যমুনার জলস্রোতের পাশে তাজমহল যেন ভেসে ওঠা একটি দ্বীপ। এ দ্বীপ কখনো প্রেমের, কখনো বা সে আবার বিরহের।
বিশ্বকে বিস্ময়ে ডুবিয়ে যমুনার তীরে তৈরি হয়েছে তাজমহল।
কিন্তু যে যমুনার পাশে তাজের জন্ম, শৈশব ও বেড়ে ওঠা, তা-কি শুধুই একটি নদী- একটি জলপ্রবাহ?
যারা তাজ দর্শনে ধন্য হয়েছেন, তারাই উপলব্ধি করতে পারেন যে, যমুনা কেবল একটি নদীই নয়, তাজের শিরায় যমুনা যেন রক্তপ্রবাহ, জীবনপ্রবাহ। যমুনা ছাড়া অন্য সব নদীর তীরে তাজ তাই বড় বেমানান। ভারত তথা মুঘল খানদানের নীল জলস্রোতই যে তার আভিজাত্যের রক্তপ্রবাহ। তাজের সৌন্দর্য ও মহিমার অর্ধেকটাই তো যমুনায়।
যমুনা আজ শুষ্কপ্রায় একটি নদী। বুকে তার বেদনার পাথরের মতো জেগে উঠেছে একেকটি চর।
যমুনার বুকে উত্তাল ঢেউয়ের আনাগোনা অবশ্য ছিল না কোনো কালেই। শান্ত, সৌম্য, দৃঢ় ও অবিচল ছিল তার পথচলা। যমুনার মতো এতো বাঁক ও বাধার মুখোমুখি আর কোনো নদীকেই হতে হয়নি। তবে শত বাঁক ও বাধার মুখেও সে ছিল অপ্রতিরোধ্য।
মধ্য হিমালয়ে জন্ম নিয়ে দিল্লি হয়ে আরো অনেকটা পথ চলতে হয়েছে যমুনাকে। প্রায় হাজার মাইলের পথ পাড়ি দিয়ে তবেই আগ্রায় তার পরিণয়। পূর্ণতার সন্ধানেই বুঝি তার এ দীর্ঘ পথচলা। তাজের পদস্পর্শেই তার স্বস্তি। তাজকে সিক্ত করে, প্রেমসুধা পান করিয়ে তবেই তার পূর্ণতা। বিনিময়ে কি চেয়েছে যমুনা? কিছুই নয়, নিজের গায়ে তাজের একটু ছায়া!
বিশ্ব তাজমহলে দেখেছে শাহজাহান-মমতাজের মিলন। কিন্তু শাহজাহান-মমতাজ দেখেছেন, তাজ আর যমুনার এক মহামিলন।
তাজের ছায়া আজ আর যমুনার কায়ায় ছবি আঁকে না। তাজ-বিরহে যমুনা আজ শুষ্কপ্রায় এক জলরেখা। কেবল বিরহের ক’ফোটা অশ্রু নিয়ে দেখছে দূর থেকে।
এদিকে যমুনা বিরহে কেমন আছে তাজমহল? যমুনাহীন তাজমহলের কী দাম আছে? তাজের সৌন্দর্যের অর্ধেকটাইতো যমুনায়। আজকের যমুনাহীন তাজ তাই যেন শুষ্ক মরুভূমিতে একটি প্রেমের সমাধিমাত্র।
তাজমহলের শ্বেতপাথর আর মিনার-গম্বুজ দেখে যারা বিস্মিত, তাদের কাছে তাজমহল এক অনন্য স্থাপত্য ছাড়া আর কিছুই নয়। তাজমহলকে শুধু চোখের দেখায় নয়, হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেই এর মহিমা সন্ধান করতে হয়। দৃষ্টিতে যমুনা ও হৃদয়ে তাজমহল নিয়ে উপলব্ধি করতে হয় সে মহিমা।
শাহজাহানের দৃষ্টিতে ছিল যমুনা আর হৃদয়ে ছিলেন মমতাজ, তাই গড়ে উঠেছে তাজমহল। তাই যমুনাকে এড়িয়ে তাজমহলের সৌন্দর্যের অনুসন্ধান শাহজাহান-মমতাজের প্রেমকে অস্বীকার করা, যমুনা ও তাজের মহামিলনকে অবজ্ঞা করা।
গবেষকরা বলছেন, যমুনার শুষ্কতা তাজমহলের জন্য হুমকি। অস্তিত্বহীন যমুনায় প্রাণহীন তাজের বেঁচে থাকা।
তাজের ভিত্তি যে কাঠ দিয়ে, সে কাঠ যমুনার জলপানে সিক্ত হয়, আর্দ্র হয়। যমুনায় পানিপ্রবাহ না থাকায় সেগুন গাছের সে গুঁড়িও আজ চৌচির।
বর্ষাই তাজের ভরসা। বর্ষায় যমুনা ফিরে পায় তার প্রাণ। কিন্তু বাকিটা সময় কাটে তার ঘোর তৃষ্ণায়। আগ্রায় তো প্রায় সারা বছরই গ্রীষ্ম। তাই সারা বছরই তার বেঁচে থাকার সংগ্রাম।
যমুনার বিষাক্ত জলপানে ও জলঘ্রাণে তাজমহলের প্রাণ যায় যায়। আদালতের নির্দেশে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে অনেক কল-কারখানা। কিন্তু মনুষ্যসৃষ্ট জঞ্জালতো আছেই।
গবেষকরা বলছেন, তাজমহলের ভিত্তিতে ক্ষয় ধরেছে। অতি শিগগিরই এ ক্ষয় রোধ করতে হবে।
তাজের বয়স হয়েছে ৩৬০ বছর। কিন্তু বয়স তাকে কাবু করতে পারেনি। কাবু করেছে মানুষের অত্যাচার, অবহেলা।
কিন্তু কতোদিন সে সইবে এ অবহেলা?
বন ধ্বংস, কারখানার বিষাক্ত ধোঁয়া, শোধনাগারের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় তাজের গায়ে বয়সের ছাপ। সামগ্রিক পরিবেশটাই যে তাজের অনুকূলে নয়।
তাজমহলের শ্বেতপাথর আজ হলদে বরণ ধারণ করেছে। ধূসর হয়ে যাচ্ছে তাজের পরিবেশ।
তাজমহল আমাদের কাছে এক মহাবিস্ময়। তাজমহল শুধু দুনিয়ার সবচেয়ে বড় প্রেমের প্রতীকই নয়। দুনিয়ায় মানবসৃষ্ট এক মহাবিস্ময়। এর প্রতিটি শ্বেতপাথর মহা মূল্যবান। সেটি অর্থের বিচারে যতোটা, তার চেয়ে ঢের বেশি স্থাপত্যের বিচারে, সৌন্দর্যের বিচারে।
তাজমহলের গাণিতিক, জ্যামিতিক অবস্থানও এক বিস্ময়। এর সামগ্রিক অবস্থা ও অবস্থান-পুরোটা মিলেই তাজমহল। একটি পাথরও যদি ক্ষয়ে যায়, তবে তা হবে তাজমহলের গায়ে এক মহাক্ষত।
কিন্তু ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতি এ উপমহাদেশের রয়েছে আজন্মের অনীহা, অবহেলা। অবহেলা-অনাদরে কালের গর্ভে যে কতো স্থাপনা-ঐতিহ্য হারিয়ে গেছে তার হিসাব নেই। তাজমহলের সৌন্দর্যও সে পথেই চলছে। এর সার্বিক শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা, অপরিচ্ছন্নতা, অযত্ন ও অবহেলা অত্যন্ত হতাশাজনক।
তাজমহলের দেয়াল ঘেঁষে পর্যটকদের যাওয়া আসা, দর্শন। গায়ের স্পর্শে দেয়ালে কালো দাগ পড়ে গেছে বহু জায়গায়। এমনকি অনেক জায়গার পাথর খুলে নেওয়া হয়েছে। তাজমহলের একেবারে ভেতরে যেখানে সমাধি, সেখানেও পর্যটকদের প্রবেশে নেই কোনো বাধা। ফলে প্রতি মুহূর্তে পর্যটকদের প্রবেশে সৃষ্টি ধূলা-ময়লায় রীতিমতো নাস্তানাবুদ তাজমহল।
মূল কক্ষের ভেতরে ঢুকে সৌন্দর্য উপভোগতো দূরের কথা, সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেছি, তাজমহল যেনো টিকে থাকে।
কোথাও কোথাও প্রেমিকযুগল শাহজাহান-মমতাজের তাজমহলে নিজেদের নাম খোদাই করার চেষ্টাও করেছে। নিরাপত্তা বাহিনীর লোকেদের সামনেই তাজমহলের দেয়ালের ওপর বসে থাকেন পর্যটকরা। চারপাশের উঁচু স্তম্ভের ওপরও শুয়ে-বসে দিন কাটাচ্ছেন তারা। পানির বোতল, পায়ের কভার মোজা ভেতরেই ফেলে চলে যাচ্ছেন অনেকে। এভাবেই তাজের বারোটা বাজিয়ে এর সৌন্দর্য উপভোগ করছেন সবাই। সবই চলছে কর্তৃপক্ষের সামনে।
দেখলাম, তাজমহলের দক্ষিণ দিকের (যমুনার দিকের) কয়েকটি মিনারের সংস্কার চলছে। যেভাবে অযত্ন ও অবহেলায় এ সংস্কার কাজ চলছিল, তা দেখে মনে হলো, যেনো কোনো সাধারণ স্থাপনার নির্মাণ কাজ চলছে।
তাজমহল যে বিশ্বের বিশেষ একটি স্থাপনা, তা এখানকার সার্বিক পরিস্থিতি দেখে মনে হয়নি। সচেতনতার অভাব এর জন্য দায়ী। আর যারা কর্তৃপক্ষে আছেন, তাদের সে উপলব্ধি আছে বলেও মনে হয়নি।
মূল সমাধির ভেতরে ক্যামেরা নেওয়া নিষেধ। তারপরও সেখানে মোবাইল ফোন ও ক্যামেরা নিয়ে চলছে সেলফি উৎসব।
কেউ কেউ আবার শাহজাহান-মমতাজের সমাধির ওপর টাকা-পয়সা ছিটিয়ে দিচ্ছেন!
ছবি তোলায় নিষেধাজ্ঞা থাকায় বাইরে থেকে অযত্ন-অবহেলার কিছু ছবি তুলছে পেরেছি। যা দেখে পাঠকরা হয়তো কিছুটা অনুমান করতে পারবেন। এ রকম নমুনা আরো আছে, যা ক্যামেরায় ধারণ করতে পারিনি।
তাজমহলের সীমানা প্রাচীর ঘেঁষে যেভাবে দোকান-পাট হয়েছে, তা দু:খজনক। মূল প্রবেশমুখে রয়েছে কয়েকশ’ দোকান। রাস্তার ধূলো-বালিতে পুরো এলাকা অপরিচ্ছন্ন।
এতো কিছুর পরও ভালোবাসা চিরজাগরুক। তাইতো ৩৬০ বছরের তাজ আজও যেন সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত। বুকে তার প্রেম যমুনার তৃষ্ণা আছে, আছে শত বছরের ক্লান্তি। কিন্তু তারপরও দৃষ্টিতে তার অমরত্বের স্বপ্ন। হয়তো এ স্বপ্নই তাকে বাঁচিয়ে রাখবে অনন্তকাল।
বাংলাদেশ সময়: ০০২৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৭, ২০১৫
এএসআর
** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-১০: দেয়ালেরও কান আছে
** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-৯: শূন্য সমাধিতে পূর্ণ সিকান্দ্রা, আছেন শুধু আকবর
** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-৮: আগ্রা দুর্গ: অন্তরে তাজ অন্দরে কারাবাস!
** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-৭: আগ্রা ফোর্ট: অন্দর মহলে মুঘল ইতিহাস
** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-৬: দিল্লির পথে পথে
** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-৫: গালিবের সন্ধানে
** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-৪: নিজাম ডাকাত ও বিতাড়িত বাহাদুর উপাখ্যান
** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-৩: হুমায়ুনের সমাধি কি তাজমহলের অনুপ্রেরণা?
** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-২: পলাশী থেকে ভিক্টোরিয়া
** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-১: সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড, কলকাতা ইন অক্টোবর