নাটোর থেকে: যাকে বলে শুরুতেই আশাভঙ্গ। যাত্রা তখন গোপালপুর থেকে ওয়ালিয়ামুখী।
সুধীর! ঢাকা থেকে লালপুর অব্দি জেনে এসেছি, সুনীল ঘোষের বিখ্যাত গুড়ের সন্দেশ ও ছানা জিলাপি। অর্থাৎ, নামটি সুধীর, সুনীল নয়।
শুধরে দিলেন মুখোমুখি বসা অর্থনীতির ছাত্র মামুনও, ঠিক জায়গাতেই যাচ্ছেন। বেশ কয়েক বছর হলো উনি ইন্ডিয়া (ভারত) চলে গেছেন। তবে দোকান একই আছে। জিলাপি-সন্দেশও পাবেন।
সে না হয় সুনীলকে সুধীর মানা গেলো, কিন্তু রামহীন অযোধ্যার কী হাল- গন্তব্যের দূরত্ব কমার সঙ্গে সঙ্গে সেই শঙ্কাই ভর করতে লাগলো।
‘এই তো একটু সামনে। একটু এগিয়ে গিয়ে হাতের বামে। চলেন আমিই নিয়ে যাচ্ছি’।
ওয়ালিয়া বাজার মোড় থেকে মামুনের পিছু পিছু বিশ পা যেতেই, এই যে দোকান।
এটাই?
হ্যাঁ, এটাই। বলে মামুনের প্রস্থান।
দোকানের ওপরে ডানদিকে সাইনবোর্ড, ওয়ালিয়া মিষ্টান্ন ভান্ডার। সামনে একপাশে একতাড়া চেলা কাঠ, অন্যপাশে দু’টো কুকুর আধাশোয়া। দোকানে ঢুকেও আহামরি কিছু লাগলো না। এই দোকান নাকি ৮০ বছরের পুরনো!
সেটি জানলাম অবশ্য অরূপ কুমার ঘোষের কাছ থেকে। তার পরিচয় একটু পরেই দেওয়া হবে।
আপতত তার কাছ থেকে ৮০ বছরের বিষয়টি এগিয়ে নেওয়া যাক, হ্যাঁ, আজ থেকে ৮০ বছর আগে সুরেন্দ্রনাথ ঘোষ দোকানটি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত উনি দোকান চালান। সুরেন্দ্র বাবু প্রায় ৬২ রকমের মিষ্টি বানাতে পারতেন। ৬৬ সালের পর ওনার ছেলে সুধীর কুমার ঘোষ দোকানের হাল ধরেন। তিনি বাবার মতো এতো পদের মিষ্টি বানাতে না পারলেও তার নিজস্ব কায়দায় বানানো খেজুরের গুড়ের সন্দেশ ও ছানার জিলাপি মিষ্টিপ্রিয়দের মনে জায়গা করে নেয়। তার সরাসরি শিষ্য আবার অরূপ কুমার।
‘আমি ২৪ বছর ধরে এই দোকানে রয়েছি। কাজ শেখার পর ১৯ বছর ধরে মিষ্টি বানাচ্ছি। ওনার কাছ থেকেই আমার এসব শেখা। উনি থাকতে প্রধান কারিগর আমিই ছিলাম’।
মিষ্টি খেয়ে বেরোচ্ছিলেন স্থানীয় ব্যবসায়ী অসীম চক্রবর্তী। সরাসরি পাকড়াও তাকে। প্রশ্ন ওই একটাই, কী পার্থক্য সুধীর-অরূপে!
সত্যি কথা যদি বলেন, মান একই। আরে ভাই কারিগরতো একই। আর এমনিতেও পাঁচ বছর আগের গুড়ে যে মজা, তা কি আর এখনকার গুড়ে আছে? উল্টো প্রশ্নকর্তাকেই প্রশ্ন!
যোগ করেন, ভাই সব দিক বিবেচনা করলে মিষ্টির মান ঠিকই আছে। আমার কাছে তো তাই।
তা সুধীর বাবু চলে গেলেন কেনো?
ওনার একমাত্র ছেলে ইন্ডিয়া পড়তো। এখন সে ওখানে চাকরি করে। ছেলের সঙ্গে থাকতেই এসব ছেড়ে ইন্ডিয়া চলে গেছেন।
ফিরে আসি অরূপ বাবুর কাছে। প্রশ্ন শুনে মুচকি হেসে উত্তর, সন্দেশ-জিলাপি বানাতে আমরা সবকিছুর সেরাটাই দেই। অর্ডার দিয়ে একদম সেরা খেজুরের গুড়টাই আনাই। সঙ্গে নিজেদের বানানো ছানা। মিষ্টির তীব্রতা কমাতে একটু চিনিও মেশানো হয়।
তবে একটু আলাদা করে বললেন, গুড়ের সন্দেশ পাওয়া যায় বছরের অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি। কারণ, এই সময়টিতেই খেজুরের রস ও গুড় মেলে। বাকি সময় চিনি দিয়ে বানানো হয়।
এবার একটু পরখ করে দেখার পালা। বলতেই সামনে চলে এলো সন্দেশ আর ছানার জিলাপি। সন্দেশ গোল শুকনা মিষ্টি। গুড়ের হলেও চিনি মেশানো থাকে বোঝা যায়। ধারণা ছিল গুড়ের মতোই স্বাদ হবে। কিন্তু না, গুড়ের গন্ধটাই আলাদা করেছে একে। খেয়ে তার প্রমাণ মিললো ভালোভাবেই। একবার মুখে পুরলে আরেকবার খেতে মন চাইবে।
জানতে চাইলে বলেন, গুড় বেশি দিলে তো খাইতে পারবেন না। গন্ধটাই আসল।
ছানার জিলাপটি কিন্তু রসে টইটম্বুর। মাখনের নরম। চিনির সিরায় ডুবানো এ জিলাপি মুখে দিলেই মুহূর্তে শেষ হয়ে যায়।
বিখ্যাত এ সন্দেশ-জিলাপি চাই? নাটোর শহর থেকে চলে যান ওয়ালিয়া বাজার। পড়েছে লালপুর উপজেলায়। সন্দেশ মিলবে কেজিপ্রতি ২শ’ ৪০ টাকা, জিলাপি ১শ’ ৫০ আর ৩শ’ ৫০ টাকায় কাঁচাগোল্লা।
অনেক দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ এ মিষ্টি খেতে এখানে আসেন। দোকানের চাকচিক্য নেই। কিন্তু গুণে-মানে ঠিক।
মিষ্টি খেয়ে বেরোতে বেরোতে ঘোর সন্ধ্যা। দোকান ছেড়ে একটু আগে জনা পাঁচেকের জটলা। ভবানীপুরের নাজমুল, হজরত, ওয়ালিয়ার মনসুরসহ অন্যরা খোশগল্পে মত্ত।
কাছে যেতেই, ভাই মিষ্টি খায়ছেন?
হ্যাঁ, খেলাম। কিন্তু সুধীরের নয়, অরূপের...
কথা শেষ না হতেই আত্মবিশ্বাসী জবাব, মালিক চেঞ্জ কিন্তু মিষ্টি এক!
বাংলাদেশ সময়: ০৮২৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৭, ২০১৬
এসএস/এএ/আইএ