ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

রোয়াংছড়ির পথে পথে-৪

ঝিরি-পাথরে আছাড় খেয়ে সুন্দরী তিনাপ সাইতারে

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫১১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৪, ২০১৬
ঝিরি-পাথরে আছাড় খেয়ে সুন্দরী তিনাপ সাইতারে ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বান্দরবান ঘুরে: আজও প্রায় এক ঘণ্টা দেরি। এটি নিয়মে পরিণত হয়েছে।

বলাই ছিলো ঠিক সকাল সাড়ে সাতটায় বের হবো, দেখা গেলো সাড়ে আটটার বেশি বেজে গেছে। রনিন পাড়া ছাড়িয়ে আরও প্রায় আধ ঘণ্টা হেঁটে দেবাছড়া পাড়ার ঢালটা নামতে শুরু করতে না করতেই সামনের পাহাড়ি উপত্যাকায় হাজির মেঘের দল।

পূর্ব অভিজ্ঞতায় জানি ব্যাটারা একা আসেনি। সঙ্গে জলকণা নিয়ে এসেছে। চিৎকার করে সবাইকে সতর্ক করতে না করতেই ঝমাঝম বৃষ্টি এলো আর উধাও হলো পাঁচ মিনিটের মধ্যেই। মাঝখান থেকে এই খাঁড়া রাস্তা পিচ্ছিল করে দিয়ে গেলো। দূর থেকে পাড়া দেখা যাচ্ছিল। ট্রেইলে দূরে কোনো পাড়া দেখা গেলে স্বস্তি হয়।

আমাদের কিন্তু থামলে চলবে না, যেতে হবে বহুদূর। দেবাছড়া হয়ে আমরা এবার ঝিরিতে নামতে শুরু করলাম। একেবারে পাতালে, ফেরার পথে খবর আছে। ঝিরি ধরে ঘণ্টাখানেক চলার পর দুটো পাহাড় ডিঙিয়ে এক বিশাল চড়াইয়ের মাথায় এসে পৌঁছালাম। এবার নামতে হবে। এ পর্যন্ত নাকি শুকনো মৌসুমে কাঠের গাড়ি আসে। বর্ষায় অবশ্য পুরো রাস্তা ভেঙে একাকার।
দূর থেকে দেখা যাচ্ছে পাইন্দু খাল। আমরা চলেছি এ খালের উপরেই এই মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ঝরনাধারা তিনাপ সাইতারের উদ্দেশ্যে। গাড়ির রাস্তা ধরে খাড়াই  নামতে হলো। আলগা মাটি এবং পাথরের খণ্ড পথের সর্বত্র। পা হড়কালে কিন্তু আহত হওয়ার ভয় আছে। এর মধ্যে গাইড আসাঙের এক ইয়া মোটা বিশাল এক গোখরা সাপকে ধাওয়া করা নিয়ে উত্তেজনা। এই করতে করতেই পাইন্দু খালে এসে নামলাম।

তাপমাত্রার পারদ বেশ চড়েছে। ঘেমে নেয়ে একাকার। খাল থেকে উঠে আবার গাড়ির রাস্তা ধরে যেতে হয়। এ রাস্তা একেবারে রুমা উপজেলা পর্যন্ত চলে গেছে। তিনাপ সাইতারে কিন্তু রুমা হয়েও আসা যায়। রুমা হয়ে আসতে চাইলে বেথেল পাড়া, আত্তাহ পাড়া হয়ে আসতে হবে। আসাঙ জানালো তিনাপ সাইতার আর আধ ঘণ্টার রাস্তা। এবার পুরো পথই খাল ধরে যেতে হবে। আমরা উজানের দিকে যাচ্ছি।

পানির স্রোতের গতি দেখে বোঝা যাচ্ছে ঝরনা একেবারে ভরা যৌবনা। থানচির নাফাখুম রুটের সঙ্গে এর মিল রয়েছে। পথে এক জায়গায় অবিকল নাফাখুমের মতো ছোট একটি ক্যাসকেড চোখে পড়লো। এ ধরনের সুন্দর ক্যাসকেড, ঝিরি বা খাল ধরে চলার আনন্দ বাড়িয়ে দেয়। চারপাশেই এখন বিশাল পাহাড়ের সারি। তার উপরের আকাশ মেঘে ঢাকা। যে কোনো সময় বৃষ্টি নামতে পারে। আর বৃষ্টি নামলেই ফ্লাশ ফ্লাডের ভয়।

এ রাস্তায় কোনো জনবসতি নেই। পানির শব্দ আর ঝিঝির ডাক ছাড়া আর কিছুর অস্তিত্ব নেই। নিস্তব্ধতা মাঝে মধ্যে ভয়াবহ ভীতিরও জন্ম দেয়। সত্যি বলতে কি আমার ভয় করছিলো। এমনিতেই অনেক হ্যাপা করে এতদূর এসেছি। শাকিল ভাই একটু এগিয়ে গিয়েছিলেন। সামনে একটি বাঁক। তার আর আমার আমার মাঝে ব্যবধান ওই বাঁকটুকু, বাকিরা পেছনে। ওপার থেকে তার চিৎকার শুনলাম। ঝরনা না হয়ে যায়ই না। বাঁকটি পার হতেই বাকরুদ্ধ হওয়ার জোগাড়।

তিনাপ সাইতার তখনও বেশ কিছুটা দূরে। এখান থেকেই তার গর্জন শোনা যাচ্ছে। আহা কি তার রূপ! বর্ষা ধোয়া জলে চারপাশের অসহ্য সবুজের মাঝে চোখের ব্যালেন্স করছে দুধসাদা ঝরনাধারা। শুরু হলো ক্যামেরা বাটনে ক্লিক ক্লিক। কিন্তু তিনাপ সাইতার যে সহজে তার কাছে ঘেঁষতে দেবে না তা বুঝে গেলাম দু’টি আছাড় খেয়ে। দুরন্ত পিচ্ছিল বাকি পথ। পাথরের বড় বড় বোল্ডার পার হয়ে যেতে হয়।

তিনাপ সাইতারের গঠনের দিক থেকে বান্দরবানের আরও দু’তিনটি ঝরনার মিল থাকলেও এর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে পানি পতনের স্থান জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল বিশাল সব পাথর খণ্ড। হয়তো প্রাগৈতিহাসিক কোনো কালে এ জলপথ জুড়ে ছিলো তারাই। কোনো ভূকম্পনে ভূমিচ্যুত হয়ে তারা এখন মূল পথ থেকে সরে গেছে। সৃষ্টি হয়েছে অনন্যসাধারণ এ ঝরনা ধারার।

তিনাপ সাইতারের একপাশ জুড়ে আছে পাথরের বিশাল ব্যালকনি। কেউ তাঁবু খাটিয়ে ক্যাম্প করতে চাইলে তার জন্য এটি আদর্শ জায়গা। বাকিরা ইতোমধ্যেই চলে এসেছে। সামনের পাথরে উঠে ছবি তোলার প্রতিযোগিতা চললো। তিনাপ সাইতারে এরই মধ্যেই ঘুরে গেছেন অনেক মানুষ। কিন্তু তাদের ফেলে যাওয়া প্লাস্টিকের বোতল, চিপসের প্যাকেটসহ নানা চিহ্ন বুঝিয়ে দিচ্ছিলো আমরা সৌন্দর্য উপভোগ করতেই জানি, এর সংরক্ষণে আমাদের কোনো চিন্তা নেই।

সুন্দরীর সঙ্গ পেতে নাকি কিছু মূল্য চুকাতে হয়। ঝরনার পানিতে নিজের দামি ক্যামেরা বিসর্জন দিয়ে সেই মূল্য চোকালেন মনির ভাই। আমরাও আর দাঁড়ালাম না। অল্পক্ষণের মুগ্ধতাটুকুই থাকুক। বেশিক্ষণ থাকলে সুর কেটে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। ফিরতি পথে বৃষ্টির উৎপাত এবং দুরন্ত চড়াই ঠেলে যখন আবার আমরা দেবাছাড়া পাড়ায় হাজির ততক্ষণে বিকেল হয়ে গেছে। পেটে ছুঁচোও ডন দিতে শুরু করেছে। পাড়া থেকে আনাজপাতি সংগ্রহ করে খিচুড়ি রান্না হলো। খাওয়ার মধ্যেই আবার ঝুম বৃষ্টি। শেষ পর্যন্ত বৃষ্টি উপেক্ষা করে ভর সন্ধ্যায় রনিন পাড়া যখন পৌঁছালাম চোখে মুখে সবার লেগে আছে তৃপ্তির রেশ। তিনাপ সাইতার তুমি আর অদেখা নও।     

চলবে...

বাংলাদেশ সময়: ০৫০৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৪, ২০১৬
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।