকবর নেই। নেই সেলিম কিংবা নূরজাহানও। শুধু কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মুঘলদের একেকটি স্থাপত্য কীর্তি-দিল্লি, আগ্রা অথবা সিকান্দ্রায়।
বাংলাদেশ সময়: ০৬৪৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৫
এএসআর
** আগ্রা দুর্গ: অন্তরে তাজ অন্দরে কারাবাস!
** আগ্রা ফোর্ট: অন্দর মহলে মুঘল ইতিহাস
** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-৬: দিল্লির পথে পথে
** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-৫: গালিবের সন্ধানে
** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-৪: নিজাম ডাকাত ও বিতাড়িত বাহাদুর উপাখ্যান
** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-৩: হুমায়ুনের সমাধি কি তাজমহলের অনুপ্রেরণা?
** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-২: পলাশী থেকে ভিক্টোরিয়া
** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-১: সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড, কলকাতা ইন অক্টোবর