[পূর্ব প্রকাশের পর]
ভ্যাটিকান থেকে বের হয়ে পথে দেখলাম একজন বাঙালি খাবারের দোকানের লিফলেট বিতরণ করছে। রাইস জাতীয় খাবারের ছবি আছে মনে হলো একনজর দেখে।
ওখান থেকে হোস্টেলে ফিরলাম বিকেল ৫টায়। প্ল্যান ছিলো সাড়ে ছটা নাগাদ আবার বের হবো। হাসনাইন রুমে গিয়েই ঘুম, আমি এটার সঙ্গে অভ্যস্ত। ও ৫ মিনিটের বিরতি পেলেও ৩০ সেকেন্ডের মাথায় নাক ডাকা শুরু করে। আবার ৫ মিনিট পরে ডাক দিলে সঙ্গে সঙ্গে উঠে রেডি হয়ে যায়।
ভাবলাম এই সুযোগে আমি একটু ফেসবুকিং করে নেই। ট্যাব নিয়ে শুয়ে পড়লাম। আর এই শোয়াটাই কাল হলো। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি নিজেও জানি না। ঘুম ভাঙলো রাত সাড়ে দশটায়। টয়লেট থেকে ঘুরে এসে আবারো ঘুম একবারে পরদিন সকাল পর্যন্ত।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই চলে গেলাম চিরকো মাসসিমো ট্রেন স্টেশনে। কাউচ সার্ফিংয়ে একটা ইভেন্ট দেখেছিলাম ফ্রি ওয়াকিং ট্যুর। মূলত সেই ইভেন্টটাতে অংশগ্রহণ করার জন্যই চিরকো মাসসিমোতে যাওয়া। পরবর্তী সাড়ে তিন ঘণ্টা হাঁটতে হবে। বিধায় নাস্তাটা হাল্কা করার জন্য শুধু স্যান্ডুইচ আর এস্প্রেসো কফি দিয়ে শেষ করলাম।
নাস্তা শেষ করে যখন ইভেন্টের নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছালাম ততক্ষণে ৪/৫ জন পৌঁছে গেছে। গিয়ে পরিচিত হলাম আমাদের গাইড লাউরা, জার্মানির ইলিয়োনা, কলাম্বিয়ার রিকার্ডো এবং আর দু’জনের সঙ্গে। দেখতে দেখতে আমরা ১৭ জনের একটা দল হয়ে ট্যুর শুরু করলাম।
ট্যুরটা শুরু হলো রোমের জন্ম নিয়ে এক পৌরাণিক গল্প দিয়ে। জনশ্রুতি আছে ভাই রেমুসকে হত্যা করে রোমুলুস দলবল নিয়ে প্যালাটিনো বা প্যালাটিন হিলে প্রাসাদ নির্মাণ করার মাধ্যমে রোমের গোড়পত্তন করেন। কিন্তু তারা বর্বর ও অত্যন্ত নোংরা হওয়ায় কেউ তাদের কাছে মেয়ে বিয়ে দিত না। তাই তারা একবার চক্রান্ত করে আশপাশের গ্রামের সবাইকে সপরিবারে দাওয়াত দেয় পর্যাপ্ত মাংস ও মদিরার লোভ দেখিয়ে।
রাতে যখন দাওয়াতপ্রাপ্ত পুরুষেরা মদিরার নেশায় বুঁদ তখন রোমানরা সবার মেয়েকে অপহরণ করে। পরদিন সকালে মদিরার নেশা কাটার পরে যখন যুদ্ধ বাধার উপক্রম তখন মেয়েরা রোমানদের সঙ্গেই থেকে যাওয়ার সম্মতি দেয় এবং এভাবেই বিকাশ পায় রোমান সভ্যতা। এই প্যালাটিনোর পাশেই চিরকো মাসসিমো যেটা একটি রথ প্রতিযোগিতার ময়দান ছিলো।
এরপরের গন্তব্য রজেতো কমুনালে বা গোলাপ বাগান। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে আনা প্রায় ১১০০ প্রজাতির গোলাপ গাছ আছে এখানে। বর্তমানে এটাকে রোমের অন্যতম রোমান্টিক জায়গা বলা হলেও এর পূর্ব ইতিহাস সম্পুর্ণ বিপরীত। প্রায় ৩শ’ বছর ইহুদিদের অস্পৃশ্য মনে করে শুধু এই জায়গাতেই ইহুদিদের কবর দেওয়ার অনুমতি ছিলো, যেই কবরগুলোকে পরবর্তীতে সাধারণ কবরস্থানে রূপান্তর করে সেখানে গোলাপ বাগান করা হয়। এরপরের গন্তব্য কোল্লে আভেন্তিনো বা অ্যাভেন্টাইন হিল। জনশ্রুত জনৈক রোমান সম্রাট (নাম ভুলে গেছি) তার প্রাসাদ বর্ধনের জন্যে প্যালাটিনোতে বসবাসরত রোমের সম্পদশালী ব্যক্তিদের বাসস্থান ত্যাগ করতে বলেন। তখন সম্পদশালী ব্যক্তিরা কোল্লে আভেন্তিনোতে তাদের নতুন বাসস্থান নির্মাণ করেন। একটি বিতর্তিত প্রবাদ, ইতালির প্রথম কমলা চাষ এই কোল্লে আভেন্তিনোতেই করা হয়েছে।
সেখান থেকে গেলাম সবচেয়ে প্রাচীন যিশু খ্রিস্টের ছবি দেখতে বাজিলিকা দি সান্তা সাবিনা আল্লাভেন্তিনোতে। সাবিনা, একজন বিধবা রোমান গৃহকর্ত্রী। তাকে রোমান সম্রাট ভেস্পাসিয়ান হত্যা করার আদেশ দেন কারণ তিনি খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন। তাকে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত করেছিলো তারই ভৃত্য সেরাপিয়া। এই সেরাপিয়া যিশু খ্রিস্টের ক্রশবিদ্ধ হওয়ার দৃশ্যের একটি ছবি বানিয়েছিলেন এবং বিতর্কিত প্রবাদ, ক্রুসিফিকেশনের সেটাই প্রথম ছবি। পরবর্তীতে সাবিনার বাসভবনের ওপর একটি গির্জা নির্মাণ করা হয় বাজিলিকা দি সান্তা সাবিনা আল্লাভেন্তিনো যেটা এখন পর্যন্ত টিকে থাকা সবচেয়ে প্রাচীন রোমান বাজিলিকা।
এখনো অস্তিত্ব আছে ক্রসেডারদের তেমনি একটি সংগঠনের প্রধান কার্যালয় আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ছিলো। মজার ব্যাপার এই ক্রুসেডারেরাও সার্বভৌম। এই ক্রসেডার সংগঠন শুরু থেকেই অন্য ক্রুসেডারের মতো যুদ্ধ না করে বরং গরিব ও অসুস্থদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছে যেটা এখনো চলমান। এরপরে আগালাম ফরো বোয়ারিউম এর দিকে যেটা প্রাচীন রোমের গবাদি পশুর বাজার ছিলো। তেম্পিও দি এরকোলে ভিঞ্চিতরে বা হারকিউলিসের মন্দির এই বাজারটার পাশেই অবস্থিত। প্রবাদমতে হারকিউলিসের দশম চ্যালেঞ্জ ছিলো ইউরেস্থিয়াসের জন্যে দানব জেরিয়ানের গবাদিপশু উদ্ধার করে নিয়ে আসতে হবে। চ্যালেঞ্জ শেষ করে এসে হারকিউলিস যে যায়গায় বসে বিশ্রাম নিয়েছিলো সেখানেই মন্দিরটা বানানো হয়েছে।
এরপরে দেখলাম মিথ্যাবাদী গৃহবধূ শনাক্তকরণ যন্ত্র। বিশাল একটি গোলাকার মাথা যার মুখ বড়সড় হা করা। প্রাচীনকালে কোনো গৃহবধূ মিথ্যা বলছে এমন সন্দেহ হলে তার স্বামী তাকে নিয়ে এই মন্দিরে আসতো। তখন স্ত্রীকে সেই মুখের মধ্যে হাত দিয়ে যে প্রশ্ন করা হতো তার উত্তর দিতে হত। যদি উত্তর মিথ্যা হতো তাহলে মুখটি সেই হাত খেয়ে ফেলতো। তবে জনৈক রমনীর ফাঁদে পা দিয়ে বোকা হয়ে রাগে/ক্ষোভে যন্ত্রটি বেশ কয়েকশো বছর হয়েছে কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।
এরপরে তেএত্রো দি মারচেল্লো বা থিয়েটার অফ মারসেল্লো, দুই হাজার বছরেরও বেশি বয়সের একটি মুক্তমঞ্চ। নানা হাত ঘুরে ১৩শ’ শতক থেকে এটা সাভেল্লি পরিবারের সম্পত্তি যেখানে এখনো তাদের বংশধরেরা বসবাস করে। সেখান থেকে একটু আগালেই জুইশ ডিস্ট্রিক্ট শুরু। বেশ কয়েকশো বছর যেহেতু ইহুদিদের অস্পৃশ্য মনে করা হতো তাই তাদের শুধু রোমের এই এলাকাতেই থাকার অনুমতি ছিলো, যেখানে তাদের কাটাতে হয়েছে অত্যন্ত মানবেতর জীবন। এই জুইশ ডিস্ট্রিক্টেই রয়েছে ফন্তানে দেল্লে তারতারুগে বা দা টারটেল ফাউন্টেন। এটা বানানোর সত্যি ইতিহাসটা আমাকে ততটা টানেনি যতটা টেনেছে এটা নিয়ে প্রচলিত রূপকথায়। বলা হয়, প্রখ্যাত মাত্তেই পরিবারের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয় এক ইহুদি যুবকের। কিন্তু বাগদানের আগেই কোনো এক কারণে মাত্তেই কর্তা বিয়েতে অমত জানান। তখন যুবক হবু শ্বশুর কে খুশি করতে একরাতের মধ্যে শ্বশুরের বাসার সামনে ফাউন্টেনটা বসানোর ব্যবস্থা করে। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ফাউন্টেনটি দেখতে পেয়ে খুশি হয়ে মাত্তেই কর্তা বিয়েতে মত দেন। এই গল্প দিয়েই শেষ হয় আমাদের সাড়ে তিন ঘণ্টার ওয়াকিং ট্রিপ। যদিও ট্রিপটা ফ্রি তবে গাইড ডোনেশন গ্রহণ করে, অসম্ভব ভালো গাইডিং করায় আমরা সবাই যার যার মতো করে তাকে ডোনেট করে বিদায় নিলাম।
বিদায় নেওয়ার সময়ই আমাদের গ্রুপের ইতালিয়ান ছেলেটার কাছে জানতে পারলাম কাছেই রয়েছে বেশ সুস্বাদু ও বিখ্যাত এক ইতালিয়ান পিৎজারিয়া। আমরা কয়েকজন চললাম ওর সঙ্গে লাঞ্চ করতে। যেয়ে দেখি বাইরে থেকেই লাইন শুরু হয়েছে এবং আশেপাশের মানুষ আসছে স্রোতের মতো, বুঝলাম ছেলেটার কথা মিথ্যে না। তিন রকমের পিৎজা, ব্রেড এবং একটি মিষ্টি জাতীয় খাবার নিলো হাসনাইন আমাদের দুজনের জন্যে। এরপরে সবাই মিলে এগিয়ে একটা চার্চের সামনে বসে দুপুরের খাওয়া শেষ করলাম। খাওয়া শেষে ওখানে বসেই আড্ডা মারলাম কিছুক্ষণ।
এরপরে একেএকে বিদায় নিতে শুরু করলো সবাই। শেষ পর্যন্ত টিকে থাকা আমরা দুজন, স্পেনের রোজ়, জার্মানির ইলিয়না আর পোল্যান্ডের ২টা মেয়ে যেদিকে যাচ্ছি তার উলটো দিকে ইতালিয়ান ছেলেটার বাসা হওয়ায় সেও বিদায় নিলো। এদের মধ্যে রোজের সঙ্গে আমার পরিচয় অ্যাভেন্টাইন হিলে যাওয়ার সময়, সূত্রপাত ভ্যাটিকান নিয়ে, আগের দিনই ঘুরে আসায় ওর প্রশ্নের উত্তরগুলো দিতে পারছিলাম সহজেই। এরপরে বাকি ট্যুরে একসঙ্গেই থাকায় ওর সঙ্গে বন্ধুত্বটা অন্যদের তুলনায় ভালো হয়েছিলো।
আমাদের সবারই গন্তব্য ছিলো ক্যাম্পো দে ফিওরি, তাই একসঙ্গেই পা বাড়ালাম। ‘সূর্য নয়, পৃথিবীই সূর্যের চারিদিকে ঘোরে’ এই চিরন্তন সত্য কথাটা প্রথম বলেছিলেন জিওরদানো ব্রুনো। এ কারণে তাকে চার্চের রোষানলে পরতে হয়েছিল কারণ, চার্চের মতবাদ ছিলো সূর্য পৃথিবীর চারিদকে ঘোরে। সেই সময় দেশের শাসনভার চার্চের হাতে থাকায় তাদের ক্ষমতাও ছিলো ব্যাপক। তাই চার্চের মতবাদ অস্বীকার করার অভিযোগে এই ক্যাম্পো দে ফিওরিতেই জিওরদানো ব্রুনোকে ১৬০০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি পুড়িয়ে মারা হয়। সেখানে এখন তার একটি মূর্তি রয়েছে।
ব্রুনোকে শ্রদ্ধা জানিয়ে পা বাড়ালাম পিয়াতসা নাভোনার দিকে। সেখানে কিছু সময় কাটানোর পরে ইলিয়না এবং পোল্যান্ডের দুজন বিদায় নিলো। এরপরে আমরা তিনজন পা বাড়ালাম প্যান্থিওনের দিকে। তবে ভেতরে ঢোকার আগে বেশ আয়েশ করে একটা করে জিলাটো খেয়ে নিলাম সবাই। এরপরে ভেতরে ঢুকে সবথেকে সুন্দর লেগেছিলো বিশাল ডোমটা দেখে যেটার ঠিক মাঝখান দিয়ে খোলা আকাশ দেখা যায়। তবে পরে অবাক হয়েছি জানতে পেরে যে, শুধু সৌন্দর্যই নয় বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়েও ডোমটা অনন্য। তৈরির প্রায় ২ হাজার বছর পরেও প্যান্থিওনের ডোম এখনও বিশ্বের বৃহত্তম আনরিইনফোর্সড কংক্রিটের ডোম। সেখান থেকে বের হয়ে আমাদের পথ আলাদা ছিলো, তাই রোজ আমাদের দুজনের থেকে জার্মানিতে আসার দাওয়াত নিয়ে এবং আমাদের স্পেনের ভ্যালেন্সিয়াতে যাওয়ার দাওয়াত দিয়ে বিদায় নিলো।
আমাদের এরপরের গন্তব্য ছিলো কোলোসসেও বা কলিসিয়াম। এটি রোম শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত এবং এখন পর্যন্ত তৈরি পৃথিবীর সর্ববৃহৎ অ্যাম্পিথিয়েটার যেটি মূলত উপবৃত্তাকার। আমরা যখন পৌঁছালাম তখন ৬টা বেজে ১০। আগের দিন ইন্টারনেটে দেখেছিলাম ৭টা পর্যন্ত খোলা থাকে তাই হাতে ঢোকার মতো সময় আছে। কিন্তু যেয়ে দেখলাম ৭টা পর্যন্ত খোলা থাকে ঠিক তবে ভেতরে ঢোকার শেষ সময় ৬টা। তাই কি আর করার বাইরে থেকেই এর সৌন্দর্য উপভোগ করে আগাতে থাকলাম পিয়াতছা ভেনেতছিয়ার দিকে। ফরো দি নের্ভা হয়ে পিয়াতছা ভেনেতছিয়া পৌঁছালাম। সেখানে কিছু সময় কাটিয়ে বাস এবং ট্রেনে করে পৌঁছলাম ভিত্তরিও ইমানুয়েলে। এখানে শপিং সেন্টার খোলা পেলাম না, তবে বাংলাদেশি এক রেস্টুরেন্ট খোলা পেলাম। সেখানে বিফ বিরিয়ানি, প্রন বিরিয়ানি, বিফ ভুনা দিয়ে একদম দেশি কায়দায় গলা পর্যন্ত গিলে রাতের খাওয়া শেষ করলাম। হাসনাইন আবশ্য এরপরে রসমালাইও খেয়েছিলো।
সেখানে থেকে সোজা হোটেলে, আর এর মধ্যেই শেষ হলো আমাদের রোম সফর। অসম্ভব ভালো কিছু মুহূর্ত আজীবনের জন্যে সঙ্গী হলো এবং সেই সঙ্গে আরো যুক্ত হলো ইতিহাসের সাক্ষী নানা দর্শনীয় স্থানের সঙ্গে পরিচয়।
বাংলাদেশ সময়: ০০২৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২০, ২০১৬
এমজেএফ
** ইতালি ভ্রমণ-৫: বিশ্বের সবচেয়ে ছোট দেশ ভ্যাটিকানে
** ইতালি ভ্রমণ-৪: ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের দেশে
** ইতালি ভ্রমণ-৩: ভেনিসে দেখা নৌকাবাইচ
** ইতালি ভ্রমণ-২: খাল-জল-নৌকার ভেনিসের পথে
** ইতালি ভ্রমণ-১: ভেরোনো শহরে জুলিয়েটের বাড়ি