ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

সাগর-পাহাড় ঘেরা গোয়ায় রূপ-লাবণ্যের মেলবন্ধন

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬০৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৫, ২০১৭
সাগর-পাহাড় ঘেরা গোয়ায় রূপ-লাবণ্যের মেলবন্ধন গোয়ার কালাঙ্গুট বিচ

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি ভারতের গোয়া। জনসংখ্যা এবং আয়তন-দুদিক দিয়েই ভারতের ৩০টি রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে ছোট রাজ্য গোয়া। ৩ হাজার ৭০২ বর্গমাইল আয়তনের এ রাজ্যে প্রায় ১৪ লাখ মানুষের বসতি। পাহাড়-পর্বত, নদী আর আরব সাগরের হাতছানি গোয়াকে করেছে মোহনীয়।

গোয়ার চারদিকে ৯টি সমুদ্র সৈকত থাকলেও ছোট ছোট সৈকত রয়েছে কমপক্ষে আরও ১০/১২টি। সবকটি সৈকতই আরব সাগর আর মহারাষ্ট্র ও কর্ণাটকের দুটি নদীর কোলে পাহাড়-পর্বতের ধারে অবস্থিত।

রূপ-লাবণ্যের মেলবন্ধনে অপরুপ গোয়ার সৌন্দর্য যেকোনো বয়সী মানুষকে সবসময় আকর্ষণ করে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

গোয়া দীর্ঘকাল পর্তুগিজ বণিকদের দখলে ছিল। এখনও পর্তুগিজ বংশোদ্ভূতদের আধিপত্য গোয়ায় বিদ্যমান। গোয়াতে প্রথমে মুসলিম আধিপত্য ছিল। এই ভূ-খন্ড ১৩১২ হতে ১৩৬৭ সাল পর্যন্ত অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যের প্রতাপশালী জমিদার ইউসুফ আদিল খানের নিয়ন্ত্রণাধীন চলে। এরই মধ্যে পর্তুগিজদের আনাগোনা বাড়তে থাকে। সমান তালে বাড়ে তাদের বেপরোয়া দখলদারী মনোভাব। গোয়ার কালাঙ্গুট বিচ  

১৫১০ সালের কোনো একসময়ে আল ফনসো দ্যা আলবুকারকিয়্যু নামে এক প্রতাপশালী ব্যক্তি পুরো গোয়াকে দখলে নিয়ে নেয়। পরে পর্তুগিজ বণিক ভাসকো দ্যা গামা গোলমরিচ আর স্বর্ণের ব্যবসা করতে এসে গোয়া জুড়ে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। ১৬০০ সালের দিকে এই দ্বীপপুঞ্জটির ওপর নিকটবর্তী মারাঠার (মহারাষ্ট্র) বাসিন্দাদের কিছুটা প্রভাব বলয় গড়ে উঠে। তবে ১৬০০ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত গোয়াই ছিল এশিয়ায় পর্তুগিজদের একমাত্র উপনিবেশ।  

১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা লাভ করলেও একমাত্র গোয়াই পর্তুগিজ কলোনি হিসেবে স্বতন্ত্রভাবে চলতে থাকে। দীর্ঘ ১৪ বছর পর ১৯৬১ সালের ১৮ ডিসেম্বর ভারতীয় সৈন্যরা গোয়া দখলে আনে। কালক্রমে তা ভারতের রাজ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। গোয়ার কালাঙ্গুট বিচ

ভ্রমণের সুখে নাকি অর্থ মূল্য নেই। ভ্রমণ সুখ মানুষের সৌন্দর্য চেতনাকে সমৃদ্ধ করে। আর বিদেশ ভ্রমণ হলে তো কথাই নেই। কথাগুলো বিজ্ঞজনেরা বলেছেন। ছোটকাল থেকেই ভ্রমণ নেশা আমার মগজে বাসা বেঁধেছে বলা চলে। তার কারণেই গোয়াকে ভ্রমণের তালিকায় নিয়ে আসা। দক্ষিণ গোয়ার পালোলেম বিচ

২২ জানুয়ারি রোববার। স্পাইচ জেটের একটি সুপরিসর বিমানে করে রাত ১২টা ২০ মিনিটে মুম্বাইয়ের ছত্রপতি শিবাজী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গোয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। ১৮১ জন যাত্রী নিয়ে আমাদের বহনকারী বিমানটি রাত ১টা ১৭ মিনিটে গোয়া ডাবলিম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। সেখান থেকে ট্যাক্সিক্যাব করে প্রায় ৪৩ কিলোমিটার দূরে গোয়ার সুপরিচিত কালাঙ্গুট বিচের কাছে পূর্বনির্ধারিত গেস্ট হাউজের দিকে রওনা দেই। গেস্ট হাউজটি আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন গোয়ার অভিজাত হোটেল তাজ এক্সোটিকা'র সিনিয়র স্যেফ উড়িষ্যার বাসিন্দা বন্ধু সুজিত দে।

বলে রাখা ভাল- ভারতের কিছু কিছু রাজ্যে বাংলাদেশি পর্যটকদের হোটেল-গেস্ট হাউজ পেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। এক্ষেত্রে আগে থেকে তা ঠিক করে রাখলে সুবিধা। মুম্বাই থেকে ট্রেন এবং রেলযোগেও গোয়া আসা যায়। সময় লাগে ১০ থেকে ১২ ঘন্টা। তবে বিমানে যাতায়াত ভালো। সময়ও কম, ভাড়াও সস্তা। মাত্র ১৭'শ হতে ১৯'শ টাকায় একঘন্টায় গোয়া আসা যায়। গোয়ার কালাঙ্গুট বিচ

রাত আড়াইটার দিকে রুমে এসে সকাল ৯টা অবধি টানা ঘুম দিলাম। সকাল সাড়ে ৮টায় গাড়ি এসে হাজির। সুজিত সবকিছু ঠিক করে রেখেছে। অর্থাৎ সোমবার সকাল ১০টার দিকে গোয়ার দর্শনীয় পর্যটন স্পটগুলো দেখতে বেড়িয়ে পড়লাম। গোয়ার দুইদিকে আরব সাগর এবং অপর দুই প্রান্তে মান্দবি ও জুয়ারি নদীর অবস্থান।

সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে গোয়ার বিচগুলোতে আলো-আঁধারি খেলা শুরু হয়। সাগর ও নদী তটে শত শত টেবিল-চেয়ার সাজানো থাকে। টেবিলের উপর থাকে স্বচ্ছ কাচের চিমনি। তার ভেতরে জ্বালানো থাকে মোমবাতি। পর্যটকরা মেতে উঠে ক্যান্ডেল নাইট ডিনারে। আর পানশালা, পাব, ডিস্কো ক্লাব ও ক্যাসিনোতে যেনো ভোর হয় না। দুই নদীর অনতিদূরে জাহাজে বসানো ক্যাসিনোতে সজোরে বাজতে থাকা গানের আওয়াজ আর সুন্দরী নারীদের নৃত্যে মশগুল হয়ে সব অর্থ হারিয়েও হাসিমুখে ঘোরের মধ্যে ভোররাতে হোটেলে ফেরে পর্যটকরা।  

গোয়ায় আয়ের অন্যতম উৎস পর্যটন শিল্প। শুধুমাত্র পর্যটন খাতকে ব্যবহার করে গোয়া কতটুকু লাভবান হচ্ছে সেই কথায় পড়ে আসছি।  গোয়াতে দর্শনীয় পর্যটন স্পট হলো বিচ। এরপর আসে পর্তুগিজদের কয়েকটি দুর্গ। আকর্ষণীয় বিচগুলোর মধ্যে কালাঙ্গুট, কোলভা, ডোনা পাউলো, আনজুনা, মিরামার, পালোলেম, ভাগাতুর, আরামবোল ও আগোন্ডা বিচ অন্যতম। গোয়া সমুদ্র সৈকত

দুইদিনে এক এক করে ছোট বড় সব বিচ এবং দুর্গগুলো দেখলাম। পর্যটন স্পটগুলো অপূর্ব সুন্দর করে সাজানো। সবকিছুতেই মনোমুগ্ধকর পরিচ্ছন্নতার ছাপ। পাহাড়ে সারি সারি নারিকেল গাছ। রাস্তার দুই ধারে সবুজের সমারোহ। গাড়ি চলাচলে হর্ণ বাজে না বললেই চলে। ভিক্ষুক, প্রতারক কিংবা ছিনতাইকারীর কোনো উৎপাত নেই।

মুম্বাই এবং দক্ষিণ ভারতের বড় বাজেটের অধিকাংশ চলচ্চিত্রের শ্যুটিং হয় গোয়াতে। শুধুমাত্র পর্যটন শিল্প থেকেই ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে গোয়া আয় করেছে ৩ হাজার ৪২৬ কোটি রুপি। এরমধ্যে ক্যাসিনো থেকে আয় ১৩৫ কোটি রুপি। ভারত সরকার গোয়াকে তাদের অন্যতম পর্যটন রাজ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তা অনুভব করা যায় সম্প্রতি ব্রীকস সম্মেলনের মাধ্যমে।

ভারতের এতো রাজ্য থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র গোয়ার পর্যটন শিল্পকে বহির্বিশ্বে আরও পরিচিত করে তুলতে ব্রীকস (আ্যসোশিয়েশন অব ফাইভ মেজর অ্যামারজিন ন্যাশনাল ইকোনোমিকস) সম্মেলনের আয়োজন করে বলে জানালেন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের জনপ্রিয় স্যাটেলাইট চ্যানেল তারা টিভির প্রধান নির্বাহী জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক দীপংকর নাগ। ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া, চায়না এবং সাউথ আফ্রিকাকে নিয়ে ব্রীকস গঠিত হলেও বিশ্বের অনেক দেশের রাষ্ট্র প্রধানরা এতে অংশ নেন। গেল বছরের ১৪, ১৫ ও ১৬ অক্টোবর গোয়ার বেনোলিম এলাকায় অবস্থিত অভিজাত হোটেল তাজ এক্সোটিকায় এই আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। গোয়ার কালাঙ্গুট বিচ

অক্টোবর থেকে মার্চ হচ্ছে গোয়া ভ্রমণের উৎকৃষ্ট সময়। একাধিক তারকা হোটেলের কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পর্যটন মৌসুমে গোয়াতে প্রতিদিন কমপক্ষে দুই লাখ পর্যটক আসা-যাওয়া করে থাকে। বাকি সময়েও পঞ্চাশ হাজারের বেশি তো কম নয়। গোয়াতে হিন্দি, মারাঠি, গোয়ানিজ (কনকেনি ভাষা নামে পরিচিত) ও ইংরেজি ভাষা ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

নিরুপম দাশগুপ্তলেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।