চলে মুসাফির নির্জন পথে, দুপুরের উঁচু বেলা,
মাথার উপরে ঘুরিয়া ঘুরিয়া করিছে আগুন-খেলা।
পথ নির্জন।
এমন আলো-আধারের মাঝেও সদরঘাটে মানুষের কোলাহল-ব্যস্ততার কমতি নেই। দেখে মনে হলো যেন মধ্যদুপুরের কর্মযজ্ঞ। রিকসা-ভ্যান ও মানুষের ফাক-ফোকর পেরিয়ে কোনো রকম লালকুঠি ঘাটে পৌঁছুলাম।
সূর্য তখন উঠি উঠি করছে। কিন্তু তার আগমনি আলো আছড়ে পরেছে নির্যাযিত বুড়িগঙ্গার ওপরে। কত মানুষের এপার-ওপার! জীবনের জন্য কত সংগ্রাম।
বুড়িগঙ্গা আজ মৃত নদী। দেখে মনে হয় যেন ‘ঘাটের মরা’। কিন্তু তারপরও ঢাকাকে বাঁচিয়ে রাখতেই তার বেচেঁ থাকা।
প্রকৃতিতে এখন ‘শীত’। তাই জসীম উদদীনের ভাষায় মধ্য দুপুরের উঁচু বেলাতেও মাথার ওপর আগুনের খেলা নেই। সকালের শীতলতা আর মধ্য-দুপুরের মিষ্টি-উষ্ণতায় নৌকায় আছড়ে পড়া ঢেউয়ের আওয়াজ মনে করিয়ে দেয় আমার শৈশবের নদীমাতৃক জীবনের কথা...।
নৌভ্রমণের এখনই সময়। গরম চাদর গায়ে জড়িয়ে ভোরের কুয়াশার চাদর ভেদ করে উঠে পড়ুন কোনো নৌকা-লঞ্চ বা জাহাজে। বেড়িয়ে পড়ুন অজানার সন্ধানে। সকালের প্রথম সূর্যকে স্বাগত জানান নদীর বুক থেকেই।
কিন্তু বাঙালিতো ভ্রমণপিপাসু নয়। ভ্রমণ বাঙালির কাছে বিলাসিতা। জানিনা ভ্রমণ বিলাস শব্দটি এ কারণেই এসেছে কিনা। ‘দেখা হয়নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হইতে দুই পা ফেলিয়া’র মতো সত্য দর্শন আমাদের জীবনে আর নাই। পর্যটন আমাদের কাছে বর্ষ উৎযাপনের মতো আনুষ্ঠানিকতার মাঝে সীমাবদ্ধ। ‘পর্যটন জীবন’ আমরা যাপন করিনা।
যথা সময়েই ঢাকা ছাড়লো ‘গ্রীনলাইন’। মাস কয়েক হয়েছে ঢাকা-বরিশালের এপথে নতুন লঞ্চ সার্ভিসটি চালু হয়েছে। পাঁচ ঘণ্টার ক্লান্তিহীন নদী ও প্রকৃতি দর্শনে পৌঁছে যাবেন প্রাচ্যের ভেনিসে।
বুড়িগঙ্গার সৌন্দর্যতো আজ কালিমালিপ্ত। কিন্তু তারপরও এ নদীর দুই পাড়ে চোখে পড়বে অবারিত সৌন্দর্য। ঢাকা থেকে যতই দক্ষিণে যাই বুড়িগঙ্গার দুই তীর ততোই সবুজ হতে থাকে। নদীও বড় হতে থাকে। কমতে থাকে ইট-কাঠ-পাথরের দৌরাত্ব। ধোঁয়া আর কালো পানির প্রবাহ ধীরে ধীরে কমতে থাকে। নীল হতে থাকে জলস্রোত। বুড়িগঙ্গার ব্যস্ততাও কমতে থাকে। কমতে থাকে লঞ্চ-জাহাজ –নৌকার আনাগোনাও।
ফি বছর ঢাকার গতানুগতিক বিনোদন স্পটগুলো দেখে যারা হাপিয়ে উঠেছেন ঢাকা-বরিশালের এ আনন্দ ভ্রমণ তাদের জন্য এক ভিন্ন মাত্রা এনে দেবে।
আমি বরিশাইল্ল্যা। জাহাজের বাকি যাত্রীরাও আমার মতো বরিশাইল্ল্যা। কেউ যাবেন শহরে, কেউ কাশিপুর, কেউ বাবুগঞ্জ-বানারিপাড়া। কেউ যাবেন কাউয়ার চর-কেউ পাতার চর-সব আমরা আমারাইতো। জীবিকার সন্ধানে সবাই ঢাকায় আসেন, ঢাকায় থাকেন।
ধান-নদী-খাল- এই তিনে বরিশাল। এ সবই আজও আছে। কিন্তু তার রূপের আগুন হয়তো আজ কিছুটা নিভু নিভু। যৌবন ভরা অঙ্গে আজ বয়স ও অযত্বের ছাপ। খালে আজ আর আগের মতো পানি নেই। নেই মাছ। ভরা নদীর বাকে বাকে জেগে উঠেছে চর।
শেষ বার যখন এ পথে গিয়েছি নদীতে দেখেছি জেলেদের আনাগোনা। জেলেরা জাল থেকে ইলিশ মাছ উঠিয়ে আমাদের দেখিয়েছে। জেলের হাতে সদ্য ধরা পরা ইলিশ মাছ তখনো লাফাচ্ছে। এবার ইলিশ মাছ না দেখলেও জাল নিয়ে জেলেদের কসরতের কমতি ছিলনা। দিন শেষে হয়তো যাই হোক কিছু মাছ নিয়েই ফিরবেন তারা। কেউ হয়তো চর থেকে জমি চাষ করে ঘরে ফিরছে। নদীর ঢেউয়ের মতোই দোদুল্যমান তাদের জীবনগাথা। হাসিমুখে নিয়তিকে মেনে নেয়াই তাদের কাছে জীবন।
তাই বুঝি রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,
‘ডিঙ্গি চড়ে আসে চাষী কেটে লয় ধান, বেলা গেলে গাঁয়ে ফিরে গেয়ে সারি গান। ’
জেলে নৌকার পাশাপাশি চোখে পড়লো আরো অনেক ডিঙ্গি বা কোষা নৌকা। নদীর পাড়ের মানুষের জীবনে এরকম ডিঙ্গি বা কোষা প্রতিদিনের সঙ্গী। বর্ষায় প্রায় প্রত্যেকের বাড়িতেই থাকতো এরকম নৌকা। তাল বা কলা গাছের ভেলাও ছিল বর্ষার সঙ্গী। অত্যাধুনিক এ লঞ্চের ছাদে বসে স্মৃতিতে ভেসে উঠেছে সেই সব পুরোনো দিনের কথা।
ভিডিও
নদীর বুকে সাদা মেঘের ভেলার মতো ভেসে যাচ্ছে ফেনা আর সারি সারি কচুরিপানা। ঢেউয়ের ভাজে ভাজে খেলা করে পানকৌড়ি অথবা সাদা বক।
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত’র ‘দূরের পাল্লা’ ছড়াটি পড়েননি এমন কেউ কি আছে? ‘ছিপ খান তিন দাঁড়, তিনজন মাল্লা’---এরকম তিন মাল্লার নৌকা দেখেছি অনেক। দেখেছি বিস্তীর্ণ নদীর বুকে নৌকা ভাসিয়ে তাদের জীবন সংগ্রাম। ক্লান্তিহীন তাদের বৈঠা চালানো। দিনের প্রথম আলোতে তারা নদীর বুকে নৌকা ভাসায় আবার শেষ আলোকে বিদায় দিয়ে তবেই তারা ঘরে ফেরে।
দক্ষিণে যাদের বাড়ি নয়, নদীর ঢেউকে যারা ভয় পান, তাদের জন্য বছরের এ সময়টা ঢাকা-বরিশাল নৌভ্রমণের জন্য উপযুক্ত সময়। নদী এখন পুরো শান্তু। এর বুকে এখন যে ঢেউ খেলা করে তা লঞ্চের গায়ে কোনো স্পন্দন জাগাবেনা। যাত্রীদের হৃদয়ে হয়তো মৃদু স্পন্দন জাগাতে পারে। বর্ষার উত্তাল নদী এখন শান্ত ও সৌম্য নীল দরিয়া।
শীতের এ সময়ে ভ্রমণের মজাই অন্য রকম। রঙ বেরঙের নৌকার বহর এখন চোখে না পড়লেও হঠাৎ হয়তো চোখে পড়বে বেদে নৌকার বহর। নৌকাতেই তাদের বসবাস-ঘর সংসার-সন্তান-জন্ম-মৃত্যু। এভাবে প্রকৃতির নানা সৌন্দয্যের বিহারের উপভোগে এগিয়ে চললো আমাদের জাহাজ। উচ্ছ্বাসে ভরা নদীর এ সৌন্দর্য অবর্ণনীয়।
নদীতে এখন মাছ ও জেলের আধিক্য নেই সত্য। তবুও দেখা মিলবে পানকৌড়ি অথবা বকের সারি। হয়তো কোনো জেলে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানাবে যাত্রীদের।
পুরো শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এ জাহাজে আছে দুটি শ্রেণি। প্রথম শ্রেণির (দোতলা) ভাড়া ১০০০ টাকা আর দ্বিতীয় শ্রেণির (নীচ তলা) ভাড়া ৭০০ টাকা। দুটো শ্রেণিতেই যথেষ্ট আরাম ও স্বাচ্ছন্দের সাথে ভ্রমণ করা যায়। চারপাশে গ্লাস মোড়ানো এ জাহাজ থেকে উপভোগ করা যায় নদীর অপার সৌন্দর্য। আছে কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট। মান বেশ ভালোই। নীচ তলায় আছে খাবারের দোকান। চা-কফির ব্যবস্থাতো আছেই। সকাল সাতটায় যাত্রা শুরু করে বরিশাল পৌঁছায় ১২ টায়।
যদি ঢাকা ফেরার তাড়া থাকে তবে ওই দিনই ফিরে আসতে পারেন। ফিরতি জাহাজ ছাড়ে ২ টায়। তবে অন্তত দুই-একদিন থেকে ঘুরে আসুন প্রাচ্যের ভেনিস-বরিশাল। ইতিহাস আর ঐতিহ্যের বরিশাল। থাকার জন্য ভালো আবাসিক হোটেল আছে অনেক। ভাড়া হাতের নাগালেই। বরিশাল এক প্রাণবন্ত শহর। শহর থেকে একটু বাইরে গেলেই দেখবেন সবুজের খেলা। আছে ঐতিহাসিক কিছু নিদর্শনও।
ঢাকার কর্মব্যস্ত ও কোলাহলমুখর জীবন থেকে অন্তত একদিনের ছুটি নিয়ে ঘুরে আসুন প্রাণের শহর প্রাচ্যের ভেনিস-বরিশাল।
ভিডিও:
বাংলাদেশ সময়: ০৬২৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৪, ২০১৬