২০ জানুয়ারি শুক্রবার। সকাল ৮টায় স্পাইস জেটের (এস জি-৪৮৮ ফ্লাইট) একটি সুপরিসর বিমানে করে কোলকাতা নেতাজী সুবাস চন্দ্র বোস আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে মুম্বাইর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম।
৩৪ হাজার ফুট উচ্চতায় স্পাইস জেট ছুটছে মুম্বাইয়ের উদ্দেশ্যে। সাথে একজন পাইলট, একজন কো-পাইলট, পাঁচজন মহিলা কেবিন ক্রু ও ২১২ জন যাত্রী। আকাশপথে বিশ্বমানের পুষ্টিকর খাবার সর্বজনবিদিত। আমাদের দেশে আভ্যন্তরিন বিমান পরিষেবায় তা কতটুকু রক্ষা করা হয় তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। স্পাইস জেটের বিমানটি অভ্যন্তরিণ রুটে যাতায়াত করলেও এতে নিরামিষ, আমিষ এবং চাইনিজ খাবারের ব্যবস্থা ছিল। এসব খাবার সুদর্শনা মহিলা ক্রুরা যাত্রীদের রুচি সাপেক্ষে বিতরণ করে থাকে। তবে নগদ টাকায় পছন্দের খাবার কিনে খেতে হয়। অবশ্য দাম থাকে স্বাদ এবং সাধ্যের মধ্যে।
সকাল ১০টা ৪২ মিনিটে আমাদের বহনকারী বিমানটি মুম্বাইয়ের ছত্রপতি শিবাজী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে রানওয়ে নিরাপদে স্পর্শ করে। কোলকাতায় প্রচন্ড শীত পড়ছে। বৃহস্পতিবার সকালে তাপমাত্রা ছিল ১৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস। আর মুম্বাইতে আবহাওয়ার অন্য চেহারা। রীতিমত শীতের পরিধান ত্যাগ করতে হলো। তাপমাত্রা ২৭ ডিগ্রী। ভাবতে লাগলাম প্রকৃতির কী খেয়াল। এক দেশে কতো রুপ! সম্ভবত, একেই বলে ভারত। হিন্দু পুরাণ মহাভারতে পড়েছিলাম ' যাহা নাই ভারতে, তাহা নাই জগতে; যাহা আছে ভারতে তাহা নাই জগতে'।
মনে মনে ভাবলাম আসলেই তাই। সন্ধ্যায় মুম্বাইয়ের কিছু দর্শনীয় স্পট দেখতে বের হলাম। কথায় আছে, রাতে নাকি মু্ম্বাইয়ের রুপ ঝরে পড়ে। রং বেরংয়ের বৈদ্যুতিক বাতির আলোর ঝলকানিতে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা এই নগরী অপরুপ হয়ে উঠে। সবকিছুতে যেন রঙের খেলা। রাত বাড়ার সাথে সাথে হোটেল, বার,ক্যাসিনোগুলো যেনো নবরুপে জেগে উঠে। এদিন প্রথমে গেলাম দাদর থানা এলাকায় অবস্হিত সিদ্বিনায়েক গণপতি মন্দিরে। এখানে হিন্দু দেবতা গণেশ- এর পূজা করা হয়। স্বর্ণের এই মূর্তিতে পূজা দিতে প্রতিদিন পঞ্চাশ হাজারের অধিক পূণার্থীর সমাগম ঘটে। মুম্বাইয়ের নামকরা সেলিব্রটি হতে শুরু করে মস্ত বড় ব্যবসায়ী রিলায়েন্স গ্রুপের কর্ণধার মুকেশ আম্বানিও নিয়মিত এই মন্দিরে আসেন।
১৮০১ সালের ১৯ নভেম্বর সিদ্বিনায়েক গণপতি মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়। এখানে ছবি তোলার আগ্রহ থাকলেও বিধিনিষেধ থাকায় তা সম্ভব হয়নি। সেখান থেকে ইন্ডিয়া গেইট ও তাজ হোটেলের সৌন্দর্য্য দেখতে গেলাম। আরব সাগরের পাড়ে এই দু'টির অবস্হান। নরিমন পয়েন্ট নামে এই এলাকা রাতে যে কী অপূর্ব সুন্দর হয়ে উঠে তা সরাসরি না দেখলে বিশ্বাস করানো যাবে না।
তাজ হোটেলের নাম উঠলে এখনও অনেকে আঁতকে উঠে। ২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর এই হোটেলে পাকিস্তানী জঙ্গি সংগঠন লস্কর ই তৈয়বার একদল সন্ত্রাসী এই হোটেলে সশস্ত্র হামলা চালায়। তিনদিন ধরে চলা এই হামলায় ১৬৪ জন মারা যায়। আহত হয় ৩০৮ জন। সেই হামলার অন্যতম কুশীলব মো. আজমল কাসাবকে ভারতের সর্ব্বোচ্চ আদালতের রায়ে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়।
১৯০৩ সালে প্রতিষ্ঠিত তাজ হোটেলের প্রকৃত নাম তাজমহল প্যালেস হোটেল। গেইট অব্ ইন্ডিয়া ও তাজ হোটেল থেকে ফিরে দেখতে গেলাম মুম্বাইয়ের প্রধান রেলওয়ে ষ্টেশন ঐতিহাসিক ভিক্টোরিয়া টার্মিনাস (ভিটি)। বর্তমান নাম ছত্রপতি শিবাজী টার্মিনাস। ১৮৮৭ সালে এটির কার্যক্রম শুরু হয়। এটি তৈরি করতে দশ বছর সময় লাগে। রাতে আলোর মেলা বসে এই সুপ্রাচীন ভবনে। পুরানো এই ভবনের নকশা ও সৌন্দর্য্য দেখতে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের ঢল নামে। সেখান থেকে দেখতে গেলাম ঐতিহাসিক হাজী আলী দরগাহ। তা-ও আরব সাগরের তীরে।
১৪৩১ সালে এই দরগাহ তৈরী করা হয়। এটি মুম্বাইয়ে বসবসকারী মুসলিম জনগোষ্ঠির কাছে একটি ধর্মীয় আবেগ ও বিশ্বাসের স্হান দখল করে রেখেছে। এখানে প্রতিদিন মুসলিম ছাড়াও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের হাজার হাজার দর্শনার্থীর সমাগম ঘটে। আগে এতে মহিলাদের নামাজ আদায়ে বিধিনিষেধ থাকলেও সম্প্রতি তা সকলের জন্য মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। কালের সাক্ষী ঐতিহাসিক এই দরগাহ সাঈয়েদ পীর হাজী আলী শাহ বুখারী নামে একজন মুসলিম ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠা করেন। একসময় তিনি ব্যবসা বানিজ্য ছেড়ে ধর্মীয় সাধনায় ব্রতি হন।
কালক্রমে তিনি আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিতি পান। ধর্ম সাধনার আগে তিনি অর্জিত সমস্ত সম্পদ তার প্রতিষ্ঠিত দরগাহ ও জনগনের মধ্যে বিলিয়ে দেন। দরগাহে তার কবর রয়েছে। মনোমুগ্ধকর কারুকাজে গড়ে তোলা এই দরগাহে রাতের রুপই আলাদা। বৈদ্যুতিক আলোর বলিরেখা আরব সাগরের পানি ভেদ করে পুরো দরগাহকে বিমূর্ত করে তোলে।
শনিবার দুপুরে গেলাম বলিউড সুপারস্টার অমিতাভ বচ্চনের বাড়ির দিকে। মুম্বাইয়ের জুহু এলাকায় তার দু'টি বাড়ি রয়েছে। একটিতে স্ত্রী জয়া বচ্চনকে নিয়ে তিনি এবং অপরটিতে তার ছেলে চিত্র নায়ক অভিষেক বচ্চন স্ত্রী চিত্র নায়িকা ঐশ্বরিয়া রায়কে নিয়ে থাকেন। একটির নাম জলসা, অন্যটি প্রতীক্ষা। সেখান থেকে শাহরুখ খান ও সালমান খানের বাড়ি দেখতে গেলাম। বান্দ্রার ব্যান্ড ষ্ট্রীটে দু'জনের বসবাস। শাহরুখ খানের বিশাল বাড়ি। নাম তার মেয়ের নামে। মান্নাত। ওখান থেকে আধ কিলোমিটারের ব্যবধান সালমান খানের বসবাসস্থল।
তিনি গ্যালাক্সী নামে একটি ভবনে থাকেন। অভিজাত এলাকায় অবস্হিত এই ভবনে তার দু'টি আ্যাপার্ন্টম্যান্ট রয়েছে। ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের রাজধানী মুম্বাইয়ে গত বছর শুধু চলচ্চিত্র শিল্পে প্রায় ৩ হাজার কোটি রুপির ব্যবসা হয়েছে। অর্থ, বিত্ত-বৈভব আর বিনোদনের নগরী মুম্বাই যেনো প্রতিদিন উন্নত থেকে আরও উন্নতর হচ্ছে। আর সৌন্দর্য্যের ক্ষেত্রে দিনকে দিন ভরা যৌবনে দিকে এগুচ্ছে।
লেখক: জেষ্ঠ্য সাংবাদিক
বাংলাদেশ সময়: ২২০৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২১, ২০১৭