[পূর্ব প্রকাশের পর]
অড্রিয়াটিক সাগরের তীরে একটি উপহ্রদের মধ্যে শতাধিক ছোট দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে গঠিত ভেনিস। ইতালির অন্যতম পর্যটক আকর্ষক শহর এটা।
৬ সেপ্টেম্বর সকালে লনিগো থেকে ট্রেন ছাড়ে ১৫ মিনিট দেরিতে। তাই ভেনিস পৌঁছাতে ২০ মিনিট দেরি হয়ে গেলো। ততক্ষণে আমার বন্ধু হাসনাইন জার্মানি থেকে ভেনিস পৌঁছে গেছে। যেহেতু প্রায় পাঁচমাস পরে দুই বন্ধুর দেখা তাই আমি চেয়েছিলাম দেখা করার জায়গাটাও বিশেষ হোক।
গুগল স্ট্রিট ভিউ থেকে আগেই দেখেছিলাম আমার ট্রেন স্টেশন আর ওর বাসস্টপের মধ্যে অসম্ভব সুন্দর একটা ব্রিজ আছে, পোন্তে দেল্লা কসতিতুতছিয়নে। ওকে বলে দিয়েছিলাম ওই ব্রিজের ওপর থাকতে। আমি গিয়ে দেখি বান্দা আমার আগেই হাজির। বেশ একটা আবেগঘন পুনর্মিলনের পর আমরা শুরু করলাম আমাদের ভেনিস অভিযান।
জার্মানি থেকে তৈরি করে নেওয়া লিস্টে চোখ বুলিয়ে বুঝতে পারলাম বেশিরভাগই আমাদের অবস্থান পিয়াতছালে রোমা থেকে একটু ভেতরের দিকে। তাই আপাতত স্কাউট ম্যাপকে জিজ্ঞেস করলাম আমাদের কাছাকাছি টুরিস্ট আকর্ষণ কি আছে। বেশ অনেকগুলো দেখালো। সেখান থেকে কাছাকাছি ২/৩টা শেষ করার পরে বুঝতে পারলাম এভাবে এগোতে থাকলে পুরো একসপ্তাহ লেগে যাবে সব শেষ করতে। মনে পড়ে গেলো ট্রিপ অ্যাডভাইজারে কেউ একজন বলেছিলো ভেনিসে অন্তত একবার হলেও ম্যাপ ভুলে রাস্তায় হারিয়ে যেতে।
উল্লেখ্য, ভেনিসে গাড়ি চালানোর কোনো উপায় নেই, পুরো শহরজুড়েই গাছের শেকড়ের মতো খাল। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বলতে এই খাল দিয়ে চলা ওয়াটার ট্যাক্সি। নয়তো খালের পাশ দিয়ে তৈরি পায়ে চলা পথ দিয়ে ঘুরে বেড়ানো। তবে মজা হচ্ছে আপনি যতই হাঁটেন চারপাশে লেগুনের পানি থাকায় ভেনিসের প্রধান দ্বীপের বাইরে চলে যাওয়ার ভয় নেই।
তাছাড়া একটু পরপরই দেখার মতো কিছু না কিছু না পাবেন, সেটা হতে পারে প্রাচীন কোনো চার্চ, কোনো মিউজিয়াম বা কোনো প্রদর্শনী। আর প্রতি ১০ মিটার পরপর মুখোশ, হ্যাট বা নানা রঙের কাচের জিনিসের দোকান তো আছেই। তাই আমরা ট্রিপ অ্যাডভাইজারে অ্যাডভাইজ মেনে নিয়ে হারানোর উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম।
কিছুদূর হাঁটার পরে আইসক্রিম পার্লার দেখে মনে পড়লো ট্রাভেল ব্লগগুলোতে অনেক খাবারই খেতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ইতালি গেলে প্রতিদিন ন্যূনতম ২টা করে জিলাটো খেতে বলা হয়েছি সেখানে। পরামর্শটা ফেলে দেওয়ার মতো না। বিশেষ করে হাসনাইনের মতো পেটুক সঙ্গে থাকলো তো অবশ্যই না।
ঘণ্টাখানেক উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়ানোর পরে জানতে পারলাম সৌভাগ্যবশত সেদিন ভেনিসের অন্যতম একটি বাৎসরিক উৎসব রেগাতা স্তোরিকা। এটি মূলত আমাদের দেশের নৌকাবাইচ। জানতে পারলাম পোন্তে ডি রিয়ালতো থেকে নৌকা বাইচ দেখে বেশি মজা পাওয়া যাবে।
এই রিয়ালতো ব্রিজই গ্রান্ড ক্যানেলের দুই পারকে সংযুক্ত করা প্রথম ব্রিজ। এই স্থানে ১১৮১ সালে প্রথম একটি ভাসমান ব্রিজ নির্মাণ করা হয়। পরবর্তীতে ১২৫৫ সালে ভাসমান ব্রিজ সরিয়ে কাঠের ব্রিজ নির্মাণ করা হয়। পরে ১৫৯১ সালে পাথর দিয়ে ব্রিজটা নির্মিত হয়, যা সময়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে এখনো টিকে আছে।
ইতিহাসের সাক্ষী পোন্তে ডি রিয়ালতো আমাদের লিস্টেও ছিলো। তাই পা বাড়ালাম তার দিকে। কিন্তু পৌঁছে দেখি ব্রিজের আগে থেকেই অসম্ভব ভিড়, দাঁড়াবার মতো জায়গা নেই। নৌকাবাইচ শুরু হতে কিছু সময় বাকি থাকায় এবং আমাদের লিস্টের বেশিরভাগ ব্রিজের ওই পাড়ে হওয়ায় সিদ্ধান্ত নিলাম ব্রিজ পার হয়ে ওই পারে চলে যাবো। ওই পারে যাওয়ার পরে হাসনাইনের আবার ক্ষুধা লেগে গেলো। তাই পিৎজা দিয়ে দুপুরের খাওয়াটা সেরে নিলাম।
খাওয়া-দাওয়ার পরে পা বাড়ালাম পিয়াতছা সান মার্কোর উদ্দেশ্যে। বিশাল বড় একটা স্কয়ার, পুরোটা মানুষ আর মানুষ। ভেনিসে গ্রীষ্মকালে এমনিতেই প্রচুর পর্যটক থাকে, তবে ওইদিন রেগাতা স্তোরিকা থাকায় ভেনেটিয়ানরাও পর্যটকদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে, ফলে ভিড়টা একটু বেশিই ছিলো। কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করার পরে গেলাম ২টা মিউজিয়াম পরিদর্শন করতে। মিউজিয়ামে ঢোকাটা টাইম মেশিনে ঢোকার মতো। রোমান সম্রাজ্যের সোনালি দিনে তৈরি মুদ্রা, চিত্রকর্ম, মূর্তি, অস্ত্রগুলো দেখতে দেখতে যেনো মনে হয় আমরা সেই সময়ে চলে গেছি। কিছুক্ষণ টাইম ট্রাভেল করে আবার পা বাড়ালাম রিয়ালতো ব্রিজের দিকে।
চলবে...
বাংলাদেশ সময়: ০৩০০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৫, ২০১৬
এএ
ইতালি ভ্রমণ-১
** ভেরোনো শহরে জুলিয়েটের বাড়ি